7. A story of Eternal Love -বন ও বিতান

 বন ও বিতান


আবহমান কাল জুড়ে  ভাঙ্গা আর গড়ার  খেলা   প্রকৃতির সংসারের এক অপরিবর্তনীয় ব্যতিক্রমের  উজ্জ্বলতম নিদর্শন। কোন এক অতলান্তে  প্রকৃতি  শুরু করে ছিল  তার এই পরিক্রমা  তা  বিশ্ব  সংসারের বহু পরিবর্তনের মধ্যে সে একই গতিতে প্রবাহমান। প্রাণী  জগতেও  হয়নি তার  এ নিয়মের  ব্যত্যায়।

এই বর্ণময় জগতে একদিন  বীজ থেকে অঙ্কুরিত প্রাণ  আলো , বাতাস, জলের সংস্পর্শে এসে  সে আকাশপানে চেয়ে শির উঁচু করে বিশ্বের  কাছে জাহির করে তার অস্তিত্বকে। একে একে   আসে  ঋতুরা,  চলে যাওয়া শূন্যতাকে  নতুনের  আগমনে তাকে ভরিয়ে তোলে,   বিরামহীন ভাবে চলে তার আসা-যাওয়া।

 প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের  মধ্যে বেড়ে উঠে তার স্নেহধন্য কুশি-লবেরা , ঋতু প্রবাহের  সাথে একাত্ম হয়ে তারা বড় হয়ে উঠে। কালের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে একদিন  জীবনকে নাড়া দেয় ঋতুরাজ বসন্ত। তার আগমনে  দেহ-মনকে এক নাম না-জানা অনুভূতি বিবশ করে দেয়। এই অন্তঃপ্রকৃতির মোহময় স্বত্বা কে অজান্তে অধিকার করতে চায় দৃশ্যমান জগৎ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জাগতিক বস্তুর প্রতি আকৃষ্টতার হাতছানি মনের গহন প্রদেশ থেকে উৎসারিত হয় । এমন এক সময়  দূরে কোন নক্ষত্রলোক থেকে সাবধানবাণী উচ্চারিত হোলো - মর্তবাসীরা, সাবধান ! 'বসন্ত এসে গেছে'।

কল্পলোকে বিচরণকারী মানব-মানবীর কাছে এই সাবধানতার অমোঘবানী ছিল বেসুরো একটা  শব্দবন্ধ মাত্র।  জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার একাত্মতাই  ছিল একমাত্র এই সুরের পূর্নতা।

সৃষ্টির উৎস থেকে নেমে আসা জলরাশিকে পথের মাঝে পরে থাকা বিশাল বিশাল পাথরখন্ড  কখনো পারেনি  তার গতিকে স্তব্ধ করতে , বরং বাধা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে  সেই জলরাশি বিপুল শক্তি বাড়িয়ে অজানা পথের উদ্দেশ্যে বীরদর্পে পুনরায় যাত্রা করে। এই বাঁধ ভাঙ্গা জীবনের  কারিগরেররা নিজেদের অজান্তে কখন যে সৃষ্টি করে ফেলে নয়া ইতিহাস তা তারা নিজেরাই জানেনা । 

এই গল্পের কেন্দ্রীয়  চরিত্রে  বন (বনলতা ) ও বিতান। এই কাহিনীর বিন্যাস আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে। 
সিডার গ্রাম, বালাসান নদী (সোনাদা ,দার্জিলিং)

