(২৩৩) একটি ফোঁড়ার ইতিবৃত্ত -
যুগে যুগে মানব দেহে কিংবা সমাজে চৈতন্যের অভাবজনিত কারণে অশুভ ব্যাকটেরিয়ারা দানা বাঁধে আর সেই অপরিপক্ব ব্যক্টেরিয়া থেকে পুঁজ গঠিত হয় আর তাদের সম্মিলিত রূপই ফোঁড়ার আকার ধারণ করে। এই ফোঁড়াটি মানুষ বা সমাজের এক অস্থায়ী রূপ। এই প্রাক অবস্থানটি ফোঁড়ার অভ্যন্তরীন অবস্থা। এই অবস্থ্যায় মানুষ দৈহিক যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পরে, এই দৈহিক যন্ত্রনা থেকে পরোক্ষ প্রভাবে মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়ে পরে। এই যন্ত্রনা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তখন তার পরোক্ষ প্রভাবে মনও সুক্ষ থেকে সূক্ষতর হয়ে চেতনাকে স্পর্শ করে। এই চেতনাই অজ্ঞানতা থেকে মানুষ ও সমাজকে মুক্ত করে। এই চেতনাই পরিবর্তনের কান্ডারী। এই পরিবর্তনটা আছে বলেই এই পৃথিবীটা গতিশীল, সেখানে কারোর চাওয়াতে বা পাওয়াতে কোন ইতরবিশেষ ফারাক ঘটেনা। এটাই বিজ্ঞান, এটাই সৃষ্টির দ্বান্দ্বিক চরিত্র এবং সেটি অপৌরুষেয় অর্থাৎ ব্যক্তি বিশেষের ক্রেডিট নেবার কিছু নেই।
দীর্ঘদিন ধরে নিভৃতে মনোমন্দিরে যে ফোঁড়াটা পাঁকতে শুরু করেছিল, সে একদিন বাহ্যিক পৃথিবীতে তারই মতো অসংখ্য প্রজাতির সংস্পর্শে এসে ফেটে গিয়ে তার পুতি-গন্ধময় রূপটাকে এমন ভাবে ফুটিয়ে তুললো তাই দেখে সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তাদের ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হলো। আদতে ফোঁড়া এমন একটি ব্যাধি যতক্ষন পর্য্যন্ত সে দেহের অভ্যন্তরে থাকে তখন গুণীজন তাকে অনুভৱ করতে পারেনা, ধীরে ধীরে যখন অল্পস্বল্প নতুন চারার মতো উঁকিঝুঁকি দেয় তখনও সমাজের বাৎসল্য প্রেম তার প্রতি জেগে উঠেনা। যখন সে বিস্ফারিত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হয় , তখনও সম্বিৎ ফেরেনা। তাকে সংস্কার করার পরিবর্তে তুলো আর গজের আবরনে মুড়ে ফোঁড়ার যৌবনকে সর্বসমক্ষে আড়াল করে। অবশেষে একদিন যখন সে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে স্বীয় উন্মাদনায় সমাজের মাতৃক্রোড় থেকে জেগে উঠে তখন জগন্ময়ী'র টনক নড়ে, কিন্তু তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। অবাধ্য সেই নতুন শিশুটা নিজের অস্তিত্বের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত না করে তার অগ্রগতিকে রোধ করেন না, এটাই তার চরিত্র। অবশেষে পরাস্ত হয় অনাহুত ব্যাক্টেরিয়ারা, এই ভাবেই মানবের ইতিহাস এগিয়ে চলে।
পুঁজ-রক্ত কখনো দেহ বা সমাজের বাইরে থেকে আসেনা, শরীরের অভ্যন্তরে অর্থাৎ সমাজের অশুভ অভ্যাসের প্রবর্তন থেকে জন্ম নেয়া এক কাঙাল প্রজাতি, যে সদাই পাত্র হাতে নিয়ে মুক্তির জন্য প্রতীক্ষা করে। সুতরাং তাকে পূর্বের অবস্থায় আনতে গেলে সেই অশুভ প্রভাব থেকে দেহকে মুক্ত করতে হবে। অশুভ শক্তির চরিত্র প্রাথমিক ভাবে যেমন ছোঁয়াচে, সেটা অজ্ঞানতার কারণে ভীতি হতে পারে কিন্তু যেই মুহূর্তে অজ্ঞানের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানের উন্মেষ হয়, তখন আর সে অজ্ঞানতার বোঝা বইতে চায়না, ভয় নামক অশুভ শক্তিটা কখন যে বিদায় নেয়, সে কেউ বলতে পারেনা। এই ভয়কে জয় করার সাহসটাও ভীষণ ছোঁয়াচে, একবার মনের সঙ্গী হয়ে গেলে, বিচ্ছেদ তখন সুদূরপরাহত। এটাই অশুভ শক্তির বানপ্রস্থে যাবার কারণ। এই সব কিছুর পিছনে আছে অগ্নি, অনুভূতি থেকে যাঁর জন্ম।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে আগুন আর চাকার আবিষ্কার এবং ব্যবহার, মানুষের সাথে পশুর পার্থক্য নির্নয় করে মানুষকেই বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। তাইতো প্রাচীন সাহিত্য ঋগ্বেদে দেখা যায় 'অগ্নি' শব্দের প্রতি ঋষিদের অশেষ দুর্বলতা। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ যাস্ক কোথাও অগ্নি শব্দের অর্থ করেছেন 'অগ্নম্ নিয়তে'। যে কোন যজ্ঞে প্রথমে পূজা পেয়ে থাকেন অগ্নি দেবতা। ' অগ্রণি ভবতি' - অগ্নি হলেন দেবতাদের দলপতি , যিনি আহবান না করলে কোন দেবতা আসবেন না। সমগ্র দেবতাদের মধ্যে অগ্নির জন্ম প্রথম। এই পৃথিবীর জন্মের আগে সমস্ত ব্রহ্মান্ড জলের তলায় মগ্ন ছিল অর্থাৎ তম্মাত্রায় নিমজ্জ্মান ছিল আর সেখান থেকে অগ্নির জন্ম হয়। [ তন্মাত্র - তৎ+মাত্র , তৎ মানে সেই। শব্দ ( যা কর্ণ ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ), স্পর্শ ( যা ত্বক ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য), রূপ ( যা চক্ষু ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য), রস ( যা স্বাদ ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য) এবং গন্ধ (যে নাসিকা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য) এই পাঁচকে নিয়ে তন্মাত্র। অনুভূতিই জ্ঞানের প্রথম স্তর কিংবা মাধ্যম বলা যেতে পারে।] এই বিকাশমান জগতের সৃষ্টি হচ্ছে অগ্নি থেকে। একাধারে সৃষ্টি আবার অন্যদিকে যা কিছু অশুভ আছে তাকে ধংস করে থাকে এই অগ্নি। যে অগ্নিকে যজ্ঞতে আমরা চাক্ষুস করে থাকি সেটি অগ্নির ভৌতিক রূপ। এই অগ্নির আরেকটি রূপ যাকে দেখা যায় না, সেটি অগ্নির আধ্যাত্মিক রূপ। এছাড়া বহু নামে অগ্নি ভূষিত।
বহু ছোট বড় কাহিনীর স্রোতের ধারা এসে মিশেছে মহাভারতের সমুদ্রে। সেই রকম একটা কাহিনীতে আছে, তপস্যার শক্তিতে বলীয়ান এক ঋষি ভীষণ কুপিত হয়ে সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এমন সময় দেবতারা তাঁকে নিষেধ করলেন। উত্তরে ঋষি বললেন, " হে দেবগন, আমি তো এই অগ্নির সৃষ্টিকর্তা এবং আমার সৃষ্টির উদেশ্য হচ্ছে এই বিশ্বকে ধ্বংস করার। আমি যদি এই কার্য্য থেকে বিরত হই, তাহলে সেই অগ্নিই আমাকেই ধ্বংস করে দেবে"। এই অগ্নি হলো ক্রোধাগ্নি, যার জন্মই হলো রাগ থেকে। ' এই ক্রোধাগ্নিকে এখন আমি কোথায় রাখব' ? উত্তরে দেবতারা ঋষিকে বললেন, ' দেখুন ঋষি এই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি , যেখান থেকে সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তারই মাঝখানে অর্থাৎ সমুদ্রের মাঝখানে আপনি অগ্নিকে স্থাপন করুন'। ঋষি সেই কথা মতো তার ক্রোধাগ্নিকে একত্রিত করে সাগরে রেখে এলেন। সেই আগুন সমুদ্রের বুকে এখনো জ্বলছে আর সেই অগ্নির নাম 'বরডোয়া'। তাই মানুষের ক্রোধের আগুন এসে বর্ষিত হবে সমুদ্ররূপী সমাজে, এইটাই ভবিতব্য, এটাই কালের ইতিহাস।
জোৎস্নার রক্তিম আলিঙ্গন রাতকে -
এই তো সেদিন সমগ্র বিশ্ববাসী প্রতাক্ষ করলো একদল শ্রেণীতাড়িত নর-নারী নিশীথের অভিসারে দীর্ঘদিন ধরে হৃদয়ের একান্তে প্রতিপালিত টুকরো টুকরো আহত সুর-তালগুলি এক জায়গায় এসে মিলেমিশে এলাকার হয়ে এক ঐকতানের সুর হয়ে অনন্তের পানে ধেয়ে গেল। সেই ঐতিহাসিক মিলনের গভীর আনন্দের যাঁরা সেদিনের ভাগিদার হয়েছিল সশরীরে কিংবা সুক্ষশরীরে, তাঁরা বার বার রাতকে আলিঙ্গন করতে উদ্দত হয় সেই আস্বাদ গ্রহণ করতে। আর এই অপার্থিব আনন্দের স্বাদ যাঁরা গ্রহণ করেননি, দূর থেকে তারা তাল মিলাতে গিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধাঁধায় পরে ক্লান্ত হয়ে নিদ্রার ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখেন। এ যেন পরমব্রহ্মের অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হবার প্রারম্ভিক সূচনা, বাদ- বাকির সাথে দেখা হবে আগামীতে।
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ২৮/০৯/২৪
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
1 টি মন্তব্য:
খুবই প্রাসঙ্গিক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন