আমি মহাভারতের পৃথা - দ্বিতীয় পর্ব
আমি মহাভারতের পৃথা - দ্বিতীয় পর্ব
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিগন্তের রবির কিরণ কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে নব প্রভাতের সূচনা করল । গত কাল যারা অতিথির (অগ্নির আরেক নাম) হাত ধরে স্বর্গের যাত্রা পথে অপেক্ষামান অবস্থায় ছিলেন, আজ তাদের নিয়ে যাত্রার প্রবন্ধ রচনাতে মহাকাল দন্ডায়মান। স্বজনহারা এই মহাশশ্মানে প্রিয়জনদের শেষ যাত্রার সাক্ষী হিসাবে পৃথা আজ ও উপস্থিত হয়েছেন সেই ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে। বর্তমান জানতে চাইলো অতীতের কাছে থেকে এই পরিণতির জন্য উত্তরদায়িনী কে ?
একে একে অতীত থেকে পাতাগুলি ভীষণ অবিনস্ত ভাবে নাড়া দিতে লাগলো পৃথার ভাবনার অলিন্দে। তার কোনটি যেমন জীবনের খোলা চিঠি , কোনটি আবার আবরণে যত্নে ঢেকে রাখা। মহাভারতের রূপকার কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব পৃথার জীবন থেকে যা কিছু সংগ্রহ করেছেন সেটাই তিনি মহাকাব্যের পাতায় খোদাই করেছেন। তার মধ্যে কিছু অতিনাটকীয়তার সংযোজন অবশ্যিই আছে, যেটা কাহিনীকারের সাহিত্য সৃষ্টির স্বাধীনতার মধ্যে পরে কিন্ত তার বাইরেও কিছু অপ্রকাশিত ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী হয়ে থাকে যে স্মৃতি, সে মাঝে মাঝে অতীতের গর্ভ থেকে উঠে এসে বর্তমানকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দেয়, তাকে কিন্তু মহাকাব্যের কুশীলবরা নিজের মধ্যে সেটা সযত্নে লালন পালন করেন, তাকে কখন সার্বজনীন করে তোলেন না। হয়ত বাস্তবতার দিক থেকে সেদিনের সিদ্ধান্ত হয়ত বা সময়োপযোগী ছিল ।
যে অবিদ্যা, যে অস্মিতা পৃথার অন্তরকে রাগ আর দ্বেষের আবরণে মুড়ে দিয়ে উৎসাহিত করেছিল এই মহাযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য , পান্ডবদের যুদ্ধে উৎসাহিত করার জন্য , আবার সেই নারীই যুদ্ধের বিভীষিকা প্রতক্ষ্য করে তারই কন্ঠে খানিকটা স্বগোক্তির মতো উচ্চারিত হল - "যুদ্ধ এক ভয়ংকর ধ্বংস লীলার শেষ নিদর্শন , এর মধ্যে গৌরবের কিছু নেই"।
যে অহংকার থেকে পৃথা কামনা করেছিল পান্ডব পুত্ররা হস্তিনাপুরের সিংহাসনে অভিষিক্ত হোক। যদিও তার চাইবার পিছনে যথেষ্ট সংগত কারন ছিল এবং তার সাথে ছিল নিজ পুত্রদের রাজ্য পুনরুদ্ধারের শক্তির অহমিকাও ছিল পৃথার মনে। অপূর্ন কামনা থেকে একরাশ দ্বেষ ক্ষত্রিয় রমণীকে কৌরবদের পতন কামনায় ব্যাকুল করে তুলেছিল, আজ তার অবশিষ্ট কিছুই নেই এই শশ্মানের দীপ্যমান শিখার আগুনে মৃত্যু ঘটেছে সেই মোহের আর সেই আসক্তির।
আজ পৃথার অন্তরে দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তি ভীষণ সক্রিয়, যারা এতদিন কামনা বাসনার আড়ালে নিদ্রিত ছিল। বিজিতদের মৃত্যুর উপরদিয়েই জয়ের সৌধ নির্মাণ হয় , এটাই বাস্তব, যুদ্ধ ভালো বা মন্দ যাই হোকনা কেন। কৌরবরা অধর্মের কাজ করেছে, কেননা তারা সেটাই সঠিকভাবে জানতো। এই যুদ্ধে মহাবীর কর্ণের মৃত্যু বাস্তবতার ভিত্তিতে এক অবিশ্বভাবী ফল যেটা পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়েই ছিল। কিন্তু পৃথা এই ব্যাকুলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না। সত্যদ্রষ্টা পৃথার এই ভাবের ব্যাখ্যা তাকে নিজেকেই দিতে হবে।যেখানে একদিকে তিনি বলছেন তার মোহের মুক্তি হয়েছে , আবার অন্য দিকে জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুজনিত আকুলতা , এটা তো মায়ারই নামান্তর। এই বাঁধন থেকে মুক্তি না পেলে আবার তো কামনা বাসনার আগুনে আহুতি দিতে হবে আর মোক্ষ তখন হয়ে যাবে সূদূর পরাহত।
