3. দলিতদের সভ্যাভিমান

দলিতদের  সভ্যাভিমান 

সমব্যাথীগণ,

তোমরা জানতে চেয়েছো ,ভীম গোরেগাঁওয়ের স্মরণে প্রতি বছর  কেন আমরা উৎসব পালন করি এবং তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য কি? 

একটা ঔপনিবেশিক শক্তি  ( ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) আর অন্য্ দিকে  আরেকটা দেশীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে   ভীমা করেগাঁওয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল  আমাদের পূর্বসূরিরা এবং সেই যুদ্ধে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে তারা অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। সেই যুদ্ধে ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি বর্ণ গন্ধহীন দলিত বলে  যাদের পরিচয় ,সেই  সম্প্রদায়ের বীরত্বের গাথাকে আমরা প্রতি বছর   স্মরণ করি । 

 দেশের  ধৰ্ম ও তাদের বর্ণ  বিভাজন প্রথা অনুযায়ী আমরা সর্বাপেক্ষা মর্যাদাহীন  বর্ণের  অধিকারী । আদর করে নাম দিয়েছে দলিত বা নিপীড়িত সম্প্রদায়।  উচ্চ বর্ণের পদতলে যাদের চিরকালের অবস্থান।

  ১৮১৮ সালে, আমাদের  পূর্বপুরুষরা এই ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধে অর্জন করেছিল বীরের মর্যাদা আর সেই মর্যাদাটা দিয়ে ছিল সাগরপাড়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।   অবশ্য যে কেউ দিক না কেন, নাম গোত্রহীন মানুষের কাছে সেটা পরম গৌরবের জিনিস।  অবশেষে, সেই অর্জিত গাঁথাটাকে আঁকড়ে দ্বিশতাধিক কাল ধরে আমরা একান্ত নিজেদের স্বীকৃতি  ভেবে যত্ন করে  লালন পালন করে আসছি।  

সেই গরিমার বহিঃপ্রকাশ সেদিন প্রকাশ্যে করে ফেলায়, তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা সেই স্বাধীনতাকে হরণ করতে চাইলো।  আমাদের আবেগকে হেলায় অস্বীকার করতে চাইলো।  সেই প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে আমরা ধর্মঘটটাকে বেঁচে  নিয়েছিলাম।

দেশের সংবিধানের বাধ্যবাধকতা, সংকৃতির ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করে এক শ্রেণীর বর্ণে গর্বে গর্বিত মানুষ, যে কোন শাসনকাল হোক না কেন খুব সচেতন ভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের মাড়িয়ে চলে।

সামরিক বাহিনীতে নির্ভীক সৈনিকরা বীরের মর্যাদা  পায়।  সে কোন শাসনকাল হোক না কেন ? বীরকে বীর মানতে অসুবিধা কোথায়, অবশ্য এক শ্রেণীর মানুষের তাতে অসুবিধা হয় এবং সেই বীরেরা যদি অন্য্ কোন শ্রেণীর হয়, তাহলে তাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে, কেননা তারা সমাজের একদম নিম্ন  শ্রেণীর বলে,  এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি।

পৃথিবীতে যত  মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছে , তার থেকে বহু মানুষ মারা গেছেন শুধু মাত্রা স্বীকৃতি পাওয়ার অভাবে। স্বীকৃতি, মানুষের মহান সম্পদ, তার স্থান মানুষের হৃদয়ে, তাদের গোপন অহংকারে। অন্ধ সমাজের স্বঘোষিত মাতবররা  এই  অনাদরে পালিত সম্প্রদায়ের আবেগটাকে  উপলব্ধি করতে পারেনি।

এই পৃথিবীতে গাছ, ফুল,ফল ,মাঠ , দিগন্ত, নদ-নদী ,বায়ু ,জল, প্রাণী ও মানুষ প্রভৃতিকে এই প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে।  যে  ফুলের সুগন্ধে তোমরা তৃপ্ত হও , আমরা ও  হই , যে বাতাস তোমার ক্লান্ত শরীরকে শান্ত  করে  তা আমাদেরকে ও  করে , যে জল তোমাদের  তৃষ্ণার্ত  প্রাণকে ঠান্ডা করে , তা আমাদেরকে ও করে,  যে মাঠের শস্য দানা  তোমার দেহকে পুস্ট করে তা আমাদেরকেও করে, যে ভাষায় তুমি তোমার প্রেমিকাকে আমন্ত্রণ পাঠাও , আমরাও  অনুরূপ করি , যে সংবিধান তোমাকে নাগরিক হিসাবে গণ্য করে , আমাদেরকে ও তাই-ই করে।, তোমাকেও যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে আমাদেরকেও তাই , যে ধৰ্ম  বা আচার পালন কর তোমরা পূর্ন  স্বাধীনতায় , তবে  আমাদের ক্ষেত্রে তোমাদের এত কৃপণতা কেন ? তোমাদেরকে তোমাদের আরাধ্য অনুষ্ঠানকে স্মরণ  করার জন্য ধর্মঘট করতে হয়না কিন্তু বলতে পারবে তোমরা , আমাদের কেন তা করতে হয়?

সময় থেকে সময়ান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে, বারে বারে আমাদের বঞ্চিত করার ধারাবাহিকতা তোমরা  এই সমাজে আমাদের প্রতি করে আসছো  , তার কি সর্বজনগ্রাহ্য় কোন উত্তর তোমাদের কাছে আছে ?

আমরা কি কলার  উপরের আস্তরণটা  কি খাই ? ভিতরের অংশটা  কেমন  সুস্বাদু তা একবার পরখ করে  তোমরা দেখ।  মুক্ত দৃষ্টিতে  তাকিয়ে দেখ , ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি নামক খোলসটা কে বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষ কর আমাদের আবেগকে। ভুলে যেওনা , আজ  আমাদের জনসংখ্যা  প্রায় ২৪ কোটি , সংসদীয় গণতন্ত্রে  এই অংকটা অস্বীকার করার মতো নয়।  পরিশেষে, তোমরা আমাদের সম্বোধন কর দলিত বলে আর আমরা  আমাদের পরিচয় দিই  ভারতীয় বলে।

ইতি জনৈক দলিত।






















মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়