8. Che Guevara- the revolutionary Icon all the time (part I)


চে গুয়েভারা  দা রেভলিউশনারী আইকন অল  দ্যা  টাইম ।। ১থম  পর্ব 

Che Guevara Life Quote

আত্মকেন্দ্রিকতা অপরাধের নামান্তর। 

 ১৯২৮ সালে  আর্জেন্টিনায়  মধ্যবিত্ত  পরিবারে জন্ম নিল  এক শিশু, সে ধীরে ধীরে  বড় হয়ে উঠল  এক বামপন্থী ঘরানায়। গতানুগতিক জীবন তাকে কখনই  তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।   বহুমুখী পাঠ তাকে অনন্ত জিজ্ঞাসু করে তুলেছিল; তত্ত্ব আর বাস্তবের মধ্যে সঠিক ব্যবধান কতটা খুঁজতে? সংকীর্ণ চার দেওয়ালের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর  পাওয়া যাবেনা, তাই এই বিশাল আকাশের নিচে তার সেই অসীম প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালাল।   তিনি দেখলেন বলিভিয়ার টিন খনির শ্রমিকের সাথে চিলির তামা খনির শ্রমিকের কান্নার আওয়াজের কোন প্রভেদ নেই।  কিউবার আখক্ষেতের চাষির আর্তনাদের প্রতিধ্বনি  ব্রাজিলের কফি চাষীর বুকে কান পাতলে শোনা যায়।   এই মহাদেশের বাতাসে উড়ে বেড়ানো টুকরো টুকরো সংগৃহিত কোলাজ গুলি একত্রে সাজিয়ে নিয়ে তিনি দেখলেন যে এই মহাদেশের  সব  মাটির গন্ধই এক, বৈচিত্র শুধু অলঙ্কারে, তাদের কারোর নাম পেরু, কারও নাম বলিভিয়া, কেউ বা হাইতি আবার কেও বা অন্য কোন নাম ভূষিত। কিন্তু , সব কিছুকে ছাপিয়ে সিমন  বলিভারের সেই উক্তিটি কানে বাজছে - স্বৈরাচার যেখানে আইনের মোড়কে থাকে, দ্রোহ সেখানে মানুষের জন্মগত অধিকারে পরিণত হয়। 

পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ সমৃদ্ধ হয় কুশি লবের আগমনে ,  জাগতিক নিয়মেই তার আসা যাওয়া, কেউ তার খবর রাখেনা ,  এই আসা যাওয়ায় হচ্ছে প্রকৃতির  অমোঘ নিয়মে বাধা। ইতিহাস বড়ই কৃপণ সহজে  কাউকে জায়গা দেয়না।  কেননা  প্রকৃতি ইতিহাস তৈরি করে না , যুগে যুগে মানুষই  ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  অবশ্যই  তা মানব  জীবনের ধারাবাহিক কর্মের ভিত্তিতে। 

বিগত শতাব্দীতে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যক্তিত্বের মধ্যে নিঃসন্দেহে অনন্য ব্যক্তিত্ব  হচ্ছেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। যিনি জীবনের সীমাবদ্ধতাকে  অতিক্রম করে নিজেই একটি  প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। তার  সুউচ্চ জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনাকে একান্তই স্বল্প পরিসরে সাজিয়ে নিয়ে উপরের দেয়া নামকরণের  প্রতি সুবিচার করার  একটা চেষ্টা করছি। 

মাতৃভাষা যদি জাতীয়তাবোধ গঠনের অন্যতম মাপকাঠি হয়, ল্যাটিন আমেরিকার দেশ গুলিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে বা ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে যতই মানচিত্রে তার স্বাতন্ত্রতা ফুটিয়ে তোলা হোক না কেন আদতে  সেখানে সমগ্র মহাদেশটাই হয়ে যায়  মাতৃভূমি।   এই-ই  হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার বৈশিষ্ট। এই মহাদেশের বিবর্তনের ইতিহাসটা একটু পিছনে তাকিয়ে দেখা যাক।পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে  দেখা যায় সভ্যতা বা সংস্কৃতির সাথে অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। অর্থনীতির দ্বারা সবই পরিচালিত।  সবই খুঁজে নিতে হবে। 
মায়া সভ্যতার নিদর্শন 
খ্রিস্ট পূর্ব ২০০০-২৫০ অব্দ  পর্য্যন্ত  মায়া সভ্যতার সময়কাল। এই সভ্যতা  বিস্তার লাভ করেছিল মধ্যে মেকক্সিকো থেকে  হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া ,গুয়েতেমালা,  সালভাডোর অঞ্চল পর্য্যন্ত। প্রায় ২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্য্যন্ত মায়াদের শ্রেষ্ঠ যুগ বলা হয়, তাই এই সময়কে বলা হত ধ্রুপদী যুগ । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয়দের আক্রমনে তাদের ধ্রুপদী যুগের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তার  সমাপ্তি ঘটে।
কারাল সভ্যতা

প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে গড়ে উঠা মধ্য পেরুর "নড়তে চিকো"  বা কারাল সভ্যতা। প্রাচীন মিশরের পিরামিডকে মনে করিয়ে দেয়।  আন্দিজ পর্বতের সুউচ্চে অবস্থিত বর্তমান পেরুর রাজধানী লিমার কাছে "চাভিন সভ্যতার " নির্দশন পাওয়া যায় আনুমানিক খ্রিস্টজন্মের ৯০০ বছর পূর্বেকার । মোচে  সংস্কৃতি - পেরুর উত্তর দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের নিকট মোচে ও তরুহিলিও শহরের কাছে   এই সংস্কৃতি গড়ে উঠে।  কৃষি ভিত্তি সংস্কৃতি , এই অঞ্চলের হস্ত শিল্প বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ইনকা সভ্যতা

১২০০ সালে পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা ইনকা সভ্যতা নামে পরিচিত যার একটি বড় অংশ পেরু, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও চিলির একটি বড় অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল । শেষ ইনকা শাসকের ১৫২৭ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত  শাসন করেছিলেন।


আজটেক সভ্যতা

আজটেক সভ্যতা : ১৩০০ থেকে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দ পর্য্যন্ত এই সভ্যতার সময়কাল। প্রাচীন আজটেক সাম্রাজ্য পাহাড় ঘেরা ভলকানো উপদ্রুত অধুনা মেক্সিকো উপত্যাকায় অবস্থিত।  শিল্প ও সাহিত্যে মায়া সভ্যতা আজটেকের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে ছিল। ১৫২০-২১ সালে য়ুরোপীয়ানরা দক্ষিণ আমেরিকায় অনুপ্রবেশের সাথে সাথে এই সভ্যতার অবলুপ্তির শেষ সীমায় এসে পৌঁছায়।  উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হল ইউরোপিয়ানরা তাদের আগমনের সাথে বহন করে নিয়ে আসে মরন ভাইরাস স্মল পক্স যা পরবর্তী সময়ে মহামারী আকারে আনুমানিক দুই লক্ষাধিক স্থানীয় মানুষের মৃত্যুর  কারন হয়ে দাঁড়ায়।

মহা সাগর আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটি ভূখন্ড যা আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের  চতুর্থ বৃহত্তম মহাদেশ। সেখানে  আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম আন্দেজ পর্বতমালা , বিস্তীর্ণ আমাজন নদী ও  তার দীর্ঘতম রেনফরেস্ট , আটাকামা  মরুভূমি আর আছে অফুরন্ত বনজ ও  খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ  আর পশু পালনের জন্য উপযুক্ত বিস্তীর্ন অঞ্চল। 


Politcal Map of South America


উত্তরে ক্যারাবিয়ান সাগর, উত্তর পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর আর দক্ষিণে আতলান্তিক মহাসাগর । পৃথিবীর মানচিত্রে , সবার উপরে কানাডা, তারপরে উত্তর আমেরিকা, ঠিক তার নিচে মেক্সিকো  তার পরে ক্যারাবিয়ান সাগর  এবং ঠিক তার পাশে কিউবা, জামাইকা,  পোর্টরিকো ইত্যাদি দ্বীপগুলি 

ষোলশ শতাব্দীতে ইউরোপ মহাদেশ থেকে মূলতঃ স্পেন ও  পর্তুগাল থেকে অধিবাসীরা দক্ষিণ আমেরিকায় পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে  শুরু  করে । পত্তন হল এক নতুন উপনিবেশের ।শুরু হল এক বর্ণশংকর প্রজাতির।  ল্যাটিন ভাষা ইউরোপের ভাষার জননী এবং এই ঔপনিবেশিক ভাষা পরবর্তী সময়ে ইনকা যুগের সমৃদ্ধশালী  কুয়েচুয়ে ও অন্যান্য ভাষাকে  পিছনে ফেলে এই মহাদেশের অধিকাংশ জায়গায় সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে স্প্যানিশ এবং  দক্ষিন আমেরিকা "ল্যাটিন আমেরিকা" নামে পরিচিত লাভ করে। 


দীর্ঘ সশস্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্পেনের উপনিবেশিক শাসন থেকে ল্যাটিন আমেরিকা নিজেকে মুক্ত করে।  এই দেশগুলি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন অধিকাংশে মার্কিন যুক্তরাষ্টের হাতে ছিল। ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনত্তোর দেশ গুলিতে অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা , বৈদেশিক শক্তির  ডলার নৃত্য  সাধারণ মানুষ এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে এক অসহনীয় অবস্থার মধ্যে চলতে  হয়েছিল। 

মহাদেশ জুড়ে সামরিক , অসামরিক রাষ্ট্র নায়কের একই চেহারা।  শোষণ আর অত্যাচারের চেহারাটা একই রকম। ব্যবধান নেই আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রনায়ক পেরান-এর সাথে কলম্বিয়ার পিনিল্লার , ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রনায়ক পিরেজ জিমিনেজের সাথে হাইতির দ্যুভালিয়ের, কিউবার বাতিস্তার সাথে বলিভিয়ার রেনী বারিয়েন্তোসের ইত্যাদি আর এই সবের নেপথ্যে আছে মার্কিনিদের " এলায়েন্স ফর প্রোগ্রেসের " নামে এই মহাদেশে অবৈধ রাষ্ট্র নায়কদের প্রতিপালন, ধনতন্ত্রের বিকাশ। 


প্রথম মহাযুদ্ধের ঘোর থেকে বিশ্ব তার আচ্ছন্নতাকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি , মার্ক্সীয় দর্শনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সোভিয়েত বাশিয়ায়  লেলিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠার ডাক ধনতান্ত্রিক দুনিয়াকে ভীষণভাবে অসহায় করে তোলে।  নিজ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ধনতন্ত্র তার গণতন্ত্রের খোলস থেকে বের হয়ে নখ দাঁত বের করে স্বমহিমায় তার ভাস্বর হয় ।


এমনিই এক সময়ে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা  আর্জেন্টিনার এক বামপন্থী পরিবারে  জন্মগ্রহল করেন।  মধ্যবিত্ত সংসারের  পাঁচ সন্তানের মধ্যে আর্নেস্তো ছিলেন বড়।  শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে পরিবারের কাছ থেকে  মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে।  চে'-র ক্ষেত্রেও  তার ব্যতিক্রম হয়নি। বামপন্থী ঘরানায় বেড়ে উঠায় তার রাজনৈতিক চেতনাকে প্রভাবিত করেছিল বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিতে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণে জর্জরিত ল্যাটিন আমেরিকান  সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র সীমার নিচে ,এই  শ্রেণী বৈষম্য  চে'কে  ভীষণ ব্যথিত করে তোলে। 

জীবনের শুরু থেকে হাঁপানি ছিল তার নিত্য সঙ্গী।   তিনি খেলাধুলার সর্বক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার প্রমান দিতে গিয়ে কখনই ফুসফুসের অসহযোগিতাকে  মানসিক জোরের উর্ধে স্থান দেননি ।  তা হোক না সেই খেলা  মল্যযুদ্ধ  বা সাঁতার বা সাইক্লিং বা ফুটবল বা রাগবি। 

বাড়িতে প্রায় তিন হাজারের উপর বই , চে'-কে করে তুলেছিল জ্ঞানের  পিপাসু। তার মনকে নাড়া দিয়েছিল রোমান্টিক কবি   জন  কিটস , চিলির  কবি ও  কূটনীতিক পাবলো নেরুদা , বিশ্ববন্দিত "জনগণের  কবি" , নাট্যকার,  ফেডেরিকা গার্সিয়া লোরকা , নোবেল জয়ী  নারীবাদী আন্দোলনের পুরোধা  ল্যাটিন আমেরিকার কবি গাব্রিয়েলা মিস্রাল , ওয়াল্ট হুইটম্যান, নোবেল জয়ী সাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার, ইতালিয়ান সাহিত্যিক এমিলিও সালগারি , নোবেল জয়ী সাহিত্যিক এবং ফ্যাসিত বিরোধী বুদ্ধিজীবী আন্দোলনের পুরোধা আলবেয়ার কামু , রবার্ট ফ্রস্ট, জহরলাল নেহুরু , কার্ল  মার্ক্স্ এবং লেনিন, অশেষ আগ্রহ ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম থেকে বুদ্ধের উত্তরণের কাহিনীর।কৈশোর থেকে যে জ্ঞান আরোহনের আকাঙ্খা তার মৃত্যুর শেষ দিন পর্য্যন্ত এক ভাবেই প্রবাহবান ছিল। ক্রমেই চে একজন মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

১৯৪৮ সালে চে গুয়েভারা বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা  বিভাগে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হন। চঞ্চলতা চে-'র জীবনের এক জন্মগত বৈশিষ্ট ছিল ।  ডাক্তারি পড়াশুনা চলাকালীন ১৯৫১ সালে এক  বছরের বিরতি দিয়ে তার শুরু হল ল্যাটিন আমেরিকা পরিক্রমা। যান হিসাবে বেঁচে নেওয়া হল মোটর সাইকেলকে সঙ্গে সহযাত্রী হল বন্ধু আলবার্তো। এই যাত্রার মুখ্য  উদ্যেশ্য ছিল পেরুর লেপার কলোনিতে কুষ্ঠ রোগীদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করার। এদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তিনি অবিভূত হলেন তাদের সহ-মর্মিতা দেখে, আবার মাচু পিচ্চু  যাত্রাপথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের  দারিদ্র তাকে  ভীষণ মর্মাহত  করল। তিনি লিখলেন তার বিখ্যাত ভ্রমন বৃত্যন্ত "মোটর সাইকেল অভিযান" , এর প্রতিটি ছত্রে তার বর্ণনা দেওয়া আছে। আর্জেন্টিনা,চিলি,পেরু ,ইয়াকাডুর , কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা , পানামা ও মিয়ামির মধ্যে দিয়ে  বুয়েন্স আয়ার্সে এসে তার দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হল।