সেইদিন বৃষ্টি যেন পণ করেছিল রূধির পৃথিবীকে শীতলতায় ভরিয়ে দেবে বলে। এমনই এক সময় দীর্ঘদেহি সমগ্র মুখমন্ডল শ্বশ্রুতে আবৃত, সমস্ত অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে এক উজ্জ্বলতার বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি, সেই ঋষি দুর্বাসা কুন্তিভোজের রাজদ্বারে উপস্থিত। দ্বারী মারফৎ সংবাদ পেয়ে রাজা কুন্তিভোজ রাজসভা ত্যাগ করে তৎপরতার সাথে ঋষি দুর্বাসার সামনে উপস্থিত হয়ে সমাদর সহকারে রাজগৃহে বরণ করে নিয়ে এলেন। এসেই তিনি ঘোষণা করলেন আজ থেকে অনির্দ্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তিনি এই রাজ্যের আতিথিয়তা গ্রহণ করবেন। শুধু তাই নয়, তিনি এও জানালেন যে, তিনি যখন খুশি বাইরে যাবেন এবং ফিরে আসবেন তার ইচ্ছা মতো, কেউ যেন এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন না করেন কিন্ত যখনি আসবেন তখন যেন তার যাবতীয় আয়োজনের ত্রুটি না থাকে।
বরনারীরা উলু আর শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে, ফুল চন্দন দিয়ে এবং রাজপুরোহিতরা বেদ মন্ত্র উচ্চারণ সহযোগে ঋষিকে অভ্যার্থনা জানালেন। অত্যন্ত আত্মতৃপ্তি সহকারে অন্দরমহল অতিক্রম করে নির্ধারিত অতিথিশালায় এসে আসন গ্রহণ করলেন।
পৃথার সুদীর্ঘ জীবনে বহু মুনি ঋষির সংস্পর্শে এসেছিলেন কিন্তু ঋষি দুর্বাসার মতো স্বেচ্ছাচারী ঋষির ন্যায় কাউকে পাননি। তার আসা যাবার নির্ধারিত কোন সময়সূচি ছিলনা। কিন্তু যখনি আসবেন তখনিই তার স্নানাদি থেকে শুরু করে ভোজনের সমস্ত ব্যবস্থা করতে হবে এবং অবশ্যিই তার পছন্দমত ব্যঞ্জনসহ। বাস্তবে কখন সখন মধ্যাহ্নের আহার মাঝ রাত্রিতে পরিবেশন করতে হতো। মাঝে মাঝে যে ব্যঞ্জন সেদিনে হবার কথা নয়, তাৎক্ষণিক সেটা তার আদেশে বন্দোবস্ত করতে হতো। এই ভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিভাবে চলে গেল তা ভাবলে আজও পৃথার শরীরে কাটা দেয়। দীর্ঘ এক বছর যেন এক যুগের সমান। প্রতিদিনের এই অসহনীয় পরিবেশকে ভীষণ যত্ন সহকারে কিছুই হয়নি সেরকম এক ভাবলেশহীন প্রতিমূর্তি হয়ে তাকে সেবা করে যেতে হয়েছে ।
অবশেষে ঋষি দুর্বাসার নিরলস আব্দারের এক ধারাবাহিক অমানবিক অধ্যায়ের উপর যবনিকা নেমে এলো। তার কুন্তিভোজ ত্যাগের ঘোষণা মৃতপ্রায় রাজপ্রাসাদের কোনে কোণে যেন প্রাণের জোয়ার এনে দিল।
পৃথার সারা অঙ্গ জুড়ে রূপ ও সৌন্দর্য প্রকাশের ছটা থেকে কঠোর সংযমে আবদ্ধ ঋষির চিত্ত বৈকল্য যে উপস্থিত হয়নি তা জোর করে বলা যাবেনা।যেন ঋষি বলছেন,"বারে বারে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গনের ধারে,ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিলনা একবারে "। তার প্রতিচ্ছবি কিন্তু পৃথার নজরে বহুবার বন্দী হয়েছে। শুধু একটা কৃত্তিম গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে এযাত্রা থেকে উত্তরণ ঘটানো গেছে। মদনের শরে তিনি যে বিদ্ধ হয়েছিলেন এ সম্পর্কে পৃথার মনে সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না যখন, ঋষি যাবার সময় যে বর পৃথাকে দান করে গেলেন, সেটা তো তারই বহিঃপ্রকাশ। পৃথার আন্তরিক অতিথি পরিচর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ঋষি দুর্বাসা সন্তানরূপী কন্যাকে দেবতাদের সাথে সঙ্গম করার মন্ত্র অসময়োচিত ভাবে তার কানে শুনিয়ে গেলেন একরকম জোর করেই সেটা তো তারই প্রকাশ। পাছে দুর্বাসার রোষে পড়তে হয় তাই পৃথা বাধা দানের কোন চেষ্টা করেন নি।
