নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - ১৪ তম পর্ব -
নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - ১৪ তম পর্ব
Evolution of Indian Education System(4)
আজকের পর্বে : শিক্ষার বিবর্তন
আগের পর্বে : বিবর্তন - বংশগতি - ক্রোমোজোম - নিউক্লিয়ারস -জিনের চরিত্র - সমাজ - আচার আচরণ - সামাজিক বিবর্তন - সামাজিক কাঠামো - সামাজিক পরিবর্তনের শর্ত - সমাজ পরিবর্তনের সংজ্ঞা ।।
নারদ : সমাজের ক্রমবিকাশের সাথে শিক্ষার বিবর্তনের এক অবিচ্ছেদ্দ সম্পর্ক । সমাজ, সংকৃতি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা সবকিছুই এই মানব সম্পদকে ঘিরে আবর্তিত হয় । মানব প্রকৃতি দুইভাগে বিভক্ত, অন্ত প্রকৃতি এবং বাহ্য প্রকৃতি। সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি বাহ্য প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত, মানুষ তা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অন্তঃপ্রকৃতিতে গ্রহণ করে এবং গ্রহণ পরবর্তী বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি সক্রিয় হয় তখন একদিকে থাকে পুরাতন চিন্তা আর অন্য দিকে থাকে নতুন ভাবনা, তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। সেই দ্বন্দ্বে বিজয়ী মতটি মানুষের ব্যক্তিগত মতামত হিসাবে পরিগণিত হয়। এই ব্যক্তিগত মতামত যখন সমষ্টিগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করে সামাজিক সংগঠনে এক নতুন ভাবনার জন্ম দেয় তখন মৃত্যু হয় সেই পুরাতন ভাবনার। এইভাবেই সৃষ্টির শুরু থেকে সভ্যতার পাদদেশে এসে পরিবর্তন তার অপরিবর্তনীয় রূপের অহংকার নিয়ে যুগের পর যুগ অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার বাস্তব রূপটা যাই ই হোকনা কেন, পদ্ধতিটা এক। প্রকৃত পক্ষে মানব মনে বাহ্যিক প্রকৃতির প্রভাবে অন্তঃপ্রকৃতিতে যে অদৃশ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয় তাই-ই দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব করার জন্য যে অস্ত্রের প্রয়োজন হয় তার মূল যোগান আসে জ্ঞান ভান্ডার থেকে। আর জ্ঞান ভান্ডারকে শক্তিশালী করে শিক্ষার নির্যাস ।
তাই জ্ঞানের আরেক নাম আলো আর সেই আলো যুগে যুগে শাসকের পরীক্ষাগারে তৈরি হয়। শাসক সবসময় চায় তার স্বরূপকে অন্ধকারে ঢেকে রাখতে চায়। প্রকৃত শিক্ষা সমৃদ্ধ করে সংস্কৃতিকে আর সংস্কৃতি থেকে উন্মেষ হয় চেতনার আর চেতনা প্রকাশিত হয় পরিবর্তনরূপে । তাই শাসক শিক্ষাকে ভীষণ ভয় পায়। আজও যারা সেই প্রক্রিয়াকে অতিক্রম করে সমাজে আলোর দিশা দেখতে যাঁরা যান , তাদের গন্তব্য স্থল হয় সংশোধনাগারে।
আলোচনার পরিপেক্ষিতে যেটা সহজেই অনুমেয় তাহলো বাহ্যিক জগতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটি আসে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংখ্যাধিক্যে ক্ষমতাহীন মানুষের কাছে। আলোচনার পদ্ধতিগত দিক থেকে একাধিক যুক্তি থাকতে পারে কিন্তু প্রধান কারন একটাই হবে। সেই কারণটি হচ্ছে বস্তু জগতের দ্বান্দ্বিক চরিত্র। শিক্ষার বিবর্তনের প্রতিটি উত্তরণে ক্রমবিকাশের দ্বান্দ্বিক রূপটা সঠিক ভাবে খুঁজে বার করতে পারলে আজকের শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিবর্তনবাদের যৌক্তিকতাকে উপলদ্ধি করা যাবে।
বেদের উল্লিখিত রচনার ভিত্তিতে, সেদিনের সময়টা ছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ( মাক্সমুলাররের রিপোর্টের ভিত্তিতে)। এই ভারতভূমিতে ভিন্ন ভূখন্ড থেকে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষ করে একদল উন্নত জাতি এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করলো এবং তারাই পরবর্তী সময়ে পরিচিত হল আর্য্য নামে।