ই দীর্ঘ পরিক্রমা চে -কে এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি  এনে দাঁড় করাল , শোষণ, অত্যাচার, দারিদ্রের চেহারাটা কোন ভৌগলিক সীমারেখার দ্বারা  আলাদা করা যায় না, বরং  সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে একই  চিত্র  বিদ্যমান তা তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলেন । 

তিনি দেখলেন, ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থার আতিশয্য।  এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত  যার প্রকৃত রূপটি হচ্ছে কৃষি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা, এবং তার পাহারাদার হিসাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা। অবশ্যই তার পিছনে কোন গন সমর্থন ছিলনা। রাষ্ট্রযন্ত্রের পাহারাদারেরা ব্যস্ত থাকত, যে কোন মূল্যে গন-আন্দোলনকে প্রতিহত করার  আর শ্রমিক আর কৃষক  শ্রেণীকে  ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট ও বড় মহাজনের অত্যাচারে  সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল ।

পৃথিবীতে এমন একদিন ছিল যখন বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব ছিল কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের কল্যানে সেই খণ্ডিত রাষ্ট্র গুলি এক অখন্ড রূপের দিকে এগিয়ে যায়। অন্তর্দেশে একটি ঐক্যবদ্ধ প্রকাশভঙ্গি  অবিশ্বম্ভাবী হয়ে  উঠে। তার প্রকাশ  অর্থনীতির ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং সংকৃতির ক্ষেত্রে তার সার্থক  প্রতিফলন হয়। 

চিরকালই, মানুষের সাথে মানুষের আচরণ, ন্যায়বোধ, সংকৃতিবোধ  ইত্যাদিগুলি অর্থনীতির লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হতো , আজও তাই হচ্ছে, তখন তাই হতো। কোন দিনই সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতে মানব সভ্যতার ইতিহাস সৃষ্টি হয়নি , আজও  হচ্ছেনা।  এটা গড়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রয়োজনের ভিত্তিতে অতএব সভ্যতা , সংস্কৃতি ও অর্থনীতি  বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

চে- তার অভিজ্ঞতা থেকে দেখলেন যে, এখানে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল অধিকার ভোগী শ্রেণীর অধিকারগুলিকে রক্ষা করা। ল্যাটিন আমেরিকার নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই মহাদেশের  পুতুল সরকারগুলিকে  "এলায়েন্স ফর প্রোগ্রেসের"  নামে সামরিক এবং আর্থিক অনুদান দিয়ে যাচ্ছে তার বিনিময়ে পুঁজিবাদের বীজকে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত  করছে। এখানে ভীষণ লক্ষণীয় হচ্ছে যে, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন একটা সমাজব্যবস্থার  সৃষ্টি করেছে, যার ফলে মানুষের কোমল বৃত্তিগুলিকে অপহরণ করে মানুষের সাথে পশুর প্রভেদটা অনেকাংশে ঘুচিয়ে ফেলেছে। সব অসামাজিক কাজ কর্মের পিছনে রয়েছে মানুষের দ্বারা মানুষের সৃষ্ট অভাব , আর এই অভাবকে সৃষ্টি করেছে ধনতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী অব্যবস্থা। কাজেই মনুষ্য চরিত্র ধংসকারী এই অর্থনীতি ও এই রাজনৈতিক ব্যাবস্থার  হাত থেকে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকাকে বাঁচাতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার থেকে উদ্ভূত  সাম্রাজ্যবাদকে  বিলোপ করে সমাজবাদী সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা।

মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদের উপর গভীর আস্থা, আর ল্যাটিন আমেরিকা তথা সমগ্র বিশ্বে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে সফল করার প্রতিজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে চে গুয়েভারা ১৯৫৩ সালে আবার নিরীক্ষণ করতে চললেন বলিভিয়া থেকে পেরু , সেখান থেকে ইকুয়েডর, তারপর পানামা ,  সেখান থেকে কোস্টারিকা , নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস তারপর সালভাদর।