ঘটনাটি সিডার গ্রামের এক প্রান্তিক বৃদ্ধা মহিলা গিরিজাবালার মুখ থেকেই  শোনা যাক -

কয়েক যুগের আগের ঘটনা, তখন এই গ্রামের থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক  পাহাড় ঘেরা জঙ্গলে গিরিজাবালা তার স্বামীর সাথে থাকতেন। তারা তখন সদ্য বিবাহিত দম্পতি। জীবনের নতুন অঙ্গনে প্রবেশের এক বিরল অনুভূতি। জন-মানবহীন বন ভূমিতে দেড়তলা কাঠের বাড়ি , তাকে আবৃতকরে চারধারে পেয়াদার ন্যায় লম্বা লম্বা গাছ, দূরে আকাশচুম্বী পাহাড় দুর্গের পাচিলের মতো  দাঁড়িয়ে আর নিচে খাদগুলি যেন তার পরীখার মত বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে আছে। মেঘ-আলোর বন্ধনীতে উপত্যাকায়  সময়ে অসময়ে বেশভূষার আড়ম্বর মননপ্রক্রিয়াকে ক্রমেই সংক্রামিত  করে হাতছানি দেয় সেই অন্তহীন নয়নাভিরাম  স্বর্গ  রাজ্যে পারাপারের ।

উম্মুক্ত আকাশ , পাহাড়ি নদী বালাসন আপন  ছন্দে নেচে গেয়ে চলেছে।  যেখানে সামনে বড় বড় পাথরের বাধা প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে , অবহেলায় তাকে অগ্রাহ্য করে   শো শো শব্দে পূর্ব রাগের সাথে মিলিত হয়ে কোন এক বাঁকে গিয়ে  সে দৃষ্টির অন্তরালে  মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখিরা দলে দলে আকাশপথে উড়ে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সাঁঝ বেলা গড়িয়ে  এলো। যখন ঐ মস্ত বড় পাহাড়ের কোলে   পৌঁছাল , তখন প্রায় রাতের  প্রথম প্রহর।

এমনসময়, অন্ধকারের নিঃশব্দতাকে খান খান করে  নাম না জানা এক পাখি চিৎকার করে ডেকে উঠতেই সম্বিৎ ফিরে এলো তাদের। হঠাৎ পুবের দিক থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়ার  এলোপাথাড়ি ঝড় উঠলো আর তার সাথে ভেসে এলো একটা চাপা কান্নার আওয়াজ।  সেই আওয়াজ পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে নাড়া  দিয়ে গেল সমগ্র বনাঞ্চলকে। সারা শরীর এখনো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে সেদিনের কথা ভেবে। সেদিন যে তারা কিভাবে বাড়ি ফিরে এসেছিল তা পরে সঠিক ভাবে মনে করতে পারেনি।

তারপর, গিরিজাবালা সেদিনের ঘটনাটা গ্রামে এসে বলতে, গ্রামের এক প্রাচীন বিজ্ঞ  গগন লামা বলতে শুরু করলেন ...... 

আজ থেকে প্রায় আশি-নব্বই বছর আগের ঘটনা, প্রতিবারের মতো পাহাড়ে শুরু হয়েছে  "লোসার উৎসব  "- প্রত্যেক বছর ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে এই অনুষ্ঠানটা পাহাড়ে হয়। মূলতঃ অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে  পাহাড়বাসীকে ঈশ্বর যেন রক্ষা করেন এই-ই ছিল অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। এই উৎসব ঘিরে পাহাড়ে পাহাড়ে চলে আনন্দ অনুষ্ঠান। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উৎসবের রেশ বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল। এইখানেই একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় সিকিমের রাজপরিবারের এক সুদর্শন যুবক বিতানের সাথে এই গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের লাবণ্যময়ী কন্যা  বনলতার (বন) সাথে। প্রথম দর্শনেই আকস্মিক বিহ্বলতায় ভালোলাগার এক নিবিড় আচ্ছন্নতা তাদেরকে গ্রাস করেছিল, এটা উপস্থিত জনের দৃষ্টিকে এড়াতে পারেনি। সময়ের কাঁটাটা যেন সেই চরম মুহূর্তের জন্য  যুগের পরে যুগ  ধরে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

তারপর সবই চলছিল গতানুগতিক তাল বাধা ছন্দে। তাদের জীবনের সাবলীল গতিতে দীর্ঘ পথে ছুটে চলা অশ্বমেধের ঘোড়াকে পারিবারিক অহংকারের শিকলের বেড়াজাল দিয়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা চললো।