আসমুদ্র হিমাচল নদ-নদী, শ্যামল উর্ব্বর বনাঞ্চল দিয়ে আবৃত এই ভারতভূমি। অকৃপণ হাতে প্রকৃতি দান করেছে প্রাণীদের বেঁচে থাকবার সব উপকরণ। মানুষের তাই ছিলনা কোন
জীবনধারণের প্রতিযোগিতা তাই নজর আবদ্ধ ছিল অন্তঃপ্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে।
বৈদিক যুগের ঋষিরা ডুব দিয়েছিলেন আপন হৃদয়ে, গভীর ধ্যানে, অন্তঃপ্রকৃতির রহস্যের পানে আর তুলে এনেছিল ছোট বড়ো কতো জ্ঞানের নুড়ি , সমৃদ্ধ করেছিলেন জ্ঞানের ভান্ডারকে এবং তা পরবর্তী সময়ে উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীবাসীর কাছে। এখনো তা বিশ্ববাসীর ঈর্ষার কারন। তার জন্য অবশ্য স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণমিশনের আর মাক্সমুলার সাহেবের অবদান অনস্বীকার্য্য। তাই আজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তার দীর্ঘ দিনের বাহ্য প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানের ঘোরে ভোগবাদী দুনিয়ার হ্যাংওভার কাটিয়ে তারা আজ অংশীদার হতে চায় ভারতীয় সংস্কৃতির আর হাতে হাত মিলিয়ে ভাগিদার হতে চায় এই সংকৃতির বাহক হোতে।
শিক্ষার সাথে ধর্মের এক নিবিড় বন্ধন। প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সে যুগে ধর্মের দর্শন ছিল আধ্যাত্মিকতা। যে শিক্ষা ভোগবাদের বশবর্তী হয়ে মানুষকে এই পার্থিব জগতে কেবলমাত্র দুঃখ উৎপাদন করতে সাহায্য করে , সেই দুঃখ থেকে নিজেকে মুক্ত করে সত্যকে উপলদ্ধি ও তার সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করাই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। তাই শিক্ষার অভিমুখ ছিল আত্মপোলদ্ধি এবং আত্মবিকাশের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় বাসনা থেকে মুক্তি।
প্রাচীন আর্য্য সভ্যতা দুইভাগে ভাগ করা যায়। ঋকবৈদিক সমাজ ব্যবস্থা এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজব্যবস্থা। পরবর্তী বৈদিক যুগে বর্ণাশ্রমকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ভুক্ত শ্রেণীর মানুষেরা সমাজে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসাবে প্রতিপন্ন হতে শুরু করল। শিক্ষাকে কুক্ষিগত করে রেখে ছিল ব্রাহ্মণরা এবং বেদ শিক্ষা থেকে শূদ্ররা একেবারেই বঞ্চিত ছিল।
আজকের মতো কোন চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। কতগুলি গ্রামকে কেন্দ্র করে কিছু জনগোষ্ঠীরা তাদের বহিঃশত্রুর আক্রমনের থেকে রক্ষা করার জন্য সামরিক পারদর্শী একজনকে রাজা হিসাবে মনোনীত করতেন। রাজার পরামর্শ দাতা হিসাবে ছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা । ব্রাহ্মণদের মানবীয় পুঁজি ছিল শিক্ষা। রাজা ব্রাহ্মণদের কাছ থাকে জ্ঞান নিয়ে ঋণী থাকতেন। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় এক নতুন সমীকরণের ফলে ব্রাহ্মণ কতৃক শূদ্রদের বঞ্চনার উপর প্রাতিষ্ঠানিক সিলমোহর পড়েছিল।
