(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল

 (২৪২) নারীর   একাল ও সেকাল 


সেকেলে নারী 

আদ্যিকালের সমাজপতিদের মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো পরিবার সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমাজের তথা দেশের  বুনিয়াদ শক্ত হয়। শস্যের বীজ অধিক  উৎপাদনের মধ্যে যেমন খাদ্যের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করা যায় ঠিক তেমনি প্রাচীন কালে  নারীর প্রজনন শক্তিকে মূলধন করে জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সীমান্ত রক্ষা করে রাজনৈতিক সুরক্ষার  শ্রীবৃদ্ধি করা হতো।  

প্রাচীন সাহিত্যে নারী 

একদিন নারীকে সৌন্দর্য্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে ' ব্রাহ্মণ' সাহিত্যে। একাধারে নৈসর্গিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিতে নারীকে সমাজ দর্শন করেছে।  তাই দেখা যায় যজ্ঞের সময় যজমানের পত্নীর উপস্থিতি। আবার অন্যদিকে  সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নারী পুরুষের দ্বারা পদদলিত হতেও দেখা যায়। বিবাহিত নারীকে উর্বর জমি ছাড়া বোধহয়  অন্যকিছু বলে ভাবা হতো না।  এই প্রসঙ্গে শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লেখিত একটা বিধিকে উল্লেখ করা যেতে পারে [৫ : ২ : ৩,১৩ ] যেখানে পুত্রহীনা নারীকে ত্যাগ করার বিধান দেওয়া আছে। আবার  শতপথ ব্রাহ্মণের অন্তর্গত একটি দেবকাহিনীতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে [ ৪ : ৪ : ২ : ১৩ ] ' নারীর কোন অধিকার নেই তার শরীরের উপর এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও সে ব্রাত্য। " 

নারীর সৃষ্টি কেবলমাত্র পুরুষের বংশরক্ষা আর ঘরের কাজ করার জন্য।  যারা সমাজে ক্ষমতাশালী তারা ৪ জন পত্নীর সাথে একজন পরিচারিকা এবং ভোগের জন্য ৪০০ জন দাসী রাখাটা ছিল সে যুগের সামাজিক প্রতিপত্তির নমুনা। [   শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩ : ৪ : ২ : ৮ ]

যজুর্বেদের দিকে নজর দিলে দেখা যায় নারী ও শূদ্রকে এক পক্তিতে বসানো হয়েছে।  কারণ,এরা দুজনেই ভরণ পোষনের জন্য গৃহকর্তার উপর নির্ভরশীল। তাই স্ত্রী হলো "ভার্যা " আর শূদ্র হলো 'ভৃত্য" এই দুই শ্রেণীর ভরনের দায়িত্ব  কর্তার। আবার যেহেতু শূদ্ররা পরনির্ভরশীল, তাই তাদের স্ত্রীকে অন্য বর্গের পুরুষরা  যথেচ্ছ ভোগ করতে পারে।  এই সব শাস্ত্র কতৃক মান্যতা শূদ্র ও নারী জাতিকে সবরকমের মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। 


স্বামীজীর দৃষ্টিতে নারী 

"যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমস্তে তত্র দেবতা।  যত্রৈতাস্তু  ন  পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ। " অর্থাৎ যেখানে নারীরা পূজিতা হন, সেখানে দেবতারা আনন্দ করে থাকেন।  স্বামী বিবেকানন্দ সামগ্রিকভাবে তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমেরিকায় এক  সম্বর্ধনা সভায় বলেছিলেন "পূর্ণ নারীত্বের আদর্শ পূর্ণ স্বাধীনতা। " স্বামীজী তার নিজের ভাবধারার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে সারা পৃথিবীতে সেই  উপলদ্ধিকে তার  বাণী ও রচনার মধ্যে তুলে ধরেছেন। 

কেন ভাবতে হচ্ছে  

যদি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনাকে মান্যতা দিতে হয়, তাহলে অবশ্যিই এই ভাবনার বিপরীত স্রোতে বয়ে যাওয়া সামাজিক বিচ্যুতির সুদূর প্রসারী ফলের প্রভাব থেকে  নিজেদের রক্ষা করতে হবে এবং সমালোচনায় বিদ্ধ করতে হবে। 


সামাজিক অভ্যাস ও  সংকৃতির বুনিয়াদ 

সংস্কৃতি একটা না দেখা সামাজিক অভ্যাস যা মানুষের হৃদয়ে বাস করে আর সভ্যতা, সে তো  প্রকাশমান।  তাই জন্তু থেকে মানুষে উত্তরণ - একটা জগদ্দল পাথরের মতো হৃদয়ে বসে থাকা বাধা নিষেধের প্রাচীর ও তাকে অতিক্রম করে একটা সামাজিক অভ্যাসের  জান্তব ভাবনাকে দাবিয়ে রেখে মানুষের মতো আচরণ করতে যেমন শেখায়, ঠিক তেমনি ভঙ্গুর একটা প্রাচীর আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত বিপরীত সামাজিক ভাবনা একটা মানুষকে ধীরে ধীরে জন্তু হতে সাহায্য করে। 

 সমাজে অপসংস্কৃতির স্থায়িত্বের প্রশ্নে সময় একটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকে এবং অনুসন্ধান করে দেখা যাবে সেখানে অর্থনীতির অবদান সব থেকে বেশি।  শাসকের প্রত্যক্ষ মদত ব্যতিরেকে অর্থনীতি ও সমাজনীতি পরিবর্তিত হতে পারে না, তা ঐতিহাসিকভাবে যেমন সত্য আবার গণ আন্দোলনের মাধ্যমে এই অবস্থার পরিবর্তন ভীষণ সম্ভব। কোনটাই তাৎক্ষণিক নয়।  

পরিবেশের সাথে জিনের সম্পর্ক এবং তার সামাজিক প্রভাব 

জিনের ভাবগতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পরিবেশের একটা ভূমিকা থাকে আর সেই সঙ্গে সংস্কৃতির অকৃত্তিম যোগ। পরোক্ষভাবে জিনের তারতম্যের প্রভাবে মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে এবং স্বভাবতই মানুষের চরিত্রের ক্ষেত্রে নীতিহীনতা পরিলক্ষিত হয়।   

আকরিক থেকে ব্যবহার্য  বস্তুর ক্রম বিবর্তন 

যেমন কোন আকরিক বস্তু থেকে ব্যবহার্য্য  বস্তুতে পরিণত হতে গেলে বস্তুর মৌলিকত্বের সাথে অন্য বস্তুর মিলনে যৌগিক বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে সেই বস্তু যেমন ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠে ঠিক তেমনি মানুষের অসামাজিক আচরণগুলো প্রতিনিয়ত সুসামাজিক অভ্যাসে আদর্শ মানুষ গঠন করতে সাহায্য করে । 

সার্বজনীন স্ত্রী-শিক্ষার কেন প্রয়োজনীয়তা আছে - সর্বকালের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় আইনের চক্ষে অপরাধী পুরুষেরা কোন না কোন পরিবারের সদস্য।  যেই পরিবারে সুশিক্ষিত নারীরা বসবাস করে, সেখানে প্রাথমিকভাবে অপরাধমনস্ক  পুরুষদের পরিবারের মধ্যে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। গোড়াতেই যদি  গলদ আটকানো যায়, তাহলে বাইরে অপরাধের সংখ্যা কমে আসবে।  সেটার  প্রাথমিক পর্যায়টা স্ত্রী-শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। আবার পাশাপাশি অশিক্ষিত  নারীদের প্ররোচনায় পুরুষেরা বিপথগামী হবার বহু নজিরও আছে। 

পৃথিবীতে ধৰ্ম ভাবনা 

এই পৃথিবীতে ধর্ম দুইভাবে পালিত হয়।  প্রথমটি হচ্ছে বিশ্বাস(বিদেশে বর্তমানে রিলিজিওনের পরিবর্তে ফেইথ কথাটি ব্যবহৃত হচ্ছে) আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিচার ( ভারতীয় দর্শনে অদ্বৈত বেদান্তের পথে)। বিশ্বাস যেমন অন্ধত্বের দাবিদার, ঠিক তেমনি জ্ঞানই বিচার-বিশ্লেষণের পিতৃত্বের দাবিদার। জ্ঞানই চেতনাকে জাগাতে পারে,  যুক্তিকে সচল রাখতে সাহায্য করে আর অজ্ঞান মিথ্যা ধারণার মধ্যে দিয়ে বিশ্বাসমূলক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং মানুষের মুক্তিকে বিলম্বিত করে এবং ধর্মবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।  এই পদ্ধতিটা শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের  মধ্যেই সীমিত নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও  প্রযোজ্য। যেহেতু বিশ্বাস অন্ধ আনুগত্যের নির্দ্দেশ করে এবং একই সঙ্গে খুব সহজেই মানুষকে ধীরে ধীরে সত্যের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় আর শিক্ষাকে ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত করে। 

আদিমতা ও সংস্কৃতি 

মানুষের মধ্যে আদিমতা লুকিয়ে থাকে কিন্তু সংস্কৃতিমনা মানুষ তাকে প্রকাশ হতে দেয়না। সংস্কৃতিমনস্ক তখনিই মানুষ হয়, যখন সমাজে সেটা চর্চিত হয় এবং বিকৃত সংস্কৃতিকে শাসক মান্যতা দেয় না এবং নিরন্তর জ্ঞানভ্যাসের উপযুক্ত পরিবেশ শাসক জনগণকে উপহার দিয়ে থাকে।  

ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ - ০২/০২/২৫

 https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়