2. একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা।
একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা।
অনেক প্রলোভন দেখিয়ে প্রকৃতি তাকে এই পৃথিবীতে এনে ছিল। সে দিন ভেবেছিল বুঝি বা মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ সুবিধা পাবে। কিন্তু সে জানেনা যে, গরিবের ঘরে জন্মগ্রহন করবার অর্থ কি। তবু সে অদম্য উৎসাহ নিয়ে এই মনুষ্য সৃষ্টি দারিদ্রের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘকাল বিরামহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ পরিণতির নিকট অবশেষে তার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। জীবনকে পরাস্ত করে মৃত্যুর বিজয় রথ এগিয়ে চলল কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে।
অন্যান্য প্রাণীদের সাথে মানুষের পার্থক্য হলো, মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য পালনের যোগ্যতা। ইদানিং কালে ওটার আর কোন প্রয়োজন নেই , এখন প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মৃত্যুর পরে মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য পালন করা। তাই আমরা আজ এধানে সবাই সমবেত হয়ে তার মৃত আত্মার প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছি।
আজ মানুষের জীবন থেকে স্নেহ ভালোবাসা ও কর্তব্যপরায়ণতার পরিবর্তে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বতা প্রমান করার জন্য মানুষ আর একটি মানুষকে ছোট করে। এতে সে অত্যন্ত আনন্দ পায়।
এই পৃথিবীতে কতশত ধনবান, গুণবান, রূপবান ও বলবান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মুদ্ধ করে ছিলেন, সে কথা আমরা জানি, কিন্তু আজ তারা কোথায় ? তাদের এই কালস্রোতে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল, সে কথা কেউ জানেনা, কেউ তার হিসাব রাখেনা।
মানুষের জন্মকাল থেকে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ে মিলে যে স্নেহ, ভালোবাসা ও খাদ্য সামগ্রী দিয়ে এই দেহ মনকে পুস্ট করে গড়ে তুলেছিল, তাতে করে আমাদের মনে মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকার প্রশ্নটি অধিক সত্য বলে বিবেচিত হওয়ায় মৃত্যুজনিত হতাশা এসে মনের উপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু একদিন দেখা যায়, সেই প্রকৃতি অতীতের দাতারূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত দস্যুর মত আমাদের অস্তিত্বটি পর্যন্ত লুন্ঠন করে চলে যায়।
আমরা যে আজ শুধু সামাজিক অস্তিত্বের দিক থেকেই বিপন্ন তাই নয়, আমরা সমস্ত বিশ্ব অস্তিত্বের দিক থেকে বিপন্ন। বিশ্বের বাইরে কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকুক এ জিনিস বিশ্ব নিজে তা পছন্দ করেননা, এটা তার শত্রূতামূলক আচরণ নয়, এটা হল আমাদের প্ৰতি তার ভালোবাসার নিদর্শন।
আমরা যেমন আমাদের প্রিয়জনকে নিকটে পেতে চাই, প্রকৃতিও ঠিক তাই চায়। তাই সে আমাদেরকে নিজের কোলে টেনে নেয়। মৃত্যু শুধুমাত্র অনিবার্য নিয়মই নয় , মৃত্যু উন্নত জীবনবোধের সহায়ক ও বটে।( উল্টে আমরা আবদ্ধ যা আমাদের পীড়ার কারন সেই মায়ার বন্ধনে ) তা সত্ত্বে ও আমরা কেউ পছন্দ করিনা। তার কারন হল একমাত্র আমাদের মনন পদ্ধতি অর্থাৎ পরিবেশ। সৃষ্টিতে পরম ব্রম্ম ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়ম, পৃথিবীর যা কিছু সূষ্টি তা সেই মৌলিক বস্তুর খণ্ডিত রূপ, স্বাভাবিকভাবেই সেই অখণ্ড বস্তুর সাথে খণ্ডিত বস্তুর মিলিত হওয়ার সর্বকালীন আকাঙ্খাটাই চিরন্তন সত্য।
এই পৃথিবীর গাছপালা, পশুপাখি, মাঠঘাট, নদনদী, পাহাড় পর্ব্বত এবং জলহাওয়ার সাথে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, সেই সম্পর্ক মানুষ স্বেচ্ছায় ছিন্ন করতে চায়না। সে সম্পর্ক আপাতত মধুর না হলেও ভাবাদর্শের ক্ষেত্রটিকে সে মধুর প্লাবনে পরিণত করেছে।
প্রকৃতির কাছে মানুষের প্রশ্ন হল, কেন তুমি আমাদের নানান ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে এখানে নিমন্ত্রণ করে এনেছ ; আর কেনই বা শেষে কুকুরের ন্যায় তাড়িয়ে দিলে ? এটা কি তোমার বিশ্বাসঘাতকতা নয় ? তবে এ কথা বুঝেছি যে, বিশ্বমনের চাহিদা আমাকে দিয়ে আর পূরণ হচ্ছেনা। এটা তোমার অস্তিত্বের জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, তাই তুমি অত্যন্ত নির্মমভাবে আমাদেরকে ত্যাগ করতে চাইছ। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা তোমার সাধ্যের অতীত, এ কথা যেন মনে থাকে।
যখন ভাবি সবাইতো রয়ে গেল, তখন মনে বড়োই দুঃখ হয়। আবার যখন দেখি সে কাউকেই ছেড়ে দিচ্ছেনা , এমন কি নিজেকেও নয়। তখন ভাবি এ আবার কেমন জিনিস , লোকে বলে সত্য পদার্থের নাকি এই রকমেরই স্বভাব থাকে।
যাহা হোক আমরা আজ এখানে মৃত আত্মার প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য সমবেত হয়েছি। আমাদের শাস্ত্র বলে যে, আত্মার মৃত্যু নেই, তাই যদি হয় তাহলে 'মৃত' আত্মা কথাটি ব্যবহার করছি কেন।
মৃত কথাটির অর্থ হল অস্তিস্ত্বের অস্তিত্ব বিলোপ, কিন্তু বিজ্ঞান বলে যে কোন বস্তুর বিলোপ হওয়া সম্ভব নয়, হয় শুধু তার রূপের পরিবর্তন। যেমন, সমুদ্রের তটে বহু মানুষের আনাগোনা ঘটে , কিন্তু ঢেউয়ের আঘাতে পুরাতন পদচিহ্ন গুলি মুছে যায় , সে স্থানটি অধিকার করে নুতন পদচিহ্ন। নদীর জলধারা যেমন বিরামহীন গতিতে সমুদ্রের দিকে ছুটে চলে তেমনিভাবে মানুষের জীবনে মৃত্যুর প্রবাহটিও অনন্তকালের প্রক্রিয়ার মধ্যে বিলীন হয়ে স্থায়ী নব বিশ্বচেতনার সৃষ্টি করে। তাই পন্ডিত ব্যক্তিগণ বলেন যে, বাহ্য প্রকৃতির সাথে অন্তঃপ্রকৃতির সামঞ্জস্য স্থাপনের নামই জীবন। অর্থাৎ বৈপরিত্যের ঐক্যই হল জীবন। এই ঐক্য শর্তাধীন, সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী ও আপেক্ষিতার ভিত্তিতে শুধু স্থিতিশীল।
কোন বস্তুর গুন খেয়াল খুশি মতো যে কোন পরিমানের সঙ্গে ঐক্য সম্বন্ধ থাকতে পারেনা। পরিমান ও গুন সর্বদা পরস্পরের সঙ্গে একটি বিশেষ অনুপাতে বর্তমান থাকে। পরিমাণগত পরিবর্তন হলেই গুনগত পরিবর্তন হয়না , যদি না তা মাপের সীমার অন্তভুর্তের সীমা অতিক্রম করে। অতএব , মৃত্যু হল রূপের অস্থায়িত্বের নিয়মের ভিত্তিতে স্থায়ীরূপ। মূলতঃ আমরা কিছুই হারায় না , আমার যেটা হারাই বলে মনে করি , তা হল অস্তিস্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনা।
এই ধারণাটি অবাস্তব নয়। এই ধারণা প্রমান করে আমাদের অস্তিত্বের বর্তমান সত্ত্বা। এই সত্ত্বার নিয়ম অনুসারে, আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি।
এ কথাটি ঠিক যে, সে তার কর্মময় জীবনের পরিচয়টিকে নিয়ে শুধুমাত্র আমাদের নিকট থেকে বিদায় নেয়নি, বিদায় নিয়েছে এই বিশ্বের সকলের নিকট থেকেই। তাতে অন্যকেউ ব্যথিত কিনা তা সঠিক বলতে পারবো না , তবে আমরা মানুষের বেদনা প্রকাশ করার জন্য একটি সভার আয়োজন করেছি। আমার মনে হচ্ছে যে, আমরা তো একটি নুতন অভ্যাস করার চেষ্টা করতে পারি। তা হল, জীবন্ত আত্মার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করার ব্যবস্থা করা। হয়তো কিছু মানুষের তাতে আপত্তি থাকতে পারে, কেন না তাদের হয়তো এর চেয়ে বড় চিন্তা হল মৃত আত্মার সদ্গতি নিয়ে। কিন্তু এই জীবন্ত আত্মাগুলি প্রত্যাশা করে যে ,আমরা যেন মৃত আত্মা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে জীবন্ত আত্মাগুলির প্রতি একটু নজর দিই।
ব্লগার - রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