(২৬১) ভারতীয় সমাজে নারীর উত্তরণ ও অবমননের মানচিত্র - ষষ্ঠ পর্ব
পঞ্চম পর্বের পর ০০০০০০০০০০০০০০০০০০
যুগে যুগে কুসংস্কার শাসকের শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাসকের রন্ধনশালায় স্বার্থানেষী ব্রাহ্মণ পাচকদের রন্ধন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সুস্বাদু এবং সহজেই পারিপাকযোগ্য করে পরিবেশন করার একটা ধারাবাহিকতা আছে, যেটি শত পরিবর্তনের জোয়ারে নিজের উপর তার প্রভাব পড়তে দেয়নি।
বিদেশী শাসনের কুফলে ভূমিষ্ঠ হয় শাসিত জাতির মানসিক পরিমণ্ডলে এক ধরনের হীনমন্যতা। আর সেই অসম্মান জন্ম দেয় উগ্র জাতীয়তাবোধের। দৈহিক শক্তি প্রদর্শনের দুর্বলতা কখনই প্রমান করেনা একটা জাতির দুর্বলতাকে। দুর্বলতা আসলে মনের একান্ত সম্পদ, যা দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফসল।
জাতীয়তাবোধ যখন উতুঙ্গে পৌঁছে যায়, তখন সে হয়ে উন্মত্তের মতো নিজেকে আবদ্ধ রাখে বর্ষ প্রাচীন অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত বোধের সুউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা অলিন্দে। সেই প্রাচীনতাকে সর্বদা রক্ষা করে আসে বলেই সে রক্ষণশীল।
তাই সে স্বভাবগত ভাবে বহমান সভ্যতার ভাঙাগড়ার খেলায় অংশ গ্রহণ করে না। যে আলো বাতাস সমাজের আঙিনার দীর্ঘদিনের ধুলো ময়লাকে ধুয়ে মুছে উড়িয়ে নিয়ে যায়, সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোর বিচ্ছুরণকে সে সহ্য করতে না পারার দরুণ যেখানের মলিনতা আর যত কলুষতার আস্ত আবরণ জমতে থাকে।
সেখানে ফোটেনা ভোরের ফুল, কেউ করজোড়ে সূর্য্যের কাছে প্রার্থনা করে না আলোর দৃষ্টির। তাই সেখানে আলোর অভাবে শঙ্কা অবাধে বাস করে, চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। আর মাঝে মাঝে আলোর কণা যদি স্ফুলিঙ্গের মতো সেখানে ঢুকতে চায়, সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সে একদল অন্ধকারের ব্যবসায়ী তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে। যার ফলে সমাজটার আর সংস্কার মুক্ত হয়ে উঠে না। এইটাই তাদের কাছে কুসংকারকে জিইয়ে রাখার উন্মাদনা। তাই তারা এই ফসিলকেও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সংরক্ষিত করে।
মানুষ প্রথমে আধিপত্য বিস্তার করে বনাঞ্চলকে দখল করে প্রাথমিক সম্পদকে রূপান্তরিত করে সম্পত্তি হিসাবে , তারপরে সে এগিয়ে যায় শ্রেণী ভাঙার খেলায়। যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার খেলা একদিন প্রকৃতিকে দিয়ে শুরু করেছিল, সেই খেলা বর্তমানে রাষ্ট্রে, সমাজে ও পরিবারে অপ্রতিহত গতিতে বিস্তার লাভ করেছে।
লোহার লাঙ্গলের ফলা শুধু মাটিতে ফসল ফলিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, সে জন্ম দিয়েছিলো শ্রেণিবিন্যাসের। প্রাকৃতিক সম্পদ পরিবর্তিত হয়েছিল সম্পত্তি হিসাবে। কি বিচিত্র এই বিশ্ব, প্রকৃতির সম্পদ, তার উপর কৌশল করে একদল সেই সম্পত্তির মালিক হল। মাঠ মানুষের কাছে হয়ে উঠল শস্য ফলানোর ক্ষেত্র। উৎপাদন ছাড়া তো ফসল ফলে না, বিভাজনটা আগেই হয়েছিল, তাই সমাজে নতুন এক শ্রেণীর জন্ম নিলো। একদল জমির মালিক আরেকদল এই কৃষি শ্রমিক।
সামাজিক বিন্যাস কি স্বার্থপরতার প্রাথমিক সোপান ?
কৌম থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে কূল, আর তার থেকে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। সামাজিক জীবনের বিন্যাসে বিকশিত হলো ক্রমবর্ধমান মানসিক সংকোচন। সংঘব্ধতা যদি অমৃত হয় তাহলে বিভাজন অবশ্যিই বিষতুল্য হবে।
যখন বাহ্যিক প্রকৃতি ছিল জীবনধারণের পক্ষে প্রতিকূল আর সেই প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রামরত একদল নারীপুরুষ বেঁচে থাকার স্বার্থে একত্রিত হয়ে যে সমাজটা গঠন করেছিল , সেটাই কৌম। দ্বান্দ্বিকতা সৃষ্টির ধর্ম। যেই সম্ভাবনা থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছিল একটা যৌথ মঞ্চ, সভ্যতার অগ্রগতির সাথে একটু একটু করে প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলো, তখনিই ধীরে ধীরে যে চারটি পায়ের উপর যে যৌথ মঞ্চটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার পায়াগুলি স্বাধীন হতে চাইলো। তাই ভেঙে পড়লো কৌম। সেই শূন্যতাকে ভরিয়ে দিলো একাধিক গোষ্ঠী। তারপর সেই না বলা গল্পের পুনারাবৃত্তি ঘটতেই লাগলো। হয়তো এই ভাঙ্গন সৃষ্টিতত্ত্বের নিয়মে যেখান তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেখানেই সে শেষ হবে। সবের শেষ বোধ হয় সেই ১ এ এসে ঠেকবে। একে একে ঝরে যাবে বহুত্বের মিথ্যা ধারণার। এ যেন মহাআবরণের অন্তরালে সেই অদ্বৈত ভাবনার আত্মগোপন।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -০৯/০৪/২৫
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