নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - ১৩তম পর্ব
নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - ১৩তম পর্ব
আজকের পর্বে : বিবর্তনবাদ
শিক্ষার সাথে অবিচ্ছেদভাবে জড়িয়ে আছে মানুষ ও সমাজ। ( সমাজের মধ্যে অন্যান্য সব সংগঠন রয়েছে ) এই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন করলে তা অসম্পূর্ন আলোচনা হবে ।
বিবর্তন ( Evolution )
ক্রম পরিবর্তনশীলতা বিশ্ব সংসারের এক স্বাভাবিক নিয়ম। এর মুলে আছে বস্তুর গতিশীলতা আর দ্বন্দ্ব। একদিন মাটিতে প্রোথিত বীজ সময় আর পরিবেশের সাথে নিজেকে একাত্ম করে মহীরুহতে পরিণত হয়, আবার ধীরে ধীরে সে আবার সেই মাটিতে বিলীন হয়ে যায়। শুধু রেখে যায় ভবিষ্যতের জন্য তার বীজ। এক চক্রটা পরিবর্তনের ধর্ম, সৃষ্টির ও ধর্ম বটে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবের পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতার ইতিহাসটাই হল বিবর্তন।
জীবের বিবর্তন (Evolution Of Organism )
সমগ্র বিবর্তনটা দাঁড়িয়ে আছে সংগ্রহকৃত তথ্যের বা ডাটার ভিত্তিতে। প্রত্যেক বস্তুর নিদ্দিষ্ট প্রোটোকল আছে কিন্তু পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি একটাই, সেটা হলো পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সৃষ্টি। এই আলোচনার জন্য বিভিন্ন নাম ও রূপের জটিলতার মধ্যে না গিয়ে , শুধু মাত্র বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক সেইটুকুকেই উপস্থাপনা করব।
বংশগতি (Heredity): বিবর্তন এক গতিশীল প্রক্রিয়া। আদিকালের জীব কি করে আজকের জীবে পরিবর্তিত হলো, এটা খোঁজাই জীববিজ্ঞানীদের কাজ। তাদের কাছ থেকে সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে যে ছবিটা পাওয়া যায় তা কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিবর্তনগুলির তথ্য যেভাবে থাকে সেইভাবে থাকে না। তাহলে কোথায় থাকে ?
"ক্রোমোজম" (Chromosome) বলে এক প্রধান বংশগতির উপাদান আছে। সে বাস করে নিউক্লিয়াসের মধ্যে এবং জিনের বা DNA এর অনুকে সে ধারণ করে। ক্রোমোজমের কাজ হল মাতাপিতা থেকে জিন বা DNA-কে সন্তানসন্ততিতে বহন করে নিয়ে যাওয়া।
"নিউক্লিয়াস " (Nucleus ) ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ হোচ্ছে শাঁস বা মূল অংশ। যেভাবে কোন লকারে খুব যত্ন করে একের পর এক সুরক্ষার বেড়াজাল দিয়ে সেই তথ্যকে সংরক্ষিত করা হয়, ঠিক সেরকমভাবে পর্দ্দা, জালিকা, প্লাজমা প্রভৃতি আবরনের অন্তরালে জীবদেহের তথ্য ভান্ডারকে সুরক্ষিত করে রাখা হয়।
জিনের চরিত্র : (Gene's Character) বিবর্তন যে মূলত দুটি বিপরীত নিয়ামকের ফল সেটা জিনের চরিত্র অনুধাবন করলে বোঝা যায়। সময় এবং পরিবেশের সাথে সাথে জিন নিত্য নতুন ভ্যারাইটি তৈয়ারী করে। এই পার্থক্য থাকার ফলে দ্বন্দ অব্যাহত থাকে এবং সেই দ্বন্দে যার প্রভাব সর্বাধিক সেই বংশাণু জিন সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে। এই ভাবেই পরিবর্তন তার দ্বান্দ্বিক চরিত্র নিয়ে যুগের পর যুগকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায় ভবিষ্যতের পানে।
সমাজ ( Society )
