ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা ( শুধু মাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )

   ব্যাসদেবের  জীবনের  অপ্রকাশিত  ঘটনা 

( শুধু মাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )

সরস্বতী নদীর তীরে আনমনা  হয়ে  নদীর ঢেউয়ের ভাঙা গড়ার খেলা ভীষণ নিবিড় ভাবে অবলোকন করছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব।  আসলে তিনি ভাবছিলেন সদ্য  তার জীবনের উপর দিয়ে এক অচেনা অনুভূতির ঢেউগুলির কথা, যারা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার এতদিনের মূল্যবোধকে। তার পরিচিত পৃথিবী  আজ তার কাছে অচেনা বলে বোধ হচ্ছে। সেই  নাম না জানা গ্রহে  আগুন্তুকের মতো অস্থিরভাবে পরিভ্রমন করে বেড়াচ্ছেন। একের পর এক  সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া  ছবিগুলি মানসপটে ভেসে উঠছে । 

সবে তখন মাত্র বারো বছর মাতা সত্যবতীর স্নেহের নিবিড় বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে পিতা পরাশর মুনির হাত ধরে গুরুগৃহে গমন। কঠিন নিয়নামানুবর্তীতায় বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র  অধ্যায়ন, আশ্রমবাসী বেদব্যাস তাই স্বভাবতই সাংসারিক বন্ধন থেকে সে মুক্ত ছিল ,  আত্মপোলদ্ধি এবং আত্মবিকাশের মাধমে ইন্দ্রিয়ের উপর তার  নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।  এসবই ঠিকই  ছিল কিন্তু হঠাৎ সেদিন, মাতা সত্যবতীর আকুল আহ্বানের সাড়া দেওয়ার পর  হস্তিনাপুরের রাজপুরীর  মানচিত্রে তার স্থায়ী অবস্থান ও তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের ফলস্বরূপ এতদিনের  জীবনদর্শন আজ নিজের কাছেই প্রশ্নের মুখোমুখি। 

মনুস্মৃতি এবং মহাভারতে " নিয়োগ " বলে  এই আচার ব্যবস্থার উল্লেখ আছে।  বার বার  মহাভারতে " নিয়োগ " প্রথাকে  প্রয়োগ করা হয়েছিল বংশের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য। যে নারীর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বা সেই পুরুষ সন্তান উৎপাদনে অক্ষম, সে ক্ষেত্রে সমাজ বিধান দিয়েছে পর পুরুষের সাথে শুধু মাত্র প্রয়োজনে  সঙ্গম করতে পারবেন  সন্তান উৎপাদনের  জন্য, অবশ্য তা কোন অবস্থায় তিন বারের অধিক নয় । তার সাথে আরো কিছু বিধিনিষেধের কথা বলা ছিল। 

প্রথমত: স্ত্রীকে রাজি হতে হবে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য। যৌন আনন্দ লাভ করার জন্য নয়। 

দ্বিতীয়ত : এই যৌন মিলনে উৎপাদিত সন্তানের প্রতি নিয়োজিত পুরুষের কোন পিতৃত্বের দাবী থাকবেনা। 

তৃতীয়তঃ  ভবিষ্যতেও কোন অবস্থায় সে পিতৃত্বের দাবি করতে পারবে না। 

চতুর্থতঃ  স্ত্রী ও পুরুষকে ধরে নিতে হবে ঈশ্বরের আদেশেই তারা পালন করছেন, তার থেকে বিশেষ কিছু নয়। 

পঞ্চমত: সঙ্গম করার সময় দেহের উপরের অংশ প্রদর্শন করা যাবেনা এবং উপরের অংশ স্পর্শ করা যাবেনা। তাছাড়া উভয়ের মুখের উপর হালকা পর্দা থাকবে, যাতে একে অপরকে দর্শন করে তাদের মধ্যে আবেগ প্রকাশিত না হয়। শুধু মাত্র পা দুখানি অনাবৃত থাকবে এবং  পুরুষাঙ্গ নারী অঙ্গে স্পর্শ  করে বীর্যস্থলন  করে পুরুষ সেই স্থান পরিত্যাগ করবেন। 

নিয়োগের নিয়মকানুনের মাপকাঠিতে  কতকগুলি প্রশ্নের উদয় মহাভারতের পাঠকদের হওয়া খুব স্বাভাবিক। যেমন, অম্বিকার সাথে মহাভারতের কবির সঙ্গমের সময় তার নেত্রদ্বয় অবনত করার দরুন অম্বিকাকে অভিশাপ দেন তার ফলস্বরূপ  অন্ধ পুত্র জন্ম গ্রহণ করে । 

অম্বালিকার সাথে মিলনের সময় রূপের গর্বে গর্বিত নারী যখন ব্যাসদেব দেখে তার মুখটা পান্ডুর হয়ে গেল   তাই তাকে অভিশাপ দিলেন পান্ডুর ন্যায় তার পুত্র হবে।  

পরবর্তী সময়ে বিচিত্রবীর্যের দাসীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সময় দ্বৈপায়ন ও সেই দাসী দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন যৌন ক্রীড়ার দ্বারা উভয়েই পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন। তাই তিনি সেই দাসীকে সর্বগুনসম্পন্ন পুত্রের বরদান করেন। 