মার্ক্সসীয় দর্শনের একান্ত অনুরাগী,দ্বন্দ মূলক বস্তুবাদের নিরন্তর পাঠক আর্নেস্তো, কোন বস্তুকে বিশ্লেষণের পিছনে তার যুক্তিবাদী মন কাজ করত। মেডিক্যালের ছাত্র হিসাবে যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে শুধুমাত্র ডাক্তার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ক্ষান্ত হননি। মৌলিক গবেষণার জন্য আর্জেন্টিনার নামজাদা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড: সালভাদোরে নেতৃত্বে কাজ করেন।  এলার্জির  উপর আর্নেস্তোর লেখা আর্টিকেলটি  গুণীজন দ্বারা  বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়। নিকটজনদের আগ্রহ ছিল কবে আর্নেস্তো এক জন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার হিসাবে প্রচুর অর্থের অধিকারী হবে।এতদিনে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ব্যাকটেরিয়ার অনুসন্ধান করে এসেছেন, এর পাশাপাশি  গভীর অন্তর দৃষ্টি দিয়ে   ল্যাটিন আমেরিকায় শোষনের বাস্তব নগ্ন রূপ প্রত্যক্ষ করছেন। প্রতিনিয়ত তাকে বিদ্ধ করত  প্রতিকার না করতে পারার যন্ত্রনায় । অশান্ত মন, কাজই একমাত্র তার সমাধানের উপায়। অন্তরের টানে তিনি চললেন মুক্তি সংগ্রামের  হাতছানিকে অনুসরণ করে সেই পথের সন্ধানে। 

   আর্জেন্টিনার মসনদে পেরন আসীন। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে শ্ৰেণী সংগ্রামের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় যখন তিনি মগ্ন, তখন গেস্টাপো বাহিনী ব্যস্ত চে গুয়েভারাকে আন্দোলনের মধ্যে থেকে উদ্ধার করতে। বিপদের গন্ধ আর চাপা থাকেনি, অতএব দেশত্যাগের বিকল্প  না থাকায় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বলিভিয়ার এসে উপস্থিত হলেন। অস্থির, ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক পরিমন্ডল।  সেখান থেকে কলম্বিয়া, শুরু হয়েছে  গৃহযুদ্ধ, চে'-র আস্তানা এখানে শ্রমিক বস্তিতে, অচিরেই রাষ্ট্র যন্ত্রের এক্স রে তলায় চে' র প্রতিচ্ছবি, এবার গন্তব্য স্থল গুয়েতেমালা।


Gadea Acosta

হিলদা গেদে  এবং চে গুয়েভারা 


গুয়েতেমালায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন  প্রগতিশীল রাষ্ট্র প্রধান  আরবেঞ্জ। এখানেই চে গুয়েভারার সাথে পরিচয় হয় পেরুভিয়ান ইকোনোমিস্ট ও কমিউনিস্ট নেত্রী হিলদা গেদের সাথে এবং পরবর্তী সময়ে চে'র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।   কিষান ও শ্রমিকের আন্দোলন এখানে এক অন্য্ মাত্রা পেয়েছিল।  বস্তুত আনন্দোলনকে দাবি-দেওয়ার মধ্যে   সীমাবধ্য না করে শ্রমিক-কৃষককে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উপর বিশেষ জোর দিলেন আর্নেস্তো।  রাজনৈতিক আদর্শ ও শিক্ষা ব্যতিরেকে পরিবর্তনের কারিগরদের  মানসিক গঠন তৈয়ারী হয়না। 

আর্নেস্তোর ভূমি সংস্কার নীতির বৈজ্ঞনিক  ব্যাখ্যা আরব্যাঞ্জ সরকার কতৃক প্রশংসিত হয় এবং তার ফলশ্রুতিতে  টলিয়ে দিয়েছিলো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি ইউনাইটেড ফ্রুটস কোম্পানির ভিত। সাম্রাজ্যবাদীর শ্যেন দৃষ্টি বিশেষভাবে নিবদ্ধ  হল গুয়েতেমালার উপর। মার্কিনিরা যা বরাবর করে এসেছে তাই এখানে করলো ,কাস্তিল্লোকে  পরবর্তী শাসক হিসাবে সাজিয়ে গুছিয়ে  নিয়ে পার্শবর্তী দেশ হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়াকে পর্যাপ্ত সামরিক সম্ভারে সাজিয়ে দিল। গণতান্ত্রিক সরকারকে মূল্য দিতে হল অভ্যন্তরীন সংস্কারের। বৈদেশিক শক্তির  স্বার্থহানীকর পদক্ষেপের  জন্য দেশটাকে  জলাঞ্জলি দিতে হল তার সর্বভৌমিকত্বকে।  অতর্কিতে আক্রমনের প্রত্যুতর দেওয়ার মতো কোন পরিবেশ ছিলনা, বাধ্য হয়ে আরবেঞ্জ ও তার পরিষদ বর্গ বৈদেশিক দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করল এবং চে গুয়েভারাও আশ্রয় নিল দূতাবাসে। মার্কিন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ.-র বিশ্বের তাবড়  সন্দেহজনক  ব্যক্তিদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করল আর্নেস্তো চে গুয়েভারার নাম।


Che Guevara quote: We have no right to believe that freedom can be won without struggle.



