আমি মহাভারতের পৃথা -১৪ তম পর্ব
আমি মহাভারতের পৃথা -১৪ তম পর্ব
অরণ্য কখন কারোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তার বিশাল নীড়, সে তো সব প্রাণীরই আশ্রয়স্থল। দুঃখ এখানে প্রবেশ করে না, শুধু অফুরন্ত আনন্দ আর প্রগাঢ় শান্তি একত্রিতে এখানে বাস করে। অনাহুত প্রাণিকুলকে অরণ্য কখনই বঞ্চিত করেনা তার সেই নির্মল প্রাসাদ থেকে আর তাতে তৃপ্ত হয় তাদের প্রাণের রসনা, এইভাবেই বেড়ে উঠে জঙ্গলের সাথে প্রাণীর যুগ যুগান্তরের বাঁধন। পৃথাদের মাথায় ছাদ হয়তো নেই কিন্তু মাথার উপর একটা মস্ত বড় আকাশ আছে , দিনেতে আছে রবির অকৃপণ কিরণ আর রাতে কখন চাঁদ আর তার অবর্তমানে বড় বড় তারারা অবিরাম প্রদীপের রোশনাই জ্বালিয়ে বসে থাকে যেন , মর্ত্যের তার স্নেহধন্যরা কখনও যেন আলোর অভাবে বিপথগামী না হয়।
আজ পৃথার সান্ত্বনা এই যে, পুত্ররা হয়ত হস্তিনাপুরের এক টুকরো রাজ্যটা পাইনি কিন্তু তার পরিবর্তে তাদের হাতে মহাকাল তুলে দিয়েছে একটা বিশাল ভুবন। তারা আজ দুনিয়ার রাজা হিসাবে মানুষের হৃদয়ে স্থান দখল করে নিয়েছেন। প্রভাতের রবির রক্তাভ আলোর ছটায় দিগ্ দিগন্ত যেন উচ্ছসিত। দূরে ভাগীরথী নদীর তীরে কোন এক আশ্রমবাসী উদাত্ত গলায় ঋকবেদের সূর্য বন্দনার মন্ত্র -
ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্ৰণতোহস্মি দিবাকরম্।
পাঠ করছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে আলোর পথযাত্রী সেই গাছের কোটরে থাকা পাখিরা সমবেত কন্ঠে তাদের কলতান শেষ করে, তারা উড়তে উড়তে আকাশের বুকে ক্রমেই দূর থেকে দূরান্তে, বিন্দু থেকে বিন্দুতর হয়ে আকাশের কোলে হারিয়ে যাচ্ছে।
পৃথা ভীষণই কৃতজ্ঞ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব এবং বিদুর এই দুই বিদ্যজনের কাছে যাঁরা তার জীবনের একান্ত অসময়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকে তার লক্ষ্যের দিকে চালিত করছে। সেই ব্যাসদেবের পরামর্শ মত পৃথারা রাত্রিযাপন করতেন লোকালয়ের কাছাকাছি আর দিনের বেলা শুরু হতো দীর্ঘ পথ পরিক্রমা । পান্ডবরা এক জায়গায় কখন বেশিদিন কখন থাকতেন না। হয়ত তারাই গেরিলা যোদ্ধাদেরই পথিকৃৎ ছিলেন। ব্যাসদেবের নির্দ্দেশ ছিল একচক্র নগরীতে থাকার। সেখানে পান্ডবরা দরিদ্র ব্রাহ্মণদের বেশে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা আদায় করবে এবং একই সাথে চোখ কান সজাগ রেখে খবর সংগ্রহ করবে। শুধু তাই নয় যতক্ষন পর্যন্ত ব্যাসদেবের আদেশ না আসবে ততদিন পর্যন্ত পান্ডবরা একচক্র নগরীতেই থাকবেন। ব্যাসদেবের স্পষ্ট নির্দ্দেশ ছিল পৃথার কাছে যে, সাধারণ মানুষের সাথে বসবাস করলে আগামীদিনের শাসক পান্ডবরা বুঝতে পারবেন মানুষকে প্রতিনিয়ত কতরকমের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অবশেