(২৬০) ভারতীয় সমাজে নারীর উত্তরণ ও অবমননের মানচিত্র - পঞ্চম পর্ব
চতুর্থ পর্বের পর ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
কৌতূহল পরম বিষম বস্তু। একবার যদি মণিকোঠায় পাখি হয়ে উড়ে বসে , তারপর যেই সে উড়তে শুরু করে মন তার পিছনে দৌড়াতে থাকে, কখন তাকে খাঁচায় পুড়বে বলে। সে পাখিটা কোন সাধারণ পাখি নয়, তার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমরা পৌঁছিলাম প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছর আগে।
শীতের শেষ রাত্রি, কুল কুল শব্দ করে সিন্ধু নদী বয়ে যাচ্ছে, ঠিক নদী পারে এক প্রাচীন ঋষি কুয়াশার ঢেউয়ের বিছানো গদির উপর উপবিষ্ট হয়ে ঋগ্বেদের মন্ত্র সুর করে পাঠ করে যাচ্ছেন। দুষ্ট কুয়াশা বারংবার ঋষিকে আড়াল করতে উদ্দত, তিনি তাদের আড়ালে কখনো আবছা আবার কখনো প্রকট। তিনি সেদিকে নজর না দিয়ে আবৃত্তির ঢংএ বলে যাচ্ছেন - আবহি বরদে দেবী যৎচ্ছরিতম আবাদিনী গায়েত্রী ছন্দসাম মাতা ব্রহ্মযোনি নমঃহস্তুতে। বহু সুরের মহামিলনে একটি সুরই মহাসুর হয়ে উঠে। এই মূল সুরটাকে মনে ধরে গেলো আর কলমের আগায় রেখে তারই ছবি আঁকা।
সময়ের ধারার কাছে প্রশ্ন, অতীত থেকে কোন পথকে অনুসরণ করে আজ এই প্রেমহীন এক নৈরাজ্যের দেশে এসে আমরা পৌঁছেছি। তাকে জানতে, প্রয়োজন হয়ে পড়লো কালপঞ্জির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে একটা তথ্য ভান্ডারের, যার হাত ধরে অতীত থেকে বর্তমানের পথে ঘটে যাওয়া কাহিনীগুলিতে সম্পৃক্ত হবে সেই ভান্ডার। সেই সমষ্টির থেকে কৌতূহলী মানুষরা খুঁজে নেবেন তাদের ইপ্সিত বিষয়কে। এই যাত্রায় সহযাত্রী হবেন, ইতিহাস, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য ইত্যাদি। যাত্রা শেষে আঁচল ভরে কুড়িয়ে নিয়ে আসবে অসংখ্য তথ্য।তারা আবার উপাদান হিসাবে গবেষণার মেশিনে পরীক্ষিত হয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হয়ে বেরিয়ে আসবে। সে এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।
সমাজ নামক বাগানটিকে ঘিরে রেখেছে রীতি , নীতি, চিন্তা, বিশ্বাস , অভ্যাস আর অর্থনীতি। এই বাগানের পারিপার্শিকতার নামই পরিবেশ। পরিবেশ আর অর্থনীতি চলার পথে একে অন্যের পরিপূরক কিন্তু নিয়ন্ত্রক একজনই।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন জনমানসে কৌতূহলের কাঁটাটা অনবরত বিঁধছে। কারণ ছাড়া কোন কাজ হয় না। গতানুগতিকভাবে শাসক ও শোষকের মেলবন্ধনে রচিত এক নাট্যশালা তৈরি হয়েছে আর সেখান থেকে দিনরাত উৎসারিত সংলাপ সাধারনের মনে নিজেদের সংস্কৃতির সম্পর্কে সংশয় জাগাচ্ছে। এই সংশয় থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র ইতিহাস চর্চা। তা যদি না হয়, আগামী দিনে মানুষের মানুষত্ব তলানিতে এসে ঠেকবে।
এখনই তার পদ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে রাজনীতির সাথে ধর্মের অসম কাঠবন্ধনে। একটা যদি তেল হয় তাহলে অপরটি জল, আর তেলে জলে কখনোই মিলমিশ হয়না। সম্যক না জানার যন্ত্রণার ভীষণ খেসারত দিতে হচ্ছে।
আধুনিক ভারতবর্ষ সেই প্রাচীনকালের মতো পুরোহিত, কুসংস্কার এবং ধর্মের মিলিত আলিঙ্গনে জনগণ কাতর। এই তথাকথিত আলিঙ্গনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়াটাও এই অনুসন্ধানের লক্ষ্য। সেখানে নারীদের সাথে আছে যত সব গরিব গুব্বো আর অসংখ্য জনসাধারণ।
