12. চে গুয়েভারা - সর্বকালের বিপ্লবী আইকন (চতুর্থ পর্ব )

 

চে গুয়েভারা - সর্বকালের বিপ্লবী আইকন (চতুর্থ  পর্ব )

[তৃতীয় পর্বে :  .কিউবার পুনর্গঠন ---- অর্থনীতি ---- জাতীয়করণ ----আন্তর্জাতিক সম্পর্ক - ]

চতুর্থ পর্ব 





বস্তুত চে-গুয়েভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রোর মধ্যে যে ব্যবধান ছিল তা হলো, চে ছিল মার্ক্সবাদের মৌলিক চিন্তাবিদ, সেখানে ফিদেল ছিল রাজনীতিজ্ঞ ও জাতীয়তাবাদী  নেতা।  প্রশ্ন হল, তিনি কি ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিদাতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। 

যেই সহযোদ্ধারা কিউবার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তার অবসান ঘটায় , পরবর্তী সময়ে কোল্ড ওয়ার শুরু হওয়ার বিগত দিনের সহকর্মীদের সাথে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা করল। 

চে গুয়েভারার ও ফিদেলের  দীর্ঘ ১২ বছরের বন্ধুত্বতা , যা কোল্ড ওয়ারের মাধ্যমে এক নতুন সমীকরণ তৈরি হলো।  সেই ১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে ফিদেল ছিলেন নির্বাসিত আর  আর্জেন্টিনার বিপ্লবী চে গুয়েভারার সাথে সাক্ষাৎ এবং সুদীর্ঘ আলোচনার সূত্রতায় মানসিকভাবে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠে। 

সালটা ছিল ১৯৫৬ সালের ৩১শে  জুলাই , মেক্সিকোর সুরক্ষা বাহিনীর হাতে ধারা পড়ল চে' ও ফিদেলসহ  অন্যান্য বিপ্লবীরা। চে গুয়েভারার মুক্তির বেশ কিছু আগেই ফিদেল মেক্সিকোর জেল থেকে মুক্তি পান।  চে গুয়েভারা ফিদেলকে  অবিলম্বে কিউবা অভিমুখে যাত্রা শুরু করার জন্য অনুরোধ করেন, কিন্তু ফিদেল তা অস্বীকার করেন। তাতে করে  চে গুয়েভারা ফিদেলের প্রতি বেশি করে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। 

দীর্ঘ যুদ্ধের পর বাতিস্তা বাহিনীর পরাজয় হয়।  ১৯৫৯ সালের, ১লা জানুয়ারী বিপ্লবী বাহিনীর বিজয়  ঘোষণার পরে ফিদেল এক সপ্তাহব্যাপী যাত্রা শুরু করেন হাভানার উদ্দেশ্যে, তখন তিনি যথার্থ রাজনীতিবিদের মতো অন্যান্য সহযোগী বিপ্লবীদের আড়াল করে নিজেই জনসমক্ষে এলেন। জানুয়ারী মাসের ৮ তারিখে ফিদেল হাভানা এসে পৌঁছালেন, সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন চে গুয়েভারা। অন্যান্য সঙ্গীরা   ফিদেলের ছায়ার আড়ালেই  রইলেন। 

 ১৯৬৪ সালে ফিদেল কাস্ত্রো চে গুয়েরাভাকে বিপ্লবের দূত হিসাবে কিউবার থেকে সরিয়ে দেন।  কারণ, চে গুয়েভারা মনে প্রাণে কমুনিজমের গোড়া সমর্থক, সে ক্ষেত্রে তিনি পৃথিবীর কোন শক্তিকে তোয়াক্কা করেন না। 

সোভিয়েতের সাথে ফিদেলের স্বার্থভিত্তিক সম্পর্ক , যে নাকি শুধুমাত্র কিউবা কেন্দ্রিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপামর স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রামের পক্ষে ইতিবাচক সাড়া মেলেনা , যা চে গুয়েভারার আদর্শের পরিপন্থী।  তাই তার কাছে এই সম্পর্কের কোন গ্রহণ যোগ্যতা ছিলনা, সেটাই ফিদেলের ভাবনার কারন হয়ে উঠে।    

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে স্বস্তি সোভিয়েত কিউবাকে দিয়েছিলো ১৯৬২ সালের মিসাইল সংকটের পর তো যে কোন মূল্যে কিউবা সোভিয়েতকে হারাতে চায়না। 

"আগামীদিনে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিউইয়র্কের নাম থাকবেনা "- চে গুয়েভারার এই উক্তিটি এবং তার ভাবনা চিন্তা সোভিয়েত রাশিয়ার রাজনৈতিক দৃষ্টির পরিপন্থী।  তার অবিশ্বম্ভাবী পরিণতি হিসাবে ফিদেলের সাথে চে গুয়েভারার দূরত্ব বাড়তে থাকে।    

১৯৬৫ সালের ২৪শে  ফেব্রুয়ারিতে, আফ্রো-এশিয়ান কনফারেন্স হয় আলজেরিয়াতে। সেখানে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে চে গুয়েভারা দ্ব্যর্থহীন ভাবে সোভিয়েতের সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা, সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর অহংকারে আঘাত লাগে , তার পরিপেক্ষিতে তারা অনবরত কিউবার উপর চাপ সৃষ্টি করে, চে গুয়েভাররার সাথে ফিদেলের দূরত্ব বাড়াতে। 

ফরাসি সাংবাদিক তথা কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব পীররে ক্যালফোন ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে ফিদেল কর্তৃক আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে অন্তরীণ করে রাখার সংবাদটা প্রকাশ করে , পরবর্তী সময়ে কিউবার বিপ্লবের অন্য এক সহযোগী যোদ্ধা ALACON RAMIREZ যিনি  "বেনিগনো" নামে  পরিচিত, তিনিও এই খবরের সমর্থন করেন। তাছাড়া তিনি ইতালির সংবাদপত্র "কোররিয়েরে  দেল্লা সেরাতে" আর্নেস্তো চে গুয়েভারার মৃত্যুর পর, তাকে এক চক্রান্ত হিসাবে বর্ননা করেছিলেন। 

আফ্রো-এশিয়ান সম্মেলন শেষে চে হাভানা ফিরে আসেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে অপহরণ করে এক নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়।  তার ঠিক ৪২-৪৩ ঘন্টার পর চে গুয়েভারাকে মুক্তো করা হয়।  বেনিগনো সে অবস্থার  বর্ননার প্রসঙ্গে বলেন, যে চে গুয়েভারাকে এমন বিধস্ত তিনি কখন দেখেন নি। 

১৯৬৫ সালের ১৪ই  মার্চে   ইউ. এস. ইন্টেলিজেন্স  এজেন্সী ঠিক শেষরারের মতো হাভানার ভেডেডো  অঞ্চলে চে গুয়েভারাকে তার  ২৯১২ নম্বর গাড়িতে দেখতে পারে।  

দীর্ঘ দিন চে ' কিউবার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন।  ১৯৬৫ সালের ৩রা অক্টোবর, চে গুয়েভারার অজান্তে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অপসারিত করা হয়। তিনি শুধুমাত্র  কিউবার  বিপ্লবে  নয় বিপ্লব  পরবর্তী দেশকে  পুনর্গঠনের অন্যতম কারিগর   হঠাৎ  তার  সবরকমের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেন। হয়ত বা পৃথিবীর অন্য্ কোন দেশে মানবতা বিপন্ন সাম্রাজ্যবাদী এবং একনায়কতন্ত্রের শক্তির কাছে। সেখানে ডাক এসেছে , তাকেই যে যেতেই হবে।  প্রথাগতভাবে হাভানা থেকে ফিদেল প্রচার করলো চে গুয়েভারার   বিদায়বার্তার চিঠি। 

বিশাল সমাবেশ, হাভানার চ্যাপলিন থিয়েটার হল,  সেখানে ফিদেলের হাতে চে গুয়েভারার চিঠি ; সাদা রঙের  লেফাফাটা খুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। বাংলা ভাষায় চিঠিটার তর্জমা করলে যা দাঁড়ায়। 

বন্ধু ফিদেল,

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রারম্ভে, আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল,  তোমার আর আমার প্রথম সেই মেক্সিকোতে সাক্ষাৎকার । দিনের পর দিন আমরা ব্যস্ত থেকেছি আমাদের আগামীদিনের  প্রস্তুতির  বাস্তব রূপ দেবার পরিকল্পনায়। স্বপ্ন ছিল, অভিজ্ঞতা ছিলনা, আদর্শ ছিল,আত্ম-বিসর্জনের দ্বিধা ছিলনা।  যুদ্ধে একদল যেতে, নয়তো  পরাজিত হয়, আমাদের কমরেডরা জানতে চেয়েছিল যদি যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ নিহত হয়, তবে কাকে সেই  খবরটা পাঠাতে হবে। ভীষণ বাস্তব,  পরবর্তী সময়ে আমরা এই কঠিন সময়ের সাথে একাত্ম হয়েছিলাম, এগিয়ে যাবার পথে বহু নির্ভরযোগ্য কমরেডদের আমরা হারিয়েছি। 

এই বিপ্লবের ছোট বড় অনেক ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। জীবন অভিজ্ঞতার পাঠাগার, তবুও বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই বিদায় মুহূর্তে, আমি একজন দায়িত্বশীল সহকর্মী হিসাবে, বলতে চাই ,তুমি আমাকে যে যে দায়িত্ব দিয়েছিলে, আশাকরি সে সব কর্তব্য আমি সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি।  আজ আমি  শারীরিকভাবে  হয়তো তোমাদের মাঝে থাকবোনা কিন্তু  তোমার  দেশবাসীর কাছ থেকে, আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে, সরকারি সব রকমের পদ থেকে, কিউবার নাগরিকত্ব থেকে  বিদায় নিলেও আমার অন্তরতম জায়গায় তাদের স্থানটি সদাই অমলিন থাকবে।
 
যে যাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম মেক্সিকোর উপকূল থেকে, সেই যাত্রা ভাঙা গড়া আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্যে দিয়ে আজকে এখানে এসে শেষ হলো।  মনে পরে সিয়েরা মায়েস্রার জঙ্গলের সেই মুহূর্তগুলি কখন তোমার উপর পুরোপরি ভরসা না করা, পরবর্তী সময়ে তোমার  প্রকৃত বিপ্লবীর গুণাবলীগুলি তোমাকে যোগ্য নেতৃত্বের জায়গাটা করে দিয়েছিল এবং আমিও তোমাকে  যোগ্য অনুসরণ করতে পেরেছি। 

এই বিশাল পৃথিবীতে আমার মতো একজন সাধারণ  বিপ্লবীর ডাক পড়েছে কোন এক হতভাগ্য দেশে তাদের সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানোর। দেশনায়ক আর বিপ্লবীদের মধ্যে ফারাক আছে , আজ সেই ডাকে তোমার সাড়া দেবার উপায় নেই, আর আমি সেই অর্থে কোনো   বন্ধনে আবদ্ধ নই।  আদর্শগত  কারনে আমাকে সেখানে যেতেই হবে। যেখানেই থাকবো সেখানেই আমার সংগ্রাম হবে  সম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে , স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ের মধ্যে। 

সময়ের এই সন্ধিক্ষনে, আগামীদিনের কাজ করার যেমন আনন্দ আছে, ঠিক তেমনি ভালোবাসার প্রিয়জনের কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাবার বেদনাও আছে।  পরিবারের ব্যাপারে আমার কোন চিন্তা নেই, কেননা তারা রাষ্ট্রের সুরক্ষায় থাকবে। 

যদি কোন আকাশের নিচে আমার জীবনের চরম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে, আমার হাতের পতিত রাইফেলটা তুলে নেবার জন্য যখন দেখব অপর একটি হাত প্রসারিত, সেদিন বুঝবো আমার আত্মত্যাগের  সার্থকতা। মনে পড়বে তোমার কথা, তোমার দেশবাসীর কথা, যারা আমাকে সন্তানসমভাবে আমাকে গ্রহণ করেছিল, আমাকে স্থান দিয়েছিলো তাদের অন্তরের গহন প্রদেশে।  আমি থাকবো নিজেকে অবিচল রাখতে  আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

যাত্রা শুরু নতুন রণাঙ্গনে, নয় হারিয়ে যাব এই পৃথিবী থেকে নয় বিজয়ের উৎসাহ নিয়ে আবার শুরু করব  ক্লান্তিহীন পথে হাটা অখন্ড ল্যাটিন আমেরিকা গঠনের লক্ষ্যে। আমার বিপ্লবী অভিনন্দন রইলো তোমার এবং তোমার দেশবাসীর প্রতি -

আর্নেস্তো চে গুয়েভারা ।।

ক্রমশঃ  

পরবর্তী  পর্বে : কঙ্গো র   বিপ্লব - বলিভিয়া- চে'র  মৃত্যু। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়