আমি মহাভারতের পৃথা --প্রথম পর্ব
আমি মহাভারতের পৃথা -প্রথম পর্ব -
আগুনের প্রজ্জ্বলিত লেলিহান শিখা লক্ষ্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌছিয়ে তার ধীরে ধীরে তার সব জৌলুশ হারিয়ে ফেলে নিকষ কালো ধোয়া হয়ে উড়ে গিয়ে সেই মহাকাশের বিশাল বক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করে আর শুধু এই পৃথিবীর মানুষদের জন্য রেখে যায় প্রিয়জনের অস্তিত্বের অস্তিত্ব হারানোর একরাশ স্মৃতির বোঝা। অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা হারানোটাই হচ্ছে মৃত্যু। অস্তিত্ব না থাকলে যেটা থেকে যায় সেটাই হচ্ছে স্মৃতি। অগ্নি এই কাজটি নিরলসভাবে করে যাবে যতক্ষণ না শেষ নিস্প্রান দেহটা কুরুক্ষেত্রের মাটি থেকে মুছে না যায় ।
সবে শেষ হল দীর্ঘ আঠারো দিনের রক্তক্ষয়ী মহা যুদ্ধের। কুরুক্ষেত্রের এই মাটিতে মৃত্যু সবাইকে এক করে দিয়েছে। আজ তারা কেউ রথী নয় , কেউ তাদের মহারথী বলেও সম্বোধন করবেনা, সৈনিককেও কোনদিন অস্ত্র নিক্ষেপ করতে হবেনা , আর বাহনদের বইতে হবে না তাদের ইহকালের বোঝা, মৃত্যু এসে তাদের পার্থিব সব পরিচয় কেড়ে নিয়ে শুধুমাত্র এক নতুন পরিচয়ে সম্বোধিত করেছে যে এরা সবাই নিস্প্রান এক স্থুল শরীর ভিন্ন অন্য কিছু নয় । কালকে যাদের নাম , পদবী , পদমর্যাদা নিয়ে গর্বের অন্ত ছিলনা, মৃত্যু এসে সব কেড়ে নিয়ে নির্মম ভাবে ওই চিতায় চির নিদ্রায় শায়িত করে বার্তা দিয়ে গেল স্বাতন্ত্রতার ভাবনা তোমাদের মিথ্যা অহংকার। এই মৃত্যুর সরণীতে কুরুক্ষেত্রের বিশাল প্রান্তর যেখানে বীরের দর্পে রণভূমির আকার ধারণ করেছিল তা আজ থেকে মহা শশ্মানের অভিমুখে গিয়ে তার যাত্রা শেষ করছে।
দূর থেকে স্বজন হারানোর হৃদয়বিদারক আর্তনাদ পৃথার কানে ভেসে আসছে। সেই কান্নার সুরের মূর্ছনা পুত্রহারা জননী পৃথার ব্যাথার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। পাণ্ডবদের এই যুদ্ধ জয় ক্ষত্রিয় নারীর হৃদয়কে গৌরবের পরিবর্তে বিদীর্ন করে দিল কেন ? এর উত্তরদায়িনী কেবলই পৃথা।
যে বীজ একদিন অংকুরিত হয়েছিল মথুরার মাটিতে, রাজা শূরসেনের রাজতালুকে, জন্ম লগ্ন থেকে সেই আকাশে বাতাসে বুক ভরে ঘ্রান নিয়েছিল আর কবে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, গাছপালা, রং-বে রঙের প্রজাপতি, প্রাত্যহিক কত নাম না জানা পাখীর কলতানের সাথে , বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ, ছোট ছোট খেলার সাথী আরো কত কি। সেটাই ছিল তার সেই ছোট্ট একটা পৃথিবী। একদিন সেই চারাকে ভূমি থেকে উৎপাটিত করে রোপন করা হল মহারাজ কুন্তিভোজের আঙিনায়। পৃথার জীবনের প্রাকমুহূর্তের তাল আর ছন্দ সমাজের পাঁচটা শিশুদের মতো সহজ সরল গতিতে বয়ে যায়নি বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন লয়ে জীবন তার গতিপথ রচনা করেছিল।