আধুনিক বিজ্ঞান বহু গবেষণার মাধ্যমে প্রমান করেছে সমাজ বস্তু জগতের একটি অংশ মাত্র। সমাজ যদি বস্তুজগতের অংশ হয় তাহলে সে বস্তুর স্বাভাবিক নিয়মেই বিকশিত হবে, তা অনস্বীকার্য্য। বস্তুজগতের নিয়ম হচ্ছে দুইটি বিপরীত ধর্মের শক্তির দ্বন্দ্বের মাধ্যমে পরিবর্তন এবং সৃষ্টি। সমাজের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। যেমন, মানুষের শরীরকে যদি সমাজ হিসাবে ভাবা হয় তাহলে তার ক্রমপরিবর্তনশীলতার উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, শৈশবের মৃত্যুতে কৈশোরের জন্ম, আবার কৈশোরের মৃত্যুতে যৌবনের জন্ম, যৌবনের মৃত্যুতে প্রৌঢ়ত্বের জন্ম, এভাবেই পরিবর্তন তার চিরন্তন অভ্যাসকে বজায় রেখেছে।
সমাজকে এককথায় বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় যে, সেটা এমন একটা সিস্টেম বা পদ্ধতি যার ব্যবহার ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বহুধা বিভক্ত মানুষের আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তা চরিত্রগতভাবে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে সমাজ ক্রমপরিবর্তনশীল। তাহলে বোঝা গেল সমাজ হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া কোন ফলশ্রুতি নয়। মানুষ হচ্ছে সমাজের মূল চালিকা শক্তি বা অন্যতম উপাদান।
আচার-আচরণ (Behavior )
সমাজে আচার আচরণের এক বিশাল ভূমিকা আছে। আচরণের প্রকাশই একমাত্র সমাজে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বৃহত্তর সংগঠনের উপর প্রতিক্রিয়া সংগঠিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অন্তঃপ্রকৃতিতে দুইটি বিপরীত বস্তুর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের বাহ্যিক প্রকাশ হচ্ছে আচরণ। বাইরের প্রকৃতি থেকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে ডাটা মানুষের অন্তঃপ্রকৃতিতে গিয়ে Endocrine system এবং Nervous সিস্টেমকে সক্রিয় করে, সেই ডাটা প্রসেস করার পর যে আউটপুট বেরোয় বা তার যে বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হয় তাকেই ব্যবহার বলে।
ব্যক্তির আচার আচরণের প্রকাশের ভিত্তিতে তাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথক্রমে , আশাবাদী , হতাশাবাদী , বিশ্বাসের প্রতি অনুরুক্ত আবার ঈর্ষান্বিত।
সামাজিক বিবর্তন (Social Evolution)
'বিবর্তন' শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে "evolution" এবং এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ "evoluere" থেকে যার অর্থ হলো উন্নতি, 'সংস্কৃত' ভাষায় এর মানে হচ্ছে "বিকাশ"। সামাজিক বিবর্তন বা ক্রমবিকাশ সাংকৃতিক ক্রমবিকাশের একটি অঙ্গ মাত্র।
সামাজিক কাঠামো : (Social Structure)
সামাজিক কাঠামো একটি ক্ষেত্র বিশেষ। যার উপর দাঁড়িয়ে আছে পরিবার, ধর্ম , আইন, নীতি, অর্থনীতি , রাজনীতি, গণমাধ্যম ইত্যাদি। বাহ্যিক আবরণ বা কাঠামোর কাজ ভিতরের বস্তুর সংরক্ষণ করা ঠিক তেমনি মানুষের রক্ষাকবচ হিসাবে এই সংগঠনগুলি কাজ করে।এই কাঠামোটি মানুষকে আবর্তন করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলি বা উপাদান দিয়ে গঠিত একটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল এবং তার একক রূপ হচ্ছে সামাজিক কাঠামো ।
সামাজিক পরিবর্তনের শর্ত : (Conditions Of Social Changes)
