নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - ১৫ তম পর্ব Evolution of Indian Education System(5)
নারদের মর্ত্যে ভ্রমণ - ১৫ তম পর্ব
Evolution of Indian Education System(5)
নারদ : ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা এক বর্ণময় ঘটনার সাক্ষী। যে শিক্ষার বীজ একদিন প্রোথিত হয়েছিল উন্মুক্ত আকাশের নিচে আজকের দিনে সেই শিক্ষাই আবার কর্পোরেটদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারকা খচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আকার ধারণ করেছে।
সভ্যতা ও সংকৃতির সাথে অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির সাথে সাথে শিল্পের প্রয়োজনে মানবসম্পদ তৈয়ারি করার প্রয়োজনীয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে , তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে শিক্ষার অভিমুখকে শিল্পমুখী করার।
বৈদিক যুগের শিক্ষার অভিমুখ ছিল আত্মানুসন্ধান আজ সেটা হয়ে গেছে বাইরের প্রকৃতি থেকে মানবীয় পুঁজি (Human Capital) সংগ্রহের আর ইঁদুর দৌড়ের প্রশস্থ প্রান্তর। আজকে এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি ব্রাহ্মনরূপী বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের ভিড়ে শূদ্রসম বিত্তহীনরা প্রান্তিক হয়ে গেছে। সেই বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজন আজ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে বিত্তের ভিত্তিতে। অবশ্যি মেধাকে রাখতে হয় বলে রেখেছে তার সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়। তাই মাঝে মাঝে নিম্নবিত্তের পরিবারের থেকে গুটি কয়েক ছাত্র-ছাত্রী কৃতকার্য হলে সংবাদমাধ্যম গুলি দৌড়ে গিয়ে ছবিসহ তাদের জীবনী এবং আর্থিক সংগ্রামের পাশাপাশি কিভাবে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের হারিয়ে এই ভোগবাদী সমাজে প্রথম সারিতে এলো তার বর্ণনার জন্য তাদের সংবাদপত্রের দামী কলামগুলিতে পরিবেশন করে বোঝাতে চায় যে, দেখো এই সমাজে কি সুন্দর সাম্যতা বজায় আছে শুধু তাই নয় ভীষণ যত্ন করে তারা সাধারণ মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যে , তারা শুধুমাত্র বিত্তহীন নয় তাদের মধ্যে কেউবা উপজাতি কেউবা আদিবাসী আবার কেওবা সংখ্যালঘু । সমাজে তাদের এত প্রতিকূলতা তৈরি করেও এদের মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার সংকল্প থেকে হারানো যায়নি। সংবাদমাধ্যমগুলি বার বার ভীষণ সচেতনভাবে প্রচার করে, এই সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পরা শ্রেণীর সন্তানরা এইভাবে বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে , তার মুখ্য কারন সরকাররের জনমুখী পরিকল্পনার নগ্ন প্রচার আর গৌণ কারণ তাদের মেধাশক্তি ।
ভারতবর্ষের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত দুইভাগে বিভক্ত। একটি এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্যটি সাধারণমানের। একটা ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে চাকরির বাজারে এলিট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের স্যালারি প্রায় চার থেকে সাড়ে চার গুন একজন সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের থেকে, ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও তাই।
মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫৪% বর্তমানে ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২১ % স্থানীয় অথরিটি বা কর্পোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৫ % CBSC এবং CISCE-র বোর্ডের আন্ডারে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চলে। ছাত্র-ছাত্রীর হিসাবে ৬০% সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪০ % শিক্ষা গ্রহণ করে। এই মুহূর্তে ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য CBSC এবং CISCE সব মিলিয়ে ৩৪ টি বোর্ড আছে। AICTE APPROVED 4100 UNDER GRADUTE COLLAGE, 4951 POST GRADUATE COLLAGE AND 4594 DIPLOMA করানো হয় এমন ইনস্টিটিউট ভারতে আছে। প্রায় ৪০০ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আছে। সময়ের সাথে সাথে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। তার সাথে পূর্ব ভারতে প্রাইভেট টিউশন নেবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সবার উপরে।
২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে NATIONAL SAMPLE SURVEY'র REPORT অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রাইভেট টিউশন নেওয়া ছাত্রের সংখ্যা মোট ছাত্র সংখ্যার ২১ % ছিল। সেখানে পশ্চিমবাংলায় ৮৪ % (সবথেকে বেশী ) , উড়িষ্যায় (৫৬%) , বিহার (৫৮%), অসম (৬২ %) , তেলেঙ্গানা ( ৫ %) ছাত্র প্রাইভেট টিউশন নেয়।
সরকারী শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার মানের উপর অভিবাবকদের আস্থা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এবং বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর তাদের নির্ভরতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সরকার আর্থিক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সংগঠিত শিক্ষক সম্প্রদায় কখনই প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট আন্তরিক নয়, ঠিক যতটা আন্তরিক নিজেদের দাবি দেওয়া নিয়ে এবং ক্লাসরুমেই তারা প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদের সচেতন করেন। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে অভিবাবকদের পকেটে যেটা ভীষণ বিপদজনক অন্যান্য সব অভাব অভিযোগ থেকে। ফার্স্ট জেনারেশনের (পরিবারের প্রথম স্কুলে যাওয়া ছাত্র ) ছাত্রদের অভিবাবকদের যারা রিকশা বা ভ্যান চালিয়ে উপাৰ্জন করে তাদের ক্ষেত্রে আরও সাংঘাতিক অবস্থা। একটু হিসাব করলে দেখা যাবে টাকার অঙ্কে কোন কোন ক্ষেত্রে নিম্নবিত্তের মোট মাসিক উপার্জনের ১০ % উপর শুধু মাত্র প্রাইভেট টিউশন খাতে বেড়িয়ে যাচ্ছে অথচ সরকার শক্ত হাতে নজর দিলে সাধারণ মানুষ অনেকটাই উপকৃত হতো। পাশাশাশি ভারতবর্ষে GDPর ৩-৩.৫ % বাজেটএ বরাদ্দ করা হয়েছে সেখানে কিউবার মতো ছোট্ট দেশ তাদের GDP র ১২ শতাংশের বেশি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করেছে।
এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইকুইটি ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষে স্কুলে যায়( K-12) এমন ছাত্র সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটির ওপর যা প্রায় ১০ টা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের জনসংখ্যার থেকে বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র ভর্তির সংখ্যা ৩.৭৪ কোটি। বিশ্বায়নের প্রভাবে আর ভারত সরকারের জাতীয় শিক্ষা প্রকল্পে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্ট পলিসি অনুযায়ী (FDI) ১০০ % বিদেশী বিনিয়োগের বাধা নেই। সেই অনুযায়ী এডুকেশন মার্কেটে EQUITY INFLOW হয়েছে ৩,৮৪৯.০০ মিলিয়ন US$ । আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে ভারতে on line education market গিয়ে দাঁড়াবে 11.6 billion US$ | ০-১৪ বছর পর্যন্ত ছাত্রদের শিক্ষা দানের ক্ষেত্র থেকে ১৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রস্তাবিত বাজার আছে। আগামী ২০২৫ উচ্চ শিক্ষার প্রস্তাবিত বাজার ৩৫.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
বর্তমানে ১৮-২৯ বছরের মধ্যে যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ % এবং তার মধ্যে ২০২১ বেকারত্বের হিসাবে প্রায় ২৩.০১ % রেকর্ডেড বেকার। এই বেকারের মধ্যে গ্রাজুয়েট বেকার ১৬.৩ % , পোস্ট গ্রাজুয়েট বেকার ১৪.২ % , সার্টিফিকেট হোল্ডার বেকারের সংখ্যা ১১.০৩ % , ডিপ্লোমা অর্জনকারী বেকারের সংখ্যা ১১.০১ % । সুতরাং শিক্ষা গ্রহণ করলেই চাকরি পাওয়া যাবে তার কোন গ্যারান্টী নেই।
কর্পোরেট আর তার তাবেদার সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষকতার শিক্ষা তার গৌরবকে হারিয়ে পণ্যের আকার ধারণ করেছে। বাজারী পণ্য বিক্রয়ের প্রতিযোগিতার মতো বিদ্যার্থীদের সফ্ট টার্গেট করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নেমে পড়েছে। সর্ব্বোচ শিরোপা যেমন প্রতিযোগীদের মধ্যে সবার জোটেনা ঠিক তেমনি সেই দৌড়ে পিছিয়ে পড়া ছাত্ররা কর্ম জীবন শুরু করার আগে থেকেই স্নায়ু যুদ্ধের শিকার হয়ে যায়। সমাজে যে কোন ক্রিয়ার দুই রকমের প্রভাব আছে, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া যে অসুস্থ হয় সে আর তার সেকেন্ডারি প্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত হয় তার পরিবার, যেমনটি হচ্ছে Covid-19এর প্রাদুর্ভাবে। এই ভাবেই সমাজ এগিয়ে চলে আর প্রতি বছর বেশ কিছু নতুন নতুন অসুস্থ প্রজন্ম এই সিস্টেমের সাইড এফেক্ট হিসাবে তৈয়ারি করে যাচ্ছে।
একটা সত্য এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে পরিবর্তন সব সময় মানব সমাজের শুধুমাত্র উন্নতির জন্য হয়না, অবনতির জন্য হয়, অবশ্য সে ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর উন্নতি হয় কিন্তু তাতে করে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সমাজ তখন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বর্তমানে কর্পোরেট শুধু মাত্র মুনাফা বোঝে আর তার জন্য শুধু যন্ত্র নয় চাই সেই যন্ত্রের ন্যায় একদল মানব যন্ত্রী, যারা শুধু মাত্র প্রতিযোগিতাই বুঝবে আর তৈরী করবে এক প্রতিযোগীমনস্ক এক পরিবেশ, এক সংস্কৃতির। সাধারণ মানুষ এটাকে সঠিকভাবে না বুঝেই এই সিস্টেমের শরিক হয়ে গেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের অভিবাবকদের প্রতিনিয়ত প্রচারে একাত্ম হয়ে গেছে, সে বুঝতে শিখেছে যে স্কুল বেঞ্চে আমার পাশে যে বসে সে হয়ত কোন এক কালে বন্ধু ছিল, পাশে বসে তারা টিফিনটা ভাগ করে খেত, কি এক ভীষণ ঝড় এলো সব কিছুকে ওলটপালট করে দিল, সেদিনের সেই বন্ধুরা আজ তাদের নতুন এক পরিচয় তা হল প্রতিযোগী ( সব বন্ধুদের একটাই একক ) । অধিকাংশ অভিবাবক জানে অনজানে সেই ব্যবস্থার শরিক হয়ে গেছে।
শিশুদের শৈশব বহুদিন আগেই চুরি হয়ে গেছে , (Covid-19 এর প্রভাবে) কাঁচা ঘুম থেকে উঠে সেজে গুঁজে কম্পিউটারের মনিটর বা স্মার্টফোনের সামনে বসে যায় বিদ্যা চর্চায় দূর থেকে অভিবাবকদের সপ্রশংস নজরদারি চলে। পিতামাতার সন্তুষ্টির মাপকাঠিতে শিশুরা এখন থেকেই প্রশংসা আর নিন্দার সাথে কখন যে একাত্ম হয়ে গেছে তা কেউ জানেনা। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুদের সাথে ব্যবহারের রকমফেরে তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়াটি হয় তার বিষময় পরিনাম ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়। তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
কর্পোরেটের প্রচারের আলোকে আলোকিত নিরীহ অভিবাবকগন দিবাস্বপ্ন দেখেন বিজ্ঞাপনের সেই তরুণ-তরুণীদের, যেই স্থানটা তাদের সন্তানসন্ততিরা আগামী দিনে ঝকঝকে পোশাকে নিজেদের আবৃত করে কর্পোরেটদের সেবা করতে যাবে । ঘরের কোর কমিটিতে চাপা স্বরে আলোচনা করবে কত CTC হোল, ননদের ছেলেটার থেকে একটু বেশি, যাক বেশ ভালো লাগছে। ধীরে ধীরে কখন যে সাধারণ মানুষ নিজের অজান্তে এক নতুন না জানা সংস্কৃতির বাহক হয়ে গেছে, সে নিজেই জানেনা , যার নাম CORPORTE CULTURE |
ক্রমশঃ
মন্তব্যসমূহ