সংগ্রামই একমাত্র স্বাধীনতার বিনিময় মূল্য 


অখন্ড ল্যাটিন আমেরিকা, মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের সার্থক মেলবন্ধনে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা, সিমন বলিভারে অসমাপ্ত ল্যাটিন আমেরিকা গঠনের  স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ব্রত নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে পরিভ্রমন করে চে গুয়েভারা  অবশেষে এসে পৌঁছালেন  চারণভূমিতে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের, যার সাক্ষ্য এখনও পৃথিবী বহন করে চলছে। দেশটা হল মেক্সিকো, অজান্তেই কত বিপ্লবীকে স্থান দিয়েছে এই দেশটা ।  তার পরিচয়টা প্রাথমিক ভাবে ছিল টুরিস্ট।  পরবর্তী সময়ে তার হিউমান ক্যাপিটালের  জোরে কার্ডোলজি ভবনে চাকরি করতে শুরু করেন। তার কর্ম সীমিত  ছিল মানুষের হৃদযন্ত্রের গতি-প্রকৃতির অবস্থা নির্ণয় করার মধ্যে কিন্তু তার ধর্ম হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার অগণিত নিপীড়িত মানুষের নিত্য মনুষ্যত্বের  মৃত্যুর  মিছিলের বাস্তবসম্মত প্রতিকার। এইসব ভেবে ড: চে গুয়েভারাকে ভিতরে ভিতরে প্রতিনিয়ত দংশন করে যাচ্ছে আর খুঁজে ফিরছে পথের দিশা।

স্বার্থহীনতা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, আপামর শোষিত মানুয়ের মুক্তির সংগ্রাম এবং পরিবর্তন সম্পর্কে    বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে চলার পথের মন্ত্র, সেখানে তার লক্ষ্য পূরণ, শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা।  আদর্শের আর  কর্ম যেখানে একই সমান্তরাল রেখায় মিলিত হয়, সেখানে জন্ম হয় নতুন সুরের, নতুন দিশার।  জন্ম নিল কিউবার বিপ্লবের রূপরেখা। মিলন হল এই মহাদেশের দুই রূপকারের অভিন্ন আত্মার, ফিদেল কাস্ত্রো আর আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। যখন ফিদেলের কাছে  যখন  কাটায় বিদ্ধ এক বন্ধুর পথ , তখন চে'র  অধ্যাবসায়  তা  মসৃন, কখনও ফিদেলের  কাছে পূর্ণিমা রাতের চাঁদকে দেখে মানে হয়  এক রোমান্টিক কবিতা,  তখন চে'-র কাছে চাঁদ এক ঝলসানো রুটি , যেখানে ফিদেলের ভাবনার পাখিটা পথ হারিয়ে শুকনো ডালে  বিশ্রাম চায়  আর ঠিক তখনিই চে'-র মেশিনগানের গুলির আওয়াজ  সম্মিলিত পাখির গম্ভীর স্বরের আওয়াজ তুলে শত্রূকে বাধ্য করে পিছু হঠতে।  ক্রমেই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠে।

১৯৫২ সাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্নেহধন্য সামরিক কুশলী, একনায়ক  ফুলজেন্সিও বাতিস্তা কিউবার রাষ্ট্রপতির পদটি অলংকৃত করেন। একনায়কেরা যেভাবে  বিদেশী প্রভুর বন্দনা করে থাকেন বাতিস্তা  খুব যত্ন করে তা পালন করতে শুরু করলেন। প্রভু বন্দনা আর প্রজা পালন একই সাথে চালান যায়না তাই  প্রথমেই ১৯৪০ সালের সংবিধান অনুযায়ী স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে রদ করলেন। ধনতান্ত্রিক  সমাজব্যবস্থার  অপর একটি চরিত্র হল পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য  তাদের শ্রমিক-কৃষকের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার অনৈতিক এবং বেআইনি কাজকে মান্যতা দেওয়া। তাছাড়া, ধনতন্ত্র ডেকে আনে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।  

মূলতঃ আখ উৎপাদন কিউবার অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি,  অধিকাংশ জমি ও চিনি কলগুলি মার্কিনি সংস্থার হাতে। উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি  দরিদ্র  চাষীরা হত  দরিদ্র হল।  মার্কিন দালালদের সহযোগিতায়  মাদক, ড্রাগ , বেশ্যা বৃত্তি ক্রমান্বয়ে লাভজনক ব্যবসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হল। চারিদিকে গন অসন্তোষ সরকারকে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলল। বাতিস্তার গোপন বাহিনী দিশেহারা হয়ে খুঁজতে শুরু করলো কমিউনিস্টদের, প্রেসের স্বাধীনতা হরন করা হল।   



সশস্র সংগ্রামের দামামা বেজে উঠেছে।  মানসিক প্রস্তুতি গঠনের   নকশা  ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে।এখন দরকার তার সঠিক রূপায়ণ। বিজয়ের সৌধ নির্মাণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, প্রশিক্ষিত কারিগর আর রসদ। সবটাই জোগাড়   হল, বাকি রইল   গেরিলা যুদ্ধের রণ কৌশল ও তার উপযুক্ত তালিম। তার  জন্য বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এয়ালবার্টো বেয়োর শরণাপর্ণ হল বিপলবীরা। অকুণ্ঠ সমর্থন,  আন্তরিকভাবে তিনি আগামী দিনের কিউবার বিপ্লবীদের গেরিলা রণনীতির প্রশিক্ষণ দিতে  শুরু করলেন। মেক্সিকোর  শহর থেকে বহুদূরে জনমানব শূন্য চালকোতে চলল একনাগাড়ে প্রশিক্ষণ। শিক্ষক বেয়োর কাছে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ তারা তিন মাসে রপ্ত করলেন,  দিনে ১৫ ঘন্টার অনুশীলনে। 

একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে একজন সৈনিককে কি ধরনের  পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এবং তার সমাধানের সম্ভ্যাব্য উপায় কি কি , যেমন একটি হাত বোমা তার বহুবিধ ব্যবহার পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে  শত্রুর ঘাঁটিকে ধংস  করা যায় , ট্যাঙ্ককে কি করে অকেজো করা যায়, যুদ্ধ বিমানকে কি ভাবে মাটিতে নামিয়ে নিতে হয়,বিদ্যুৎ গতিতে  শত্রূর ঘাঁটিতে আক্রমন করে,তাদের ক্ষয়ক্ষতি করে, তাদের নিশানার বাইরে চলে যেতে হয়,  কিভাবে স্মোক বোমা দিয়ে ধুয়ার আবরণ তৈয়ারী করে আহত সহকর্মীকে বিরুদ্ধ পক্ষের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে আনতে  হয় , শত্রূপক্ষের আক্রমনের লক্ষ্যকে  কি ভাবে বিপথে চালিত করতে হয় - এই শিক্ষাগুলি কর্নেল  বেয়োর কাছে প্রায় ৮০-৮২ জন বিপ্লবী ভীষণ যত্ন সহকারে গ্রহণ করলেন।

এই গেরিলা যুদ্ধ বিপরীত পক্ষের অত্যাধুনিক  উন্নতমানের অস্ত্রের কাছে আপাতদৃষ্টিতে মূল্যহীন মনে হলেও, পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবীদের এই যুদ্ধের সার্থকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে রাশিয়ার লেলিন, ভিয়েতনামের ভো  নগুয়েন  গিয়াপ , চিনে মাও সে তুং এই গেরিলা রণনীতিকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিরুদ্ধের শক্তিশালী ও আধুনিক অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত সৈন্যবাহিনীকে বার বার হতোদ্দম করে দিয়েছিলেন, ইতিহাস তার সাক্ষী।


পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবী বাহিনীর সাথে সাম্রাজ্যবাদী  শক্তির ভাড়াটে সৈন্য বাহিনীর মৌলিক ব্যবধান হচ্ছে আদর্শে অবিচল থেকে সাধারণ মানুষকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার আত্মিক দায়বদ্ধতা। বিপ্লবীদের কাছে সেই গুপ্তধনের সন্ধান আছে যার লক্ষ্যে সিদ্ধার্থ ছেড়েছিলেন পার্থিব বৈভব, যীশুকে বরণ করতে হয়েছিল ক্রশের   মালা আর তারা অর্জন করেছিল সেই অমূল্য সম্পদকে।  কিন্তু অন্য  দিকে আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে অত্যাচারী শাসকের পতাকা বহন করে চলা  দিকভ্রান্ত সৈনিক প্রতিনিয়ত মৃত্যুর পদধ্বনি অনুভব করে।  তাই পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় প্রায় সহস্র ভাড়াটে সৈনিক পিছু এক জন গেরিলা বা মুক্তি সংগ্রামী লড়াই চালিয়ে গেছে এবং জয় লাভ করেছে।

যুগ যুগ  ধরে মাটি ও গাছ একে  অন্যের পরিপূরক হিসাবে তাদের অস্তিত্বকে  বজায় রেখে  চলছে। এটাই জগতের নিয়ম ; গাছ যদি মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে সে আর বাঁচতে পারেনা।  ঠিক তেমনি মাটি হচ্ছে জনসাধারণ আর বিপ্লবী সংগঠন হল গাছ।  জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তেমনি বিপ্লবী সংগঠন বাঁচতে পারেনা ; আলো আর বাতাস হচ্ছে আপামর শান্তিকামী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। তাই এই যুদ্ধ হচ্ছে মানসিক ভাবে প্রস্তুত সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিদের সাথে এক বিপরীত শক্তির মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।

মেক্সিকোর শাসকের নজরে  পরে যায় গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি।  বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কিউবার বিপ্লবীর সারা  মেক্সিকোতে  ছড়িয়ে পরে। ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাস, আজ আর প্রতীক্ষা, অনুশীলন নয় এখন কিউবার ফুলজেন্সিও বাতিস্তার রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ন হয়ে স্বৈরাচারী  শাসনের সমাপ্তির কাজটা ত্বরান্বিত করতে,  মেক্সিকোর উপকূলে কিউবার বিপ্লবীরা একত্রিত হয় তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।   সামরিক সরঞ্জাম , রসদ এবং বিপ্লবীদের নিয়ে "গ্রানমা " নামক এক রণতরী করে কিউবার অভিমুখে যাত্ৰা শুরু করলো। চে গুয়েভারা-র অভিষেক হলো  এই বাহিনীর ডাক্তার হিসাবে ।

