আমি মহাভারতের পৃথা : ষষ্ঠ পর্ব
আমি মহাভারতের পৃথা : ষষ্ঠ পর্ব।
লবনের আস্বাদ যেমন রান্নার রসনাকে বাড়িয়ে তোলে, ঠিক তেমনি সাহিত্যের আদিরস পাঠককে কাহিনীর প্রতি তার আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলে। পাঠকের সেই আকাঙ্খাকে মাথায় রেখে লেখনীও তার চরিত্র নির্মাণের ও গল্পের বিন্যাসে তাকে মোহময় করে তোলে। সেই সাহিত্য এককালীন পাঠক পায় বটে কিন্তু সাহিত্য তার দীর্ঘ জীবন পায়না।
সমাজে যখন কোন নারী চরিত্রের বিশুদ্ধতার প্রশ্ন যখন উত্থাপিত হয়, তখন পুরুষশাসিত সমাজের কর্তারা যারপরনাই মুখরিত হয়ে উঠেন। কেননা, তাদের কৃতকর্ম থেকে সমাজের দৃষ্টিকে আড়াল করার ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে উঠে সবথেকে উৎকৃষ্ট উপাদান। যৌনতাকে বাদ দিয়ে যে চরিত্রকে যে আকর্ষণীয় করা যায়, এই অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী মহাভারতের কবি ব্যাসদেব। পাঠকের রসনা তৃপ্ত হয় সাহিত্য রচনার গুনে।
ক্লাসিক সাহিত্যের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। তাই বিতর্কের উর্ধে উঠে বলা যেতে পারে, যে সাহিত্য তার সৃষ্টির মাধুর্য্য দিয়ে এক সর্বকালীন প্রভাবে সমাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে এবং সেটাকে ফুটিয়ে তুলবে তার শৈল্পিক সুষমায় আর সেখানে সমাজে প্রতিফলিত হবে এক সার্বজনীন আবেদন - সত্যম ,শিবম, সুন্দরমের ভাবনার , যেখানে শিল্পী ও সাহিত্যিক তার সৃজনশীলতার বিকাশের ক্ষেত্রে শিল্পের সীমারেখাকে কখনই অতিক্রম করবে না। সেটাই হবে যথার্থ ক্ল্যাসিক বা শাস্ত্র সম্মত সাহিত্য।
একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েও মহাভারতে পৃথার চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে পাঠক কখন মনে করেননি পৃথা স্বৈরিণী ছিলেন । বরং বেদব্যাসের নিপুন তুলির রেখায় মহাভারতের প্রেক্ষাপটে পৃথাকে , ভারতবর্ষের পঞ্চ প্রাতঃস্মরণীয় নারীর মধ্যে অনন্য এক নারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
( গত সংখ্যা "আমি মহাভারতের পৃথা -পঞ্চম সংখ্যা"র পর ).
সর্বজ্ঞ ঋষি ব্যাসদেব জানতেন পান্ডু প্রজনন ক্ষমতাহীন, তার প্রতি মমত্বের কারনে কিন্দম মুনির অভিশাপের উপাখ্যানটা সংযোজন করে তার অক্ষমতাকে ঢাকতে চেষ্টা করেছেন। পান্ডু তার বিবাহের পরে পরে শিকারের নাম করে নববিবাহিত স্ত্রীদের রাজপ্রাসাদে রেখে বেরিয়ে যান, যেটা পৃথিবীর ইতিহাসে নববিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে শোনা যায়নি । পুনরায় দুই স্ত্রী-সহ লোকালয় ছেড়ে অরণ্যবিলাস পান্ডুর মানসিক অস্থিরতাকে, গ্লানিকে আড়াল করার চেষ্টা ব্যাতিত কিছু নয়।
প্রত্যেক রাজার বাসনা থাকে তার উত্তরসূরীর মধ্যে বেঁচে থাকার। অপারক রাজার সাংঘাতিক ইচ্ছা আছে কিন্তু সামর্থ নেই , দুই দুটি ক্ষেত্র আছে কিন্তু তাতে ফসল ফলানোর মতো ক্ষমতা নেই। সেক্ষেত্রে সমাজে স্বীকৃত ছিল "নিয়োগ" পদ্ধতির, তার মাধ্যমে পুত্র কামনার ইচ্ছুক দম্পতি, এই পদ্ধতিতে এই সংকট থেকে পরিত্রান পেত। নারীর ইচ্ছা ও অনিচ্ছা এক্ষেত্রে গৌণ ছিল। পৃথাকে দেওয়া দুর্বাসার বশীকরণ মন্ত্র পান্ডুর কামনার আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ দিল। পান্ডুর দুর্দমনীয় বাসনাকে পৃথা সন্মান জানিয়ে সম্মতি দিলেন।
মানুষের অবচেতন মনে ধর্ম বাস করে আর সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে ধর্মরাজকে প্রার্থনা জানালেন এই শুভকাজটি করার জন্য। যথা সময়ে শতশৃঙ্গ পর্বতের গভীর অরণ্যেকে বাসরঘর করে পৃথাকে নিয়ে ধর্মরাজ পুত্র উৎপাদনের কাজটি সম্পূর্ণ করে আশীর্বাদ করে গেলেন এক সত্য ও ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান পুত্র তিনি লাভ করবেন। প্রথম পুত্র লাভ করার পর পান্ডুর পৃথার মন্ত্র শক্তির উপর তার বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে গেল তার সাথে একটি শক্তিমান পুত্রের কামনায় পুনরায় পৃথার দ্বারস্থ হলেন। পবন দেবতার পৃথার মিলনে প্রবল শক্তিমান পুত্র লাভ করলেন। আবার পান্ডুর বাসনা হলো মর্তে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এক অসাধারণ পুত্রের প্রয়োজন , সেই উদ্দেশে পৃথাকে ইন্দ্রের শয্যাসঙ্গিনী করে লাভ করলেন অর্জুনকে। এরপর আবার পান্ডু সন্তান কামনায় পৃথার কাছে হাজির হলেন। এবার পৃথার মধ্যে মহাভারত দেখলো এক ধর্মশীলা নারীর প্রতিমূর্তিকে, যে দ্ব্যর্থহীনভাবে একই সাথে বাসনাকে তার ধর্মের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করলেন এবং পান্ডুর বিকৃত কামকে ধিক্কার জানালেন।
মহাভারতের কবির হাতে পৃথা বারবার বিভিন্ন ঘটনার শিকার হয়েছেন কিন্তু তার স্বকীয়তা হারান নি। প্রতারিত হয়েছেন কিন্তু সংকল্প হারান নি। স্বামীর বাসনাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে নিজেকে বলিদান করেছেন কিন্তু নিজ ধর্মকে বিসর্জন দেন নি। পরপুরুষের সাথে সময়ের প্রয়োজনে সঙ্গম করেছেন কিন্তু রতিক্রিয়া করেন নি। গাহস্থ্য ধর্ম যে সর্বাপেক্ষা কঠিন ধৰ্ম তা আবার প্রমাণিত হয়েছে।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
বি. দ্রঃ - ভালো লাগলে শেয়ার করুন।
মন্তব্যসমূহ