(২৩৯)বহতি হাওয়া
"আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে বসানো যায়। আধুনিকতাকে কোন বিশেষ সময় দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। আধুনিকতা থেকে যায় সারা জীবন ধরে। আধুনিকতা আর সমকালীনতাকে এক পংক্তিতে বসানো যায় না। যাঁকে কাল তাকে স্পর্শ করতে পারেনা, সেটাই আধুনিকতা। সেখানে না আছে কোন প্রাচীনের তকমা অথবা একান্ত বর্তমানের ঘনঘটা কিংবা আগামীর বিড়ম্বনা আর সব কিছুকে ছাপিয়ে সে যে সর্বকালীন।
আধুনিক সেই-ই হতে পারে, যাঁকে চিরন্তন পরিবর্তনের জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা, সমাজের কোন মলিনতা তার উজ্বলতাকে ম্লান করতে, কোন ভিন্ন মতবাদের উদ্দত ফণা যাঁর পদপ্রান্তে এসে নীরবে আশ্রয় নেয়, সেটাই স্বামী বিবেকানন্দের অদ্বৈত বেদান্ত। একদিন অরণ্যের গভীরতম পরিবেশে লালিত বেদান্ত যদি না স্বামীজীর সংস্পর্শে না আসত তবে বোধ হয় পায়ে পায়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমাতে পারতোনা।
সেই যে রূপকথার ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী দুটি পাখি কিভাবে দৈত্যের হাতে বন্দী রাজকুমারীকে মুক্ত করার জন্য রাজকুমারকে পথের দিশা দেখিয়ে ছিল, সেটাই ছিল গল্পের উপজীব্য বিষয়। আসলে অতিরিক্ত ভোগ, লালসা আর মায়া এবং সেখান থেকে উদ্ভূত দুঃখ স্বরূপ দৈত্যের হাত থেকে মুক্তিই ছিল মানুষের একমাত্র কাম্য। জীবনে শত্রু চিহ্নিত করা ভীষণ কঠিন কর্ম। আর সেই শত্রুটির প্রাণবায়ুটা কোন সিন্দুকে লুকিয়ে আছে এবং কোন অস্ত্রে তার নিধন করা যাবে, সেই রণনীতির ম্যানুয়ালটি নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো স্বামীজীর আবির্ভাব।
মাও সে তুঙ, ভো গন গিয়াপ কিংবা চে গুয়েভারার রণনীতির ম্যানুয়ালের সাথে স্বামীজীর ম্যানুয়ালের তফাৎ হলো এই বিশ্ব বরেন্য যোদ্ধারা মানুষের মুক্তির জন্য মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করেছেন, সেখানে স্বামীজী সেই দ্বান্দিকতার কারণকে খুঁজে বের করেছেন মানুষের ইনবিল্ট কম্পোজিশনের মধ্যে।
দেহ ও উভয়াত্মক ইন্দ্রীয় মনের সুস্বাস্থের পুষ্টির প্রশ্নে মনকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। এই মনের অনেক অনেক পিছনে বাস করে আত্মা। আর সেই আত্মার সম্পর্কিত কথাই 'অধ্যাত্ম' শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে। প্রাথমিক ভাবনার শুরু হয়েছে শরীরকে নিয়ে, যাঁকে দেখা যায়, যে সর্বদা পরিবর্তনশীল অর্থাৎ বস্তু পৰ্য্যায়ভুক্ত। ভাবনা সেখানে থেমে থাকেনা, প্রশ্ন ওঠে এই জড় বস্তুকে কে চালাচ্ছে এবং সেই অদৃশ্য শক্তিটিই বা কে ? সেই ঐশ্বরিক শক্তির ভাবনাটাই আধ্যাত্মিক ভাবনা। স্বামীজী নবরূপে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদকে তাঁর দার্শনিক ভাবনা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। "আত্মানম়়্ অধিকৃত্য বর্ততে ইতি অধ্যাত্মম্ " - যে অদৃশ্য আত্মাকে আস্টেপিস্টে আঁকড়ে ধরে যে দৃশ্যমান শরীর আর ইন্দ্রিয় প্রতীয়মান, সেই-ই হচ্ছে 'অধ্যাত্ম'।
সমুদ্রে নাবিক কম্পাস ছাড়া জাহাজকে ভাসাতে পারেনা। ঠিক তেমনি যে কোন সাহিত্য কিংবা রচনা বিশেষ উদ্দেশ্যকে যদি বহন করে চলতে না পারে, তবে বিস্মৃতির গর্ভে হারাতে বাধ্য।
সাধারণতঃ মানুষ দর্শন নামক বিষয় থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখে। একেই প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের কঠিন মুহূর্তের ঢেউগুলিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরে, তার পর যদি মনের উপর বাড়তি চাপকে বরদাস্ত করাটা অসম্ভব হয়ে পরে।
অনেক মাটির কাছাকাছি, যেখানে ব্যাঙ্গমা আর ব্যঙ্গমী গল্প করবে তাঁদের পরের প্রজন্মের কাছে। সেখানে থাকবে ভাষার সাথে পাঠকের আত্মীয়তা, ভাবনার সাথে বিষয়ের গভীর হৃদ্রতা, গল্প যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়, ধীরে ধীরে গল্পের জাল পাঠকের মনে বিস্তার করে বারংবার পরের ঘটনাকে জানার ক্ষিধে বাড়িয়ে তুলবে।