আমি মহাভারতের পৃথা - পঞ্চম পর্ব
আমি মহাভারতের পৃথা - পঞ্চম পর্ব
অবশেষে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদকে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে দুই রানী পৃথা এবং মাদ্রীসহ পান্ডুর অরণ্য যাত্রা শুরু হোল । ধীরে ধীরে লোকালয় অতিক্রম করে নির্জন গহন অরণ্যে পৃথারা ক্রমেই এগিয়ে যেতে লাগলো। পুরজনের কোলাহল কখন যেন থেমে গিয়ে থম থমে এক নিস্তব্ধতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বসন্তের বাতাসে পৃথাদের পাদস্পর্শে অরণ্যের লতানো গাছগুলি একে অপরের গায়ে হেলে পড়ে যেন তাদের অতিথি আগমনের প্রতি সম্ভাষণ জানাচ্ছে , পাখীর কলধ্বনি যেন দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসানে তাদের পরম আত্মীয়রা নিজ গৃহে ফেরার আনন্দে তাদের উচ্ছাস ধরে রাখতে পারছে না। আবার মাঝে মাঝে বনের প্রাণীরা যতদূর তাদের আওয়াজ যায় ঠিক ততদূর পর্যন্ত বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দে পৃথাদের অস্তিত্বের সংবাদ প্রেরণ করছে। পৃথাদের গন্তব্যস্থল সেই বহুদূরে শ্বাপদ সংকুল পথ অতিক্রম করে শতশৃঙ্গ পর্বত।
পৃথা ভাবছে, রাজমহলের কোন কৃত্রিমতা এখানে নেই, দেয়ালরা এখানে কথা বলেনা, মনুষ্য সৃষ্টি উঁচুনীচ ভেদাভেদ কাকে বলে এই প্রাকৃতিক বিশালতার মাঝে সবকিছই হারিয়ে যায়। আকাশের ছাদটার কাছে সবাই আশ্রিত। মানুষের সৃষ্টি ধনী দরিদ্র, পাপী পুণ্যবান , আর্য্য অনার্য্য বলে আলাদা করে কিছু নেই।
পৃথার মনে হচ্ছে, এই বিশালতাকে উপলদ্ধি করতে পারলে সংকীর্ণতার অবকাশ থাকেনা। পরিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী পূর্ব অবস্থ্যার বিলোপের মধ্যে দিয়ে নব প্রভাতের সূচনা হয়। সংকীর্ণতার মৃত্যুই একমাত্র বিশালতাকে জায়গা করে দিতে পারে। অদ্ভুত এই মানুষেরা ! তা নাহলে পৃথিবীর বুকে একটা দাগ দিয়ে তাকে ভাগ করে তার নাম দিয়ে তাকে রাজ্য বলে আলাদা করে চিহ্নিত করে বিশ্বপ্রকৃতিকে বিভাজন করে তারা ভালো থাকতে চায়। এতো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের বিরোধী। সৃষ্টির নিয়মের বিরোধিতা করলে প্রকৃতি ক্ষমা করেনা।এটা মানবজাতির চিরস্থায়ী সংকটের কারন এবং এই অভ্যাস, যুগে যুগে কতিপয় মানবের হাতে শক্তি কেন্দ্রভূত হয়ে অধিকসংখ্যক মানবের সংকটপূর্ণ জীবনযাপনের মূল কারন হবেই। বিভাজনটা মানুষের সংকীর্ণ চিন্তার ফসল। একদিন যদি কোন অঙ্গ যদি বলে " আমি" মূল শরীরের থেকে আলাদা একটা সত্ত্বা, বাস্তবে তা কি সম্ভব ? তাতে করে কি অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে পারবে ? কখনই পারবেনা।
পৃথা উপলদ্ধি করতে পারছেন, বিভাজন এক ভয়ংকর ব্যাধি, সমাজ যদি একবার আক্রান্ত হয় তাহলে, প্রথমেই ভাঙবে পরিবার তার পর একে একে বর্ণ, ধর্ম, জাতি ও রাজনীতির নামে দেশ ও সমাজ ভেঙ্গে পড়বে তাসের ঘরের মতো। তার উপর রাজত্ব করবে একদল স্বার্থপর মানুষ আর তারা শাসন করবে সমাজের এক বৃহৎ অংশের বহু সমস্যায় জর্জরিত একদল মেরুদন্ডহীন প্রাণীদের উপর।
তাদের এই অরণ্য ভ্ৰমণ হয়ত আগামী দিনে হস্তিনাপুরের সংকটকে রূপক হিসাবে দাঁড় করিয়ে এই বিভাজনের, এই সংকীর্ণতার নজীর তুলে ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বে সেই কুফলতার অবিসম্ভাবী বিষময় ফলের ইঙ্গিতটাই পৌঁছে দেবে ।
একনাগাড়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে পৃথারা রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্য মুনির আশ্রমের আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। শুক্লপক্ষের রাত, পথযাত্রার অধিক ক্লান্তিতে ঘুমটাও আসছেনা, কুটিরের বাইরে ভগ্ন গাছের গুঁড়ির উপর বসে পৃথা আকাশের মেঘ আর চাঁদের রোশনাইয়ের লুকোচুরির খেলা দেখতে দেখতে শ্বশুরমশাই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেরের অগাধ পান্ডিত্যের কথা চিন্তা করছিলেন এবং আগামী দিনে তিনি এক নতুন সাহিত্য সৃষ্টির এক ঝলকে মুখবন্ধের মূল লক্ষ্যটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন, যেটা তিনি তার পূর্বের চিন্তার সাথে এখনকার মুখবন্ধের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন ।
প্রসঙ্গটা ছিল ভারতীয় শিক্ষা সংকৃতির একমাত্র সুর বেদকে সারা বিশ্বের দুয়ারে কি ভাবে সহজ করে পৌঁছে দেওয়া যায়। ভারতবর্ষে বেদের এই বিশালতাকে পৌঁছে দেবার মতো কোন মাধ্যম ছিল না। কিন্তু সেই ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষাকে সরলীকরন করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য প্রয়োজন ছিল বাস্তব থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বেদের মূল ভাব পুরুষার্থকে সরলীকরণ করে সাধারণ মানুষের কাছে সাহিত্যাকারে পৌঁছে দেওয়া। কেননা মানুষের বিভ্রান্তির মূলেই আছে অজ্ঞানতা। মহাভারতই পারে সেই কাজটা করতে।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
বি. দ্রঃ ভালো লাগলে শেয়ার করুন।
মন্তব্যসমূহ