আমরা কিসের উত্তরাধিকারী
পুরহিত আর শাসক আগে কি রকম দেখতে ছিল, আবহমান কাল ধরে ধর্ম কি ভাবে সব কিছুর নেপথ্যে থেকে জনজীবনকে প্রভাবিত করতো। ধর্ম আর অস্ত্রের মধ্যেকার ব্যবধান কতটুকু ? এর উত্তর জানতে হলে যাত্রাটিকে শুরু করতে হবে প্রাচীন কাল থেকে এবং তার অনুসন্ধান করার চরিত্রটি হবে দ্বান্দ্বিক অর্থাৎ বিচার করে গ্রহণ করা।
সমাজ আসলে কোনো মৌলিক বস্তু নয়, যৌগিক বস্তু। তাই সেই যৌগিক বস্তু গুলিকে খুঁজে পেতে তাকে জোড়া লাগিয়ে সমগ্র সমাজের সঠিক চিত্রটা ফুটে উঠবে। প্রত্যেক খণ্ডিত বস্তুগুলির নিজ নিজ চরিত্র আছে, সে কখন সার্বিক(কনসোলিডেটেড) সমাজের ধারাকে অনুসরণ করে আবার সে সমগ্র সমাজকে প্রভাবিতও করে। সমাজের অন্যতম শক্তি হচ্ছে নারী শক্তি। তার উত্থান ও পতনের কারণগুলি সব খণ্ডিত উপাদানের সাথে মিলেমিশে আছে। তাকে একবার সেই জট থেকে মুক্ত করে দেখতে হবে।
সাহিত্যের ব্যাপ্তি ও পরিমন্ডল
ইতিবৃত্তকে খোঁজার অন্যতম উপাদান হচ্ছে তদানীন্তন যুগের সাহিত্য। সাহিত্যের ব্যাপ্তি লুকিয়ে থাকে তাকে নিয়ে আলোচনার পরিধির উপর আর তাকে নিয়ে প্রভূত চর্চাই হচ্ছে তার ব্যাপকতার শর্ত। ঘটনাবলী ও রচনাবলীর প্রতি আগ্রহ বাড়ায় তাকে কেন্দ্র করে বিশ্লেষিত হৃদয়স্পর্শী ব্যাখ্যার উপর। মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন এই ইতিহাসকে যুগে যুগে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের নিজেদের গরিমাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বহু ঘটনাকে কখনো গোপন, বিকৃতি এবং মনের মতো করে সংযোজন করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রাচীন সাহিত্যের মূল্যায়ন।
সাম্রাজ্যবাদ শুধু দেশটা পদানত করে ক্ষান্ত হয় না, দেশের মানুষের চিন্তাধারার উপরও আঘাত হানে। স্বাধীন এবং সুস্থ চিন্তার জায়গাটা দখল করে নেয় এক অস্বাস্থ্যকর ভাবনা। জীবনের পরাধীনতার গ্লানি হরণ করে সময়ের সাথে এগিয়ে যাবার ভাবনাকে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির আঁচকে সেখানে পৌঁছাতে দেয় না, তার ফল স্বরূপ একটা মজে যাওয়া কর্দমাক্ত পুকুরে অবগাহন করলে যা অনুভূতি হয়, সেটাই পরাধীন জাতির ভাবনায় প্রতিফলিত হতে থাকে। কখনো সেই পাঁক আর কাদা ঝেড়ে বৈদিক সাহিত্যকে গৌরবের প্রলেপ মাখিয়ে যেমন আত্মতৃপ্তি নেয় আবার গোটা রচনাকে ধর্ম গাঁথা হিসাবে প্রচার করে সাহিত্যের গৌরবকে গোপন করে। কাল্পনিক আচ্ছাদনে ঢেকে রাখা সাহিত্যকে মোহমুক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে নিরলস গবেষণা সত্যকে সামনে এনে দিয়েছে।
আধুনিক গবেষণার ফসল
প্রথমত, বৈদিক সাহিত্য ধর্মীয় রচনার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত , এই সামাজিক অবস্থানের সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল উৎপাদন পদ্ধতির এবং সামাজিক জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতো অর্থনীতির দ্বারা। দেহের অঙ্গগুলি যেমন পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, ঠিক তেমনি সমাজও তার সহযোগী উপাদানের সাথে আন্তঃ সম্পর্ক যুক্ত। সবাইকে নিয়েই চলতে হবে।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -০৬/০৪/২৫
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।