নিষিদ্ধ ফলের প্রতি চিরকালই মানুষের অদম্য কৌতূহল। মহাভারতের অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র কুন্তীর ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম হলনা। এই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে কোন এক সূর্য্যস্নাত প্রভাতে শুধুমাত্র দুর্বাসার মন্ত্রবলের পরীক্ষা নেবার জন্য পৃথা তার মখমলে বিছানায় অর্ধশোয়া অবস্থায় সূর্য্য দেবতাকে মন্ত্রবলে আহবান করলেন। ক্ষনিকের মধ্যে সমগ্র ঘর আলো করে স্বর্ণময় কবচ কুন্ডল পরিহিত সুদর্শন পুরুষ শয্যার প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন। সূর্যদেবতাকে দেখে কিছুক্ষনের জন্য কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেলেন পৃথা, তার চোখমুখে মানবীকে ভোগের অদম্য পিপাসায় ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। আতঙ্কিত পৃথা করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন দেবের কাছে যে, একান্ত খেলার ছলে তিনি আহবান করেছেন, এর মধ্যে তার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। নাছোড়বান্দা দেবতা কুমারীত্ব হরণ না করে তিনি যাবেন না। বহু মধুর সম্বোধনে পৃথার কাছে অঙ্গীকার করলেন এক কবচ কুণ্ডল নিয়ে এক সুদর্শন পুত্র তিনি পৃথার গর্ভে উপহার দেবেন আর পুত্র সন্তান জন্মের পর পৃথার কুমারীত্ব তার জীবনে প্রতিষ্ঠত হবে অর্থাৎ অবাঞ্চিত যে মাতৃত্ব সূর্যদেবের কারনে হয়েছে তার নাম ও নিশান কিছুই থাকবেনা। অন্যথায় এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। মানবীর কোন ওজর আপত্তি দেবতার কাছে টিকলোনা। দেবতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তার চিরাচরিত বিশ্বাসের যে মিথ্যা ধারণা ছিল আজ প্রত্যক্ষ হল দেবতারূপী অসুরের আসুরিক প্রবৃত্তির সাথে। নিমরাজি কিশোরী কন্যার উপর এক পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন এঁকে দিলেন। দেব সঙ্গমের দীর্ঘসময় ধরে ভোগের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে কখন যে পৃথা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল তা নিজেই জানেন না, অচেতন অবস্থাতেও তিনি নিষ্কৃতি দেন নি এই মানবীকে।
দীর্ঘ এই দশমাস দশদিন নিজের গর্ভকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন তা একমাত্র পৃথা আর তার ধাত্রীই জানেন। যথা সময়ে সোনার বর্ম আর কুণ্ডল নিয়ে এক সুন্দর পুত্র পৃথার গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করলো। এই কুমারীর মেয়ের সন্তানকে সমাজ কি ভাবে নেবে এই চিন্তা মাতা পৃথাকে ভাবিত করে তুলল। অবশেষে সন্ধ্যালগ্নে লোকচক্ষুর অন্তরালে ধাত্রীকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে একটি বেতের পেটিকায় বহুমূল্য কাপড়ের উপর শিশু পুত্রকে শুয়ে দিয়ে অশ্বনদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন।
আজ কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে জীবনের প্রথম লগ্ন থেকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত সুতগৃহে পালিত মহারথী , দানবীর কর্ণ চির নিদ্রায় শায়িত। এই যুদ্ধে দুই মহাবীর অংশ গ্রহণ করেছিলেন। একজন ধর্মের পথে চালিত হয়ে অস্ত্র সংবরণ করে বিজয়ী হয়েছিলেন, তিনি যাদব শ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ আর আরেকজন অধর্ম জেনেও শুধুমাত্র সঙ্গীর প্রতি দায়বদ্ধতায় অস্ত্র ধরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তিনি হলেন কর্ন।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