এই জগৎ পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তনের পিছনে আছে বস্তু জগতের দ্বান্দ্বিক রূপ এবং তার প্রভাব জিন থেকে শুরু করে দৃশ্যমান থেকে অদৃশ্যমান জগৎ পর্যন্ত বিস্তারিত। এবার প্রশ্ন হলো কি ধরনের শর্ত পূরণ করলে তাকে সামাজিক পরিবর্তনের আখ্যা দেওয়া যাবে। সামাজিক কাঠামোর ভিতরে বহু সংগঠন আছে , তাদের পরিবর্তনের প্রভাব যদি মানব জীবনধারার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয় তাহলে সেটাই পরিবর্তনের সঠিক শর্ত। যেমন বহু সময় রাজনৈতিক দলগুলি দাবি করে যে তারা দেশে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে কিন্তু কার্য্য ক্ষেত্রে দেখা যায় তা রূপগত পরিবর্তন গুনগত নয়। সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম উপাদান ।
সমাজ পরিবর্তনের সংজ্ঞা (Definition of Social Changes) )
অন্যান্য গণিত এবং বিজ্ঞানের মতো সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সেভাবে নির্দ্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। সমাজে অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সংগঠন গুলি মানুষের দ্বারা তৈয়ারী। এর মধ্যে রাষ্ট্র নামক সংগঠনটি অন্যতম। বাস্তবে অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলি রাষ্ট্রের ইশারায় চলে। যদিও ধর্মীয় সংগঠনের ক্ষেত্রে ছাড় আছে কিন্তু আজকাল সে গুলিকে পারমানবিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশের উপর রাজনৈতিক যুদ্ধে জিতবার জন্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলই এই রাষ্ট্র নামক সংগঠনটির চালক হয়। অধিকাংশক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গির উপর দেশের নীতি নির্ধারণ হয়ে থাকে। শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি থাকে, যেটা শাসক হওয়ার পূর্বে সেই রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষকে প্রতিশ্রুতি আকারে দেয়। এই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে তৈরী হয় ক্ষোভ সেই ক্ষোভ পরিবর্তিত হয় জনজাগরণে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আদর্শের ভিত্তিতে যখন মানুষ সংগঠিত হয়, তখন তৈরী হয় পরিবর্তনের বীজ আর সেই বীজ যখন জনগনের মধ্যে প্রোথিত হয় তখনই সেই বীজ থেকে অংকুরিত হয় পরিবর্তনের চারা। সেই চারা থেকে পরিবর্তন বা বিপ্লব ঝড় হয়ে সমাজের অন্যতম সংগঠন রাষ্ট্রের পুরাতন আবর্জনাকে দূর করে স্বচ্ছ বাতাবরণ তৈরি করে। তারপরই আসে এক এক করে অন্যান্য সংগঠনকে পরিবর্তন করার পালা।
এটা একটা দীর্ঘ এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলা একটা প্রক্রিয়া আর সেই কাজটাই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কাজ। এই গোটা ব্যাপারকে নিয়েই সমাজ পরিবর্তন। পুরাতন মানুষ নিয়ে নতুন বাড়িতে প্রবেশ করলে আবার, সেই শেষ না হওয়া গল্পের পুনরাবৃত্তি হবে। সাংস্কৃতিক জগতের পরিবর্তনই একমাত্র নতুন মানুষ তৈরী করতে পারে। শিক্ষাই পারে মানুষের ভালো থাকার পরিবেশ গঠন করতে এবং সাংস্কৃতিকমানের উন্নয়ন ঘটাতে। অবশ্যই মানুষকে সেখানে কষ্টি পাথরে পরীক্ষা করে গুরু এবং বিদ্যালয় মনোনয়ন করাটা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে ?
আঘাত হয়ে দেখা দিল , আগুন হয়ে জ্বলবে ।।
( For every action their is an equal and opposite reaction )
শিক্ষার বিবর্তন
ক্রমশঃ
.
(বিঃ দ্রঃ লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন )
.
মন্তব্যসমূহ