এবার প্রশ্ন হল নিয়োগ পদ্ধতির যথাযথ বিধি এক্ষেত্রে মানা হয়েছিল কি ? যেখানে সন্তান উৎপাদনই মুখ্য আর যৌন আনন্দ সেখানে শুধু মাত্র গৌণ নয়, একেবারেই বর্জনীয়। তাছাড়া পরস্পর মুখদর্শনের ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সর্বশেষে সঙ্গমের সময় শরীরের উর্ধাংশ স্পর্শ করা বর্জনীয় ছিল।  সেখানে ব্যাসদেবের বিবরণ অনুযায়ী বিচিত্রবীর্যের দাসীর সাথে দীর্ঘক্ষণ যৌনক্রীড়া করার সময় সেই সেই নিষেধাজ্ঞাগুলিকে শুধু অমান্য করা হয়েছিল তাই নয়, বরং অম্বিকা ও অম্বালিকার  সাথে মিলনের সময় তাদের শারীরিক ভাষায় এবং যৌন তৃপ্তি পাওয়া ও না পাওয়ার  মানদন্ডে মহাভারতের কবি কুরুবংশে ইচ্ছাকৃতভাবে  প্রতিবন্ধী সন্তান উপহার দিয়েছিলেন। এখানে সর্ব গুন সম্পন্ন সন্তান পাবার জন্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের যৌনতৃপ্তিটাই একমাত্র নির্ণায়ক  হয়েছিল  এবং যেই মাতাদ্বয় সেটা পূরণ করতে পারেনি তার সুদূর প্রসারী পরিণতি  তাদের সন্তানরা ভোগ করছেন।  অবশ্য এই সব প্রশ্নের উদয় হতোনা যদি না এই গোটা ঘটনার কারিগর সেই  নিয়োজিত ব্যক্তিটি  একজন ঋষি না হতেন। 

ঋতস্য্ দীদিতম্ - দীদিতম্ শব্দের অর্থ যিনি আলোকময়, অর্থাৎ প্রকাশমান।  ঋতম্ হল সেই সত্য যা সারা বিশ্ব প্রকৃতি যে মহাজাগতিক নিয়মে বা সিদ্ধান্তের উপর চলছে। এক কথায় মহাজাগতিক নিয়ম, কেউ তাকে লঙ্ঘন করতে পারবেনা। কিন্তু ঋতম্ মাঝে মাঝে অনৃতম হয়ে যায় আসুরিক শক্তির প্রভাবে। অনৃতম হয়ে যাওয়া মানে মহাজাগতিক নিয়মকে অস্বীকার করা। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে  গাছ থেকে পড়ে যেই ফল সে নিম্নগামীই হয়, কখনই উপরে উঠে যায়না, সূর্য ওঠার সাথে দিনের আলো ফুটবে আবার দিনের শেষে রাত হবে - এটাই জাগতিক নিয়ম। 

ঠিক তেমনি মহাভারতের কবির আত্মসংযম এবং ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ মহা জাগতিক নিয়মের মতো স্বচ্ছ। দীর্ঘদিনের বেদাভ্যাস, শাস্ত্রচর্চার মাধ্যমে যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন সেই জ্ঞানের আঁধারে যাকে তিনি ব্যাভিচার হিসাবে এতদিন মান্যতা দিয়ে এসেছেন আজ তাকে কিনা মাতার অনুরোধে কনিষ্ঠভ্রাতার জায়া, শাস্ত্রে যাকে  বলে   কন্যা সমতুল্য, তার সাথে সঙ্গম করতে হবে আপৎকালীন ধর্মের দোহাই দিয়ে। ব্যাভিচারের অর্থ ব্যাভিচারই হয় তাকে যে কোন ভাবে প্যাকেজিং করা হোক না কেন। তাই মহাভারত দেখলো এই কুপ্রথার অবিশ্যম্ভাবী বিষময় পরিণামকে । 

মানুষের জীবনের যা কিছু শুভ কর্ম করে তার ফল ঋতমরূপে থেকে যায় এবং সেটাই পরে ফলরূপে তার কাছে ফিরে আসে।  একজন ঋষি যিনি আজীবন সত্যের পথে চলে জীবনে যা কিছু পুন্য সঞ্চয় করলো এবং সেই অভ্যাসটাই তার  বাকি জীবনের  পথপ্রদর্শক হিসাবে  সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে  

যদি সৃষ্টিধর্মী কাজে নিয়োজিত শিল্পীকে রাজা বলে আজ  থেকে তোমাকে  ধংসাত্বক কাজে অংশ গ্রহণ করতে হবে , কবিকে  বলা হোল  তুমি কাব্য রচনা থেকে বিরত থাকো। সেই মুহূর্তে মৃত্যু হবে শিল্পীর আর কবির সুক্ষ শরীরের, তাদের শিল্প সত্তার। দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে পালিত বিশ্বাসবোধ আর আদর্শের যে বুনিয়াদ তারা তৈরি করেছিল তা এক লহমায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, শুধু পরে রইলো এই স্থুল শরীরটা।  ঠিক তেমনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের সত্ত্বার  সেদিনই মৃত্যু হয়েছে যেদিন তার আদর্শকে রাজনীতির কারিগরের হাতে বিসর্জন দিতে হয়েছে ধর্মের নামে। 

সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে  চলছে শাসক তার ঘৃণ্য স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বহু শিল্পীর হাত থেকে তুলি কেড়ে নিয়েছেন, বহু লেখকের হাতকে অকেজো করে দিয়েছে যাতে জীবনে সে কলম ধরতে না পারে।  শাসক ভাবছে যাক, সত্ত্বার তো মৃত্যু হয়েছে, আর তারা বংশ বিস্তার করতে পারবেনা।  কিন্তু সে জানেনা আদর্শের যে কোন  মৃত্যু  নেই সে তো ঋতম্ 

BLOGER -RABIN MAJUMDER
   .



মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
A society should have a well structured laid laws which needs to be screened over and over with time. During framing of the law human rights issue needed to be restored but definitely not at the cost of jeopardizing sanctity of the society. Society is the bowl where we take the grains to eat. So it needs to be perfect not perforated.
Prof. S. K. G.

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়