বর্ণ বিভাজন থেকে শ্রেণী চেতনার উন্মেষ ঘটলো এবং উপেক্ষিত শ্রেণীর বিকল্প ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু হলো । জন্ম দিল পরিবর্তনের অন্যতম উপাদান দ্বন্দ্বের। খ্রিষ্ট্রপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে , ভারতবর্ষেও তার প্রভাব পরে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান শুরু হয়। বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে সংকীর্ণ বর্ণাশ্রমের কোন জায়গা ছিলোনা , শিক্ষা সবার জন্য অবারিত ছিল। ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন উঁচুনিচু ভেদাভেদ ছিল না। ক্রমশ শিল্পের উন্নয়নের ফলে বৈশ্যদের হাতে অধিক ধনসম্পত্তি বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বৈশ্যদের বৃদ্ধি পাওয়াতে তারা ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকারকে অস্বীকার করতে শুরু করে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের জন্ম হওয়াতে, তার প্রভাবে উপজাতিদের সামাজিক বাঁধন শিথিল হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পরে। নতুন নতুন অঞ্চল ভিত্তিক রাজ্য গঠিত হতে শুরু করে। সেই আঞ্চলিক রাজ্যের রাজারা ছিল যুদ্ধ প্রিয়। ভীষণ দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন হতে শুরু করে, তার প্রভাবে সাধারনের মধ্যে জীবন সম্পর্কে এক অনীহা দেখা যায়। দলে দলে মুক্তির খোঁজে সন্যাসীর জীবযাত্রার প্রতি তাদের আকর্ষণ বেড়ে যায়।
সাধারণ মানুষ বৈদিক ধর্মের পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ধীরে ধীরে বৈদিক শিক্ষা সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদের উপর অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তার প্রতিক্রিয়া সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বহুবিধ কারণের মধ্যে একাধারে ব্রাহ্মণদের হাতে কুক্ষিগত শিক্ষা , সামাজিক বঞ্চনা আর বর্ণাশ্রমের ভেদভেদ এবং তার সাথে সমান্তরালভাবে বেড়ে উঠা বৌদ্ধ সংস্কৃতির উদার চিন্তা, সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। এই সামাজিক দ্বন্দ্বের কারনে বৌদ্ধদের প্রচলিত শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মধ্য যুগে ভারতবর্ষে মুসলিম রাজত্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১২০৬ সালে। যে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের পাশাপাশি সেই দেশের সংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এক পরিবর্তন সূচিত হয় এবং তার প্রভাব সমাজজীবনে প্রতিফলিত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পরে। ভারতবর্ষে হিন্দু ও বৌদ্ধ শিক্ষার সাথে যুক্ত হয় মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা। এখানে শিক্ষার পরিবর্তন ও পরিমার্জনের প্রত্যক্ষ কারনটি হচ্ছে রাজনৈতিক।
এক সময় ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের দিনমনি অস্তমিত হতে শুরু করে । আর্থিক উন্নয়নের একরাশ প্রতিশ্রুতি নিয়ে সাগর পার থেকে এল একদল বণিক ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সূরাতে বাণিজ্য করার জন্য সম্মতি পাবার সাথে সাথে নিজেদের কোম্পনির ভিত্তি প্রস্তরও স্থাপন করে ফেলে। ১৭৫৭ পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার মৃত্যুর সাথে সাথে পাকাপাকিভাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় একদল বণিকের হাত ধরে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরাজী ভাষা ও মিশনারী শিক্ষার প্রচলন শুরু হল অন্যান্য পূর্ববর্তী শিক্ষার পাশাপাশি।
অর্থনীতি যেমন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক তেমনি ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকে । তাই প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
ক্রমশঃ
মন্তব্যসমূহ