প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে কোন এক দিন পৃথার জীবনের গতি শৈশবকে পিছনে ফেলে কৈশোরের অভিমুখে যাত্রা শুরু করল। অঙ্কুরিত ফুলের প্রকাশের ন্যায় বাঁধ ভাঙা সৌন্দর্য্যের ছটা, বেশ ঘটা করে পৃথার সারা অঙ্গে ছড়িয়ে দিয়ে গেল । এই উত্তরণ কখন কোথায় কিভাবে তার জীবনে এলো কেউ তাকে চিহ্নিত করে দেয়নি , ধীরে ধীরে সম্বিৎ ফিরে পেল যখন আসে পাশের পুরুষের একঝলক বক্র দৃষ্টির অভিব্যক্তিতে। সেই চাহনিরা অঙ্গের বিশেষ কতগুলি স্থানে কি যেন খুঁজে বেড়াত । সেই চাহনির ভাষা কালের নিয়মে অল্পবিস্তর বুঝতে শিখল। এই সময়টা পৃথার ভীষণ মনে পড়ত সেই বহুদূরে মথুরা নগরীতে পিতার নিলজ্জ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বাৎসল্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত সেই দুঃখিনী মা'য়ের কথা। যাকে আজ অনেক না বলতে পারা কথা বলার ছিল, যা একমাত্র মা'কেই বলা যায় ।
জীবনের মানসপটে বাস্তবের অভিজ্ঞতা প্রতি মুহূর্তে বহু ছবি এঁকে যায়, কেউ তাকে পড়তে পারে আবার কেউ তা পারেনা। পিতৃদত্ত 'পৃথা' নামটা এ বাড়িতে এসে কবে যেন হারিয়ে গেল, বিস্মৃতির বিড়ম্বনা এড়াতে রাজ্যের উপসর্গকে সম্বোধনের সাথে একাত্ম করে 'কুন্তী' পরিচয়ে মহাভারতের পাতায় নতুন পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হলো পৃথা। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যে বয়সটা চিহ্নিত হয়, কুন্তীর মনের বয়সটা তাকে পিছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এই বয়সেই অন্তঃপুরের আলমারির চাবির গোছার মালকিন পৃথা। স্বভাবতই, কৈশোরের চাঞ্চল্য তার গৌরবকে হারিয়ে এক অসময়োচিত ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী হয়ে উঠেছিলেন। কিছুদিন ধরে একটিই আলোচনা রাজসভায় আলোচিত হতে শুরু করে ছিল যে, ঋষি দুর্বাসা কুন্তিভোজ রাজ্যে অজাচিতভাবে অতিথি হয়ে আসবেন। সে যুগে ঋষিদের আপ্যায়ন করার রেওয়াজ ছিল কিন্তু দুর্বাসার ন্যায় বদমেজাজি ঋষিকে মোকাবিলা করা বেশ কঠিন এবং তার সাথে আছে কোন ত্রুটি হোলে অভিশাপের ভয়।
পালিত পিতা কুন্তিভোজের সাথে পৃথার দীর্ঘ সভা চলল, তার বিষয়বস্তু ছিল অতিথিটি কেমন, তাকে কি ভাবে সমাদর করতে হবে, এই অভ্যার্থনা তাকে যদি প্রীত করে তাহলে রাজা তথা সমগ্র রাজ্য কি ভাবে উপকৃত হতে পারে আবার কুপিত হলে ঠিক তার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার রাজ্যপাট এবং পরিবার কি ভাবে অনিবার্য ধংসের মুখোমুখি দাঁড়াবে ইত্যাদি বর্ণনা করলেন। আধুনিক রিসেপশন ম্যানেজমেন্টের কোর্স এবং কি ভাবে আফটার সার্ভিস দুর্বাসার কাছ থেকে তার সন্তুষ্টির মান হিসাবে ৫ ষ্টার পাওয়া যেতে পারে তার পুরো কোর্স ম্যানুয়াল রাজা কুন্তিভোজ বানিয়ে দিলেন তার ছাত্রী পৃথাকে।
হঠাৎ পৃথার ভাবনার সংযোগটা বিচ্ছিন্ন হল দ্রৌপদীর 'মা' ডাকে। দিনমনি সারাদিন ধরে একনাগাড়ে আলোর ধারা পৃথিবীতে বর্ষণ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরুকরে দিয়েছে , অন্যান্য দিনের মতো কুরুক্ষেত্রের আশেপাশের গাছে পাখিরা কলরব করে আজ আর ফিরে এলোনা, সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে ,পাখিরা হয়তো বুঝতে পেরেছে এটা নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করার সময় নয়, এটা শুধু প্রার্থনা মন্ত্র মনে মনে উচ্চারিত করার সময় এত সব জীবের আত্মার সদ্গতির জন্য তাই চাই শান্তির নিয়ন্ত্রিত বাতাবরণ ।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
বি. দ্রঃ ভালো লাগলে শেয়ার করুন।
মন্তব্যসমূহ