৩৪৩ কেন আজ স্বামীজিকে নিয়ে চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা আছে - (৯)
৩৪৩ কেন আজ স্বামীজিকে নিয়ে চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা আছে - (৯)
নরেন্দ্রনাথ দত্ত—আমাদের সকলের চেনা নাম স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি কেবল এক জন সন্ন্যাসী ছিলেন না, তাঁর থেকে বেশি বোধহয়। তাঁর ভাবনার আকাশ জুড়ে ছিল অগ্নিগর্ভ বিপ্লব। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল যেন এক উত্তাল প্রশ্নমালার তরঙ্গ —যাঁরা এই ভারতবর্ষের মাটিতে মানুষ জন্ম নেয়, তাঁরা কি কেবল চিরাচরিত দেবদেবীর পুজো আর মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে? নাকি নিজেকে জাগাবে, জঞ্জালকে জ্বালাবে আর সেই আগুন থেকে শুদ্ধ এবং ধারালো হয়ে বেরিয়ে আসবে —নতুন মানুষ, নতুন সমাজ?
অতিমানবের শিক্ষা : সমাজকে ফেরত
ইতিহাস বলছে, অতিমানবেরা নিজেদের অর্জিত শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য রাখেননি। গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকলেই তাঁদের জীবনের প্রতিটা উপলব্ধি সমাজকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বুদ্ধ জাগ্রত করেছিলেন দুঃখমোচনের পথ, আর স্বামীজি সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে এসে বললেন—“যে ধর্ম গরিবের দুঃখ দূর করে না, মানুষকে দেবতা করে না, সে ধর্ম ধর্ম নয়, সে তো পৈশাচ নৃত্য।”
যুগের অন্ধকারে আলোর শিখা
ব্রিটিশ উপনিবেশে পরাধীন ভারতবর্ষ তখন এক ভয়াবহ কুয়াশায় ঢাকা। ঘরে ঘরে বাজছে কাঁসর ঘণ্টা, অসংখ্য দেবদেবীর পূজা, অথচ আসল দেবী—দেশমাতৃকা—শৃঙ্খলে বন্দী। জাতপাতের গ্লানি, কুসংস্কার আর পুরোহিতের দাপট মিলিয়ে এক ভয়াবহ অন্ধকার। বিবেকানন্দ এই দৃশ্যের অন্তরালে দেখেছিলেন প্রকৃত রোগ—অশিক্ষা। শিক্ষাহীন মানুষকে বিভেদের মন্ত্রে দীক্ষিত করে শাসকেরা চালাচ্ছে চিরস্থায়ী শোষণ। তাঁর ভাষায়, “ঐ যে গরীবগুলো পশুর মতো বেঁচে আছে, তার কারণ মূর্খতা; আমরা যুগ যুগ ধরে ওদের রক্ত চুষেছি।”
সন্ন্যাসী নাকি বিপ্লবী?
প্রশ্ন ওঠে—স্বামীজি কি সত্যিই সন্ন্যাসী ছিলেন? সন্ন্যাস মানে কি নিস্পৃহতা? তাঁর জীবন তো বারবার অন্যের জন্য জ্বলার গল্প। তিনি চেয়েছিলেন দেশকে দারিদ্র্য ও কুসংস্কারমুক্ত করতে, শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে গরিবের ঘরে। একদিকে তিনি বলছেন, “মৃত্যু যখন নিশ্চিত, সৎ উদ্দেশ্যে দেহত্যাগ করাই ভালো”—অন্যদিকে রাষ্ট্রের মৌলবাদী ও দ্বৈতবাদের খেলায় তিনি দেখছেন অমানবিক সাম্রাজ্যবাদ। বিদেশী শাসক যেমন দেশের সম্পদ লুটে নেয়, দেশীয় লোভীরাও তেমনি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষের মনজগতকে বন্দী করে রাখে। এই মানসিক দাসত্বকেও তিনি চিনেছেন—এও এক প্রকার সাম্রাজ্যবাদ।
সমাজতন্ত্রের ছায়া
বিবেকানন্দের সমাজচিন্তায় ফুটে উঠেছে সমাজতন্ত্রের পূর্বাভাস। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। নারী-পুরুষ, জাত-বর্ণ, গরিব-ধনী—সকলেই যেন একই শরীরের অঙ্গ। যদি কোনও অঙ্গকে বিষিয়ে তোলা হয়, গোটা শরীরই অসুস্থ হয়। তাই তিনি বললেন, “শাসন করতে হলে জনগণের দাস হয়ে যাও।” শাসন মানে ক্ষমতার প্রদর্শন নয়, সেবার প্রতিজ্ঞা।
নারী ও মানুষের মর্যাদা
নারীর প্রতি তাঁর উপলব্ধি ছিল অসাধারণ। তিনি উদ্ধৃত করলেন শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ—“তুমিই স্ত্রী, তুমিই পুরুষ, তুমিই বালক, তুমিই বালিকা।” তাই তিনি প্রশ্ন তুললেন—“যেখানে স্ত্রীলোক আনন্দে থাকে, দেবতারাও তথায় আনন্দ করেন”—তাহলে সমাজে নারীকে ‘চণ্ডাল’ বলে দূরে ঠেলে রাখার অধিকার কাদের? এ প্রশ্ন আজও প্রাসঙ্গিক।
নতুন সমাজের স্বপ্ন
স্বামীজির চোখে আদর্শ সমাজের ছবি খুব স্পষ্ট—যেখানে জ্ঞানের তৃষ্ণা থাকবে, ভেদাভেদ থাকবে না, ধর্ম হবে মানুষের কল্যাণের হাতিয়ার, পুজোর রঙিন আড়ালে নয়। তিনি বলেছিলেন, শাসক যদি প্রকৃত শাসক হতে চায়, তাকে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। না হলে সে কেবল ত্রাসক, দেশি বা বিদেশি যে-ই হোক।
আজকের পাঠ
আজও আমরা দেখি, দ্বৈতবাদ আর মৌলবাদের অদ্ভুত প্রতিযোগিতা, শোষণের নতুন নতুন রূপ। স্বামীজি যেন সেই সময়েই সতর্ক করে দিয়েছিলেন—অশিক্ষা ও বিভেদ যদি রুখে না দেওয়া যায়, তবে শাসক বদলালেও শোষণ বদলাবে না। তাঁর বিপ্লবী আহ্বান তাই কেবল উনিশ শতকের নয়, একবিংশ শতকেরও জরুরি শিক্ষা।
স্বামীজির জীবন এক ধ্রুব শিখা। শহরের ধুলিধূসর পথ, গ্রামের চেনা কুয়াশা, নদীর ধারে মাটির গন্ধ—সবখানে তিনি যেন ডাকছেন, “জাগো, জাগো রে!” কেবল সন্ন্যাসী নয়, তিনি ছিলেন এক জন জাগরণপুরুষ, যিনি সমাজকে ভেঙে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নতুন মানুষের স্বপ্নে। তাঁর কণ্ঠে আজও বাজে সেই সুর—মানুষের মুক্তিই প্রকৃত ধর্ম, আর সেই মুক্তির জন্য মৃত্যু পর্যন্তও মহিমান্বিত।
মন্তব্যসমূহ