যে প্রেম গহন পথে তার সিংহাসন পেতে ছিল তাকে আটকে রাখার সাধ্য কার। সেদিন, আকাশে উঠেছিল পূর্ন চন্দ্র , সারি সারি লম্বাকায় গাছ আর  দীর্ঘায়িত তার ডালপালা বিদীর্ণ করে জোছনা যাতায়াতের সড়কের  মধ্যে পেতে দিয়েছিল আলো-আধারির এক স্বপ্নিল গতিপথ ।  সেই মোহময় পথের   আকর্ষনে  তাদের পা দুখানিকে ক্রমেই টেনে নিয়ে  যাচ্ছিল সেই যুগের পর যুগ ধরে কিসের প্রত্যাশায় তপস্যায় অবিচল স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকা  বিশাল পাহাড়গুলির  কাছে । পথে  যেতে যেতে কখন দুপাশে লালিগুরান ফুলের নয়ন জুড়ানো বাহার আবার দলবব্ধ গোডাভারির হালকা হাওয়ার তালে মাথা দুলানি, ক্রমেই পথ তাদের নিয়ে পৌঁছাল এক পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে। সেই ঝর্ণার জল ঝমঝম শব্দে কোন এক উচ্চতার শিখর থেকে  পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে তাকে কখনও আঁকড়ে ধরে, কখন বা  বিলম্বিতলয়ে  নিচে বয়ে যাওয়া  নদীর জলের সাথে মিলে মিশে যেন  অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল আর  তারপর তারা সবাই মিলে  হৈ হৈ  করে  করে দূরে কোথায় যেন হারিয়ে যাছিল। অনবরত চলছে তাদের এই খেলা। একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঝর্ণার আওয়াজটা ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর  হয়ে  যাচ্ছিল  আর হালকা হাওয়ায় পাতার সাথে পাতার চুম্বনের  শব্দ  সঙ্গে চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি।  সব মিলিয়ে  আশ্চর্য্য এক মায়াবী পরিবেশের  সৃষ্টি করেছিল। আজ  তারা  স্বাধীন, নেই কোন পিছুটান , শুধু শিকল ভাঙার গান।

খাদের ধারে অবস্থিত বনবাসের দীর্ণ কুটিরটা বন ও বিতানের নিটল ভালোবাসার মোড়কে হয়ে উঠেছিল রাজ-প্রাসাদ। ভোরের পাখির কলতান যেন ভৈরবী রাগে প্রাসাদের নহবতখানাকে মাতিয়ে তুলেছে। কুটিরের বাইরে আধো আলোমাখা বেশ দেখে  বিতান লক্ষ্য করলো আজ আকাশের অবস্থ্যা বিশেষ ভালো নয়। যা তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে রেখেছিল তা গতকাল শেষ হয়ে গেছে। তীর ধনুক সঙ্গে নিয়ে দুজনে খাদ্যের সন্ধানে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। বেশ খানিকটা দূর যাবার পর লক্ষ্য করলো একটা হরিণী মৃদু মন্দ পায়ে অনমনষ্কভাবে হেটে যাচ্ছে। কালবিলম্ব না করে ধনুকে তীর সংযোজন করে নিখুঁত নিশানায় তাকে বিদ্ধ করলো। গাছের একটা মাঝারি ডাল ভোজালি দিয়ে কেটে আর কিছু লতা পাতা সংগ্রহ করে হরিণীর কাছে যখন পৌঁছাল তখন  সে অন্তিম শ্বাস নিচ্ছে  , তার হাত ও পা-দুখানি ডালের সাথে বেঁধে কাঁধে  ঝুলিয়ে নিয়ে  দুজনে কুটিরের দিকে যাত্রা শুরু করল।