১৯৫৩ সালের ২৬শে  জুলাই মাত্র ১৫০ জন বিপ্লবী কাস্ত্রোর নেতৃত্বে মানকাডা দুর্গ আক্রমন করে, তারপর যা যা হয়েছিল এখন তা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। বিপ্লবীদের নিয়ে কিউবার উপকূলে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়ে  ছোট্ট রণতরীটি হাপিয়ে  উঠছে।  সমুদ্র ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে , তার পরে আছে বাতিস্তার সেনাদের অতন্দ্র প্রহরা। ইস্পাত কঠিন বিপ্লবীদের মানসিক প্রস্তুতি, জিতব না হলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব।

১৯৫৬ সালের ২রা ডিসেম্বর, গভীর রাতে, রণতরীটি কিউবার  উপকূল থেকে বেশ দূরে পথভ্রষ্ট হয়ে একটা মেছো ভেড়ির দলদলে মাটিতে আটকে গেল। ভোরের আলো  ফুটবার আগে যতখানি রসদ  উদ্ধার করা যায় বেশ দ্রুততার সঙ্গে সরানো হোল, অধিকাংশই রয়ে গেল জাহাজে।
সিয়েরা মায়েস্রা


বাতিস্তার সৈন্যবাহিনীর  মেশিনগানের গুলি বিপ্লবীদের অভ্যর্থনার  জন্য যেন প্রস্তুতই  ছিল । হতাহত হল অধিকাংশ বিপ্লবী।   বিমান থেকে বোমা বর্ষণে ধংস হল গ্রানমা রণতরী। বহু রক্তস্নাত পথ অতিক্রম করে যখন সিয়েরা মায়েস্রার বন্য ঝোপে বাতিস্তার বাহিনীর থেকে নিজেদের আড়াল করতে সক্ষম হল, তখন দেখা গেল ৮১ জন অভিযাত্রীর মধ্যে ফিদেল, চে গুয়েভারা ও রাউল কাস্ত্রোকে বাদ দিয়ে মাত্র ৯ জন জীবিত আছে।

বিপ্লবীরা হল মানবজাতির এক উন্নত বীজের অধিকারী যাদের বিন্দু বিন্দু রক্ত থেকে অংকুরিত হয়ে কত বিপ্লবীর জন্ম দিতে পারে তার পূর্বাভাস গাণিতিক নিয়মের বাধা ধরা ছকে নির্নয় করা যায়না।১২ জন বিপ্লবী আর চল্লিশ হাজার বাতিস্তার সেনা বাহিনী ।গাণিতিক মান ১ জন  বিপ্লবী পিছু ৩৩০০ জন সৈনিক। ধীরে ধীরে কৃষক, ছাত্র , যুবক, সাধারণ মানুষ  প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণে সারা কিউবার কোনে কোনে আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে।

কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রাম , জঙ্গলে যেখানে শত্রূ  অনুপস্থিত সেখানে শত্রূর জায়গা দখল করে আছে সাংঘাতিক মশার দল। বিপ্লবীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরে  একের পর এক স্থান দখল করে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করছে ।  স্থানীয় মানুষদের নিয়ে  গঠন করছে ছোট ছোট ইউনিট যেখানে শুরু করছে পঠন -পাঠনের  আর ক্ষুদ্র শিল্পের  কেন্দ্র। পাশাপাশি চলছে পুনর্গঠনের কাজ। কোথাও শত্রূর অঞ্চলে ধংস আবার সেই অঞ্চল বিপলবীরা দখল করে  অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে নিয়ে তার নব নির্মাণ। এই ভাঙা গড়ার খেলাটা চে গুয়েভারা নিজেই দেখাশুনা করতেন অবশ্য এটা ছিল গেরিলা রণনীতির অঙ্গ।  

একের পর এক আক্রমন, শত্রূর ঘাঁটি ধংস করা, অস্ত্র, রসদ সংগ্রহ করে আবার মূল স্রোতে ফিরে আসা। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ কোথাও সক্রিয় কোথাও নৈতিক সমর্থনের জোয়ারে বাতিস্তা সরকারের বিদায় ঘন্টাকে ত্বরান্বিত করে তোলে। সারা বিশ্বে এই আন্দোলনের ঢেউ ছাড়িয়ে পরে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে শক্ত হয় বিপ্লবীদের হাত। চে গুয়েভারার নেতৃত্বে একের পর এক ঘাঁটি, শহর বিপ্লবীশক্তির করায়ত্ব হয়। ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা কিউবা থেকে পালিয়ে যান। 


ক্রমশঃ 




.




























মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২১০ ) ঝড়-বৃষ্টির একাল সেকাল