মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান-ষষ্ঠ পর্ব

 মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান-ষষ্ঠ পর্ব 

 
(মহাভারতের নৈতিকতা)



পূর্ব অধ্যায়ের সূত্র -  ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদনের জন্য  দ্বিতীয়বার বেদব্যাসের  হস্তিনাপুর আগমন এবং   অম্বালিকার  সাথে মিলন । 

জনান্তিকে  বেজে ওঠা গুন গুন  সুরটা ধীরে ধীরে সুরের প্রারম্ভিক চরিত্রকে অতিক্রম করে অম্বিকার মহল থেকে  একেবারে  হস্তিনাপুরের অন্দরমহলের চার দেয়ালে ঘুরতে লাগলো।  যে কোন কাহিনীর বিন্যাসে দুটি পরস্পর বিরোধী চরিত্র এবং তার সাথে দ্বন্দ্ব না থাকলে মানুষ  সচেতনভাবে মনের অন্দরে  জায়গা দেয় না আর সেটা যদি ভীষণ সংবেদনশীল প্রসঙ্গ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। অম্বিকার সেই সৃষ্ট কাহিনীর মুখ্য পরষ্পরবিরোধী  চরিত্র ভীষ্ম আর মহাভারতের কবি  এবং পার্শ্ব চরিত্র হিসাবে আছেন  সত্যবতী। 

প্রত্যেক রচনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিভঙ্গিটি বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়।  এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। যে অসহনীয় পরিস্থিতির চাপে অম্বিকাকে মহাভারতের কবির শয্যাশায়িনী হতে হয়েছিল তার তো একটা মানসিক প্রতিক্রিয়া থাকাটা স্বাভাবিক।  হস্তিনাপুরের সাংবিধানিক প্রধান ভীষ্ম, তিনি জন্মসূত্রে আর্য্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। পক্ষান্তরে সত্যবতী এবং ব্যাসদেব অনার্য্য সম্প্রদায়ের ধ্জ্জা বহনকারী । একের পর এক ক্ষেত্রজ পুত্রের মানবীয় পিতার স্থানে অভিষেক ব্যাসদেবের। সেক্ষেত্রে আগামীদিনে সত্যবতীর নেতৃত্বে  অনার্য সন্তানের  প্রাধান্য হস্তিনাপুরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন এই রাজ্য দুই পরস্পর বিরোধী বর্ণের প্রতিনিধিদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের  ক্ষেত্ৰভূমি হয়ে উঠবে না তো ? এই  প্রশ্নটাকে সামনে রেখে অম্বিকা এক  অকালীন রাজনৈতিক  বিতর্কের  জন্ম দিয়েছিল।  

সমগ্র কাহিনীর সূত্রপাত হলো অম্বালিকার  এক দুর্বল পুত্র সন্তান পান্ডুর জন্মের পর। যখন  সত্যবতী  পুনরায় সন্তান উৎপাদনের অভিলাষ নিয়ে  অম্বিকার শরনাপর্ন  হলেন, ঠিক তখন । কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব হস্তিনাপুর পৌছিয়ে এই সংবাদের মর্মার্থ অনুভব করলেন। 
   

এই প্রশ্নের অবকাশ নেই কেননা ক্ষেত্রজ পুত্রের উৎপাদনের ক্ষেত্রে তৎকালীন সমাজে "নিয়োগ " বলে একটা প্রটোকল ছিল। তার ব্যাখ্যায় পরিষ্কার বলা আছে, যে উৎপাদনে নিয়োজিত চাষীর উৎপাদিত ফসলের উপর কোন দাবী থাকবেনা।  আর যাই হোক সে সময়ে কোন বিপ্লবী সংগঠন না থাকাতে কৃষকের ফসলের অধিকার নিয়ে কোন গন আন্দোলন হয়েছিল বলে জানা যায় নি। মহাভারতের ক্ষেত্রে সেটা গোপন গভীর অন্ধকারে ধীরে ধীরে তার ভ্রুন প্রোথিত হয়েছিল। সেই মহলে ছিলোনা কোন আলো বাতাসের আগমন,  তাই  লাগাম পরা ঘোড়াটা সেই আস্তাবলেই বাধা ছিলো, সাধারনের নজরের বাইরে। 

রামায়ন আর মহাভারতে একটা নজর কারার মতো ঘটনা অন্তঃপুরের নারীদের রাজনৈতিক কুশলতার । তার সুদূরপ্রসারী ফল কি হয়েছিল তা রামায়ন ও মহাভারতের পাঠকদের মনে আছে। রামায়নে কামুক রাজা দশরথ অযাচিত বরদান  (কমিটমেন্ট) দিয়ে রানী কৈকেয়ীকে রঘু বংশের স্টিয়ারিংটা  হাতে দিয়ে লঙ্কাকান্ডর মতো ঘটনার পরোক্ষ কারনের উত্তরদায়িনী করে দেয়।  মহাভারতেও শান্তনুর বৃদ্ধ বয়সে অল্প বয়সী নারীদের প্রতি দুর্বলতা হস্তিনাপুরের আগামী দিনের রাজনীতির একটা টার্নিং পয়েন্ট করে দিয়েছিল।  সেক্ষত্রে বিদুষী নারী অম্বিকা যে একটু আধটু রাজনীতি করবে সেটা বলা বাহুল্য। একটা ঘটনা উল্লেখ না করে পারা  যাচ্ছে না, তা হল কামনা বাসনার কাছে বর্ণ বিভাজন শব্দটা ছিল  ভীষণ অপ্রাসঙ্গিক। আর্য  ও অনার্য্যদের মধ্যে সে ক্ষেত্রে কোন ব্যবধান ছিল না  যদি  তার  নায়ক  শক্তিশালী পুরুষ হয় তবে  তার তো সাত খুন মাপ।  আবার এই মহাভারতে পরবর্তী অংশে দেখ যাবে শূদ্রের  বেদ চর্চার জন্য  শাস্তির  সুপারিশ। সারা মহাভারত জুড়ে একটা শব্দের আগে আরেকটা শব্দ (prefix) জুড়ে দিয়ে এক অদ্ভুত ফ্যালাসি (ভ্রান্তি) তৈরি করেছে , সারা মহা ভারত জুড়ে পাঠকরা পেয়েছেন, তা হলো "প্রয়োজন " শব্দটি ।  

বর্তমান রাজনীতিতে এই " প্রয়োজন " শব্দটির  বহুল প্রয়োগের দৃষ্টান্ত পাই।  এই প্রয়োজনকে ( এখানে লক্ষ্যটাই প্রয়োজনের নামান্তর )  সামনে রেখে নৈতিকতাকে ( logicএর মাধ্যমে ) লাভ ক্ষতির অঙ্কে সমাধান করে এবং সেই অনুযায়ী সূত্রের বর্ণনা দিয়ে  কার্যক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি বাজিমাত করে বেরিয়ে গেছে। আজ সত্যিকারের মহাভারতের বহু দুর্নীতিকে কঠিনভাবে অনুসরণ করে  শুধু মাত্র নীতির মোড়কে বেঁধে পরিবেশন করলে  রাজনীতির যুদ্ধে জয় অনিবার্য- এটা আজও  প্রাসঙ্গিক। তাই  মহাভারত  কালকে অতিক্রম করে মহাকাব্যের আকার ধারণ করেছে। আবার সেই প্রয়োজনই  বাধ্য করেছে আধুনিক পরিসংখান বিদ্যার সাহচর্য আর ডাটা কলেকশনের ফরম্যাট, ডাটা এনালিসিস  ইপ্সিত উত্তরের জন্য  আর তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মডার্ন মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টের বিপণনের নজরকাড়া শ্লোগানে আর কিছু প্যাচ ওয়ার্কএ  বাজিমাত । তবে প্রয়োজনের প্রকৃত অর্থ বের না করে শুধু আদর্শের গল্পে চিড়ে ভিজবেনা, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে আজ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে।  

এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, রাজনীতির জন্ম অন্দরমহলের খাবার টেবিলে শুরু হয়ে শয়নকক্ষের চারদেয়ালে পরিপক্ক হয়, তার ফলশ্রুতি হিসাবে বহু পরিবারে ঘরের মধ্যে অনেক ঘরের জন্ম দিচ্ছে , যেখানে পর্যাপ্ত ঘর নেই সেখানে স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য নিদেনপক্ষে চুল্লিটা আলাদা করে পারস্পরিক বিভেদের সাক্ষ্য বহন করে চলছে । অর্থাৎ মানুষ   " আমিত্বের " ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে আষ্টে পিষ্টে বাধা।   

মহাভারতের কবির সন্ন্যাসী জীবনের  চর্চিত বিষয়ের বাইরে এই রাজনীতি কিন্তু  তার অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা ছিল পরিসন্ধান যন্ত্রের থেকেও আরো বেশী আধুনিক। একদিকে তার মাতা সত্যবতীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ অন্যদিকে অম্বিকার বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু অপরিণত রাজনীতির প্রয়োগ, বেদব্যাস এবং ভীষ্মের মধ্যে সংঘাত বাধানোর। 

এবার অম্বিকা তার পরিবর্তে এক অপরূপা শূদ্র রমণীকে ( সারা মহাভারত খুঁজে সেই শূদ্র রমণীর কোনো নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি )   বেদব্যাসের অঙ্কশায়িনী রূপে তার  অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিল পরবর্তী সন্তান উৎপাদনের জন্য। দুইজনেই  শূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত, সাঙ্ঘাতিক তার রসায়ন। পালঙ্ক থেকে শুরু করে ঘরের আসবাবপত্র, জানালা দরজা, দেওয়াল সেই সঙ্গমের নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো আর ফল স্বরূপ আগামীদিনে হস্তিনাপুরে জন্ম নিল এক আর্দশবান, ধর্মের জন্য নিবেদিত প্রাণ এক সুপুরুষের, বলা বাহুল্য সে হলো মহামতি বিদুর। 

  
ক্রমশঃ 

.                                                                                 
(বিঃ দ্রঃ লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন )






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়