এক নাগাড়ে কথা বলতে  বলতে বৃদ্ধ গগন লামা একটু থামলো।  বাইরে,  তখন প্রবল বর্ষা; দিনের  বেলায় রাতের হাতছানি , সামনের বস্তুকে স্বল্প আলোকে ঝাপসা লাগছে ,  অনবরত বয়ে যাওয়া  কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর কাঠের  ধিকিধিকি আগুনের কৃপন উত্তাপ এক নিরবিচ্ছিন্ন ঠান্ডার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। কাঠের আগুনে গরম জলের সাথে ঘরোয়া পদ্ধাতিতে শুকানো চা পাতা দিয়ে চা বানিয়ে সে নিজে এবং গিরিজাবালা ও অন্যান্যদের পরিবেশন করে, আবার বলতে শুরু করলো।

কোন মানুষের  এক জীবনে  কখনই  পূর্ণতার স্বাদ মেলেনা। আর মিলবেই বা কি করে ! এটাই তো প্রকৃতির ধৰ্ম।  বৈচিত্ৰই  যদি না থাকে তাহলে জীবনটাই আলুনি লাগে। তবে বন ও বিতানের ক্ষেত্রে প্রকৃতি এতটা কৃপণ যে তাদের প্রারম্ভিক  জীবনটাকেও  উপভোগ করতে দিলোনা। কেনই বা আহ্বান করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা, সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখানো  আর কেনই বা নির্মমভাবে তাকে কেড়ে নেওয়া , কিছুই বুঝতে পারলাম না; এই বলে গগন লামার ভেতর থেকে  একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

দীর্ঘ ৭ মাস অতিক্রান্ত, তবু ও বিতানের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের খুঁজে বার করবার প্রক্রিয়া এক দিনের জন্য থেমে থাকেনি। সময়টা বোধহয় অক্টোবরের শেষাশেষি, সাধারণতঃ এই সময়ে খুব বেশি ঝড়বৃষ্টি পাহাড়ে হয়না। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে আবহাওয়া বেশ হতাশজনক, ঠিক সেদিন বেশ ঝোড়ো হাওয়ার সাথে আকাশ ভেঙে অঝোরে বৃষ্টি।  মনে হচ্ছে এই কঠিন পাথরের গর্বিত পাহাড় অনবরত বৃষ্টির দাপটে মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাহাড় থেকে ধস নামার খবর আসছে।   বিতানরা তাদের অস্থ্যায়ী বাসস্থান ছেড়ে উত্তর দিকের পাহাড়ের ঠিক খাদের পাশে  এক পরিত্যাক্ত জীর্ন মন্দিরে  আশ্রয় নিয়েছে। 

অবশেষে এলো সেই ভয়ংকর রাত, দীর্ঘ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে আলিঙ্গনবদ্ধ  হয়ে প্রকৃতির দুই সন্তান গভীর ঘুমে অচেতন। হিংস্র দস্যুর মতো গুটি গুটি পায়ে রাজার সেনারা ঘিরে ফেললো সেই জীর্ন মন্দির ,  হঠাৎ ঘোড়ার পায়ের শব্দে আর মশালের আলোয় তাদের  ঘুম ভেঙ্গে যায়।  চকিতে তারা বুঝতে পারে তাদের ইহকালের বিচ্ছেদ ঘরের দুয়ারে অপেক্ষা করছে।  তারা স্মরণ করে তাদের সেই প্রতিজ্ঞার কথা , জীবনে মরণে তারা কখন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হবেনা। মুহূর্তের মধ্যে তারা পরস্পরের হাত ধরে গভীর খাদের প্রান্তে এসে ঝাঁপ দেয় অতল গহ্বরে।

বলতে বলতে গগন লামার গলা ধরে এলো।  কেন যে মানুষে মানুষে এতো প্রভেদ, সম্পদের জন্য মেকি গর্ব , স্বরটা অনেকটা স্বগোক্তির মতো শোনাল।

-রবীন মজুমদার 



  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল