নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - একাদশ অধ্যায়


নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - একাদশ অধ্যায় 

Evolution of Indian Education System(1)

শিক্ষার ইহকাল  পরকাল  : 

আজকের পর্বে : 
( মর্ত্যের শিক্ষা ব্যবস্থা (রিপোর্টিং) 

[কনফারেন্স রুম -উপস্থিত দেবরাজ ইন্দ্র , অগ্নিদেব,ম্যাডাম সরস্বতী, বেদব্যাস , ঋষি যাজ্ঞবল্ক ,  নারদ এবং  অধীর বাবু ]  

ইন্দ্র: মিঃ  নারদ শুরু করুন আপনার শিক্ষা সম্পর্কিত রিপোর্টিং। 

নারদ : স্যার,  শিক্ষার ধারাবাহিকতার  ইতিহাসটা আলোচনা না  করলে  গোটা রিপোর্টিংটাই  অসুম্পূর্ন থেকে যাবে।  রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতিকে বাদ দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থ্যা নিয়ে আলোচনা চলতে পারেনা।  সারা বিশ্বের ইতিহাস তার সাক্ষী। আপনার স্যার নিশ্চয়ই মনে আছে, ভীষ্ম শরশয্যার শুয়ে আছে, সম্ভবতঃ  মহাভারতের শান্তি পর্বেই হবে। বেদব্যাস স্যার;  ঠিক বলছিতো। 

বেদব্যাস : হ্যা হ্যা চালিয়ে যান নারদ মশাই। ভুল হলে নিশ্চয়ই বলবো। 

নারদ : যুধিষ্ঠির  ভীষ্মের কাছে এসেছেন রাজনীতি কি তা জানতে। লাস্ট মিনিট সাজেশন নিতে। প্রথমেই যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, মনে করুন কোন রাজা এমন একটা অবস্থায় পড়লো তার অর্থনৈতিক  অবস্থ্যা খুব খারাপ , সৈন্যদল ভেঙ্গে গেছে , সভাবতই রাজ্য তো হাতছাড়া হয়ে যাবে।  শুধু থাকার মধ্যে আছে   কিছু নীতিজ্ঞানহীন পারিষদ আর তাদের কুমন্ত্রণা। তখন সেই রাজা কি করবে ?

ভীষ্ম বললেন , সব চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু অর্থের  জোগাড় করতে হবে। রাজাকে মজবুত করতে হবে তার  ফান্ডকে । ভীষ্ম একটা উদাহরণ দিলেন, কোন এক সময়  বিশ্বামিত্র মুনি যখন ক্ষুধার যন্ত্রনায় তার প্রাণ সংশয় উপস্থিত হয়েছিল,  তখন তিনি এক চণ্ডালের ঘর থেকে মরা কুকুরের মাংস খেয়েছিলেন। বিপদে পড়লে মানুষ কি না করে, সেখানে কোন ন্যায় নীতির স্থান নেই।   কর বসিয়ে প্রজার কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে হবে । বৃহত্তর স্বার্থের জন্য রাজাকে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে, সেটাই ধর্ম।   

দেখছেন না ভীষ্মের সেই বাণীর আজকেও তার প্রাসঙ্গিকতা আছে , একজন তখনও  রাজা  হয়নি, শুধু রাজা হবে বলে  নীতিহীন ভাবে অর্থ জোগাড় করেছেন।  আবার কেউ নিজেদের  দেউলিয়া মনে করে ঘাঁটি বাটি বিক্রী করছে আর বেশ কষে ট্যাক্স বসাচ্ছে ভাবছে সরকার  বাঁচবে তাতে। এতো সারা পৃথিবীর চেহারা। এর তো ভুরি ভুরি উদাহরণ  আছে।  সুতরাং অর্থনীতিকে বাদ কোন কিছু হয়না আর মানব সভ্যতা নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতির দ্বারা  তাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ও সমাজনীতি আর শিক্ষা হচ্ছে তার চালিকা শক্তি। 

বেদের যুগে প্রাধান্য পেয়েছিল মানুষের মানবিক উৎকর্ষতা বাড়ানোর। গভীর ধ্যানে ঋষিরা বুঝতে পেরেছিলেন আত্মজ্ঞান না থাকলে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বতা  এই জীব জগতে ধরে রাখতে পারবেনা। বিদ্  ধাতু থেকে বেদ শব্দটির উৎপত্তি তার অর্থ হচ্ছে বিদ্যা বা জ্ঞান।  বেদের সমগ্র স্থান জুড়ে আছে, তা হোল  পুরুষার্থঃ। ধর্ম , কাম , অর্থ আর মোক্ষ এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে পুরুষার্থঃ।  

মনে করা যাক, বিশেষ একটি রোগের জন্য ঔষধ তৈরি করা হচ্ছে একটি বাহ্যিক পরিবেশ  থেকে মুক্ত একটি রসায়নাগারে। পরীক্ষিত নিদির্ষ্ট মাপের মলিকিউল এবং নির্দিষ্ট মানের অন্যান্য পরিমিত মিশ্রনের সমব্যবহারে তৈরি হল ঔষধটি এবং তার পরিমানটাও  নির্ধারিত হল।  সতর্কীকরণের জায়গায় বলা হোল- মাত্রা অতিরিক্ত সেবনে জীবন হানি হতে  পারে।  ঠিকঠাক ইনগ্রেডিয়েন্ট গুলি দেয়া হয়েছে কিনা দেখার জন্য আছে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হলো এবং তাদের সুপারিশে সে ঔষধটা মানুষ গ্রহণ করলো । তার ফলাফল গোটা গোটা করে ছাপা হল সারা বিশ্বের সেরা ম্যাগাজিনগুলিতে। 

ধর্ম , কাম , অর্থ আর মোক্ষ ,  মানুষের ভিতরে  এই  চারটি  ইনবিল্ট মলিকিউল রয়েছে   আর প্রয়োগের কৌশল বলে দিয়েছে অর্থ আর কামকে নির্দ্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করতে। কিন্তু মানুষ কোন মাত্রায় তা ব্যবহার করবে   তা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টটা না থাকার দরুন সংখ্যাধিক্য  মানুষ ভোগের (কামের ) এমনই  ব্যবহার শুরু করেছে, তাতে করে তার মধ্যে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করছে আর সেই  ভোগ্যবস্তু কেনার জন্য অর্থের যোগান  নেই। চাহিদার আর যোগানের ব্যবধানের ফাক দিয়ে ঢুকে গেল হতাশা আর সে মনের মধ্যে বাসা বেঁধে জন্ম দিল চাপা উত্তেজনার ।  ব্যাস শুরু হয়ে গেল সামান্য একটা ব্যাপার থেকে কত কিছু।  বেড়ে গেল ক্রেডিট কার্ডের লোন, ব্যাংকের ইনস্টলমেন্ট, অফিসের কো-অপারেটিভের লোন  আরো কত কি।  নিজের অজান্তে কখন  অনৈতিক কর্মের দ্বারটা খুলে ফেলেছে সে নিজেই জানেনা।  যারা সেই পথে গেলনা বা সক্ষম হল না ,  তাদের আবার  ভিতরে ভিতরে ডুকরে ডুকরে কান্নার প্রতিফলন ঘটলো ব্লাড সুগার মাপার কীটে আর ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্রের পারায় আরও কত কি । এই পথের সব পথিককে কম বা বেশি এই যন্ত্রনার সম্মুখীন হতে হবেই।   

এখন প্রশ্ন হল কে বিশ্লেষণ করবে তার কোয়ালিটির।  এই জায়গাটা  ঠিক ধরেছেন বৈদিক যুগের ঋষিরা।বিচার ও বুদ্ধির সঠিক প্রয়োগের অভাবেই এর জন্ম। এর বাসস্থান হচ্ছে মনে, যেখানে প্রথমেই তার  সুদূর প্রসারী ফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই লজিকাল ইউনিটটি পরিচালিত হয় সঠিক প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে।  তাহলে এটাই দাঁড়াল কোয়ালিটি যদি ইন হয় করে তাহলেই কোয়ালিটি আউট হবে আর গার্বেজ যদি ইন হয় তাহলে গার্বেজ আউট হবে। দেহকে যদি রথ ভাবা হয় তাহলে বুদ্ধি তার সারথি। 

 
তাহলে বোঝা গেল রথের বা দেহের  কোন নিজস্বতা নেই সে বুদ্ধি অর্থাৎ সারথির কথায় চলে আবার বুদ্ধিকে পরিচালিত করে মন আর সেই মনের  পাত্রটা যদি জ্ঞানে পরিপূর্ণ হয় তবে সে নিয়ন্ত্রিত পথে হাটবে আর সেই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার পিছনে আছে শিক্ষা। যে শিক্ষা জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে সেটাই আধ্যাত্মিক শিক্ষা বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ফরম্যাট । ( A format is nothing but a set of logical instruction) 

মানব সভ্যতার সেই  কান্ডারীরা দীর্ঘদিনের নিরলস পরিশ্রম আর তপস্যার মাধ্যমে যেই অপার্থিব জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা বিতরণের জন্য নদীর প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে আশ্রম বা আবাসিক তৈরি করে  আজ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে প্রচলন করেছিলেন এই বৈদিক শিক্ষার। যে অভ্যাস বা অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় সেই অভ্যাসটাই বিদ্যাভ্যাস। ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রকাশ হয় ব্যবহারে। যে  অভ্যাস মানুষকে অন্য  মানুষ সম্পর্কে ভাবতে শেখায় তাই  হল মানসিক বিকাশ।   তাছাড়া, বিজ্ঞান , সাহিত্য, অঙ্ক ইত্যাদি শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তি মূলক শিক্ষার মধ্যে থাকতো জ্যোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র, আয়ুর্বেদ অর্থনীতি ইত্যাদি , শিল্পকলা, খেলাধুলা, যোগা , ধ্যান, বেদের মন্ত্র পাঠ প্রভৃতির মাধ্যমে অন্তঃপ্রকৃতির উন্মেষ ঘটানো হতো  । 

এই সবই ছিল পড়ার বিষয়বস্তু আর অভিমুখ ছিল অধ্যাত্বিকতা, যার অভ্যাসে মানুষ লাভ করে সবার অন্তরালে থাকা  সেই  চেতনাকে, যার মাধ্যমে  এই জগৎ সংসার পরিচালিত হয়, যে মানুষকে   সুখ দুঃখের অনুভূতি দেন, সেই-ই আবার প্রকৃত সত্যেকে  উন্মোচিত করে দুঃখময় পৃথিবীতে  চির সুখ আর শান্তির দ্বারটা খুলে দেয় । আজকেও তার নিরন্তর অনুসন্ধান অব্যাহত। 

উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, সে সময়ে কোন পাঠ্য পুস্তক ছিলো না। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা গুরু তার স্মৃতি থেকে করতেন আর সেই সব শ্রুতি গুলি ছাত্ররা তাদের স্মৃতির ভাণ্ডারে পাঠাগার হিসাবে যত্ন করে সাজিয়ে রাখতেন। সমস্তটাই মুখস্ত বিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই  সময়কার শিক্ষা ব্যবস্থ্যায় আজকের মতো রাজনৈতিক কোন হস্তক্ষেপ ছিলনা আর তা  ছিল অবৈতনিক। সে যুগে এটাই ছিল রাষ্টের নৈতিক দায়িত্ব । 
 

  ক্রমশঃ 
 

মন্তব্যসমূহ

My new blog বলেছেন…
পড়লাম, খুব ধৈর্য ধরে পড়তে হয়, লাইন মিস করলেই বোঝা মুস্কিল।
My new blog বলেছেন…
পড়লাম, খুব ধৈর্য ধরে পড়তে হয়, লাইন মিস করলেই বোঝা মুস্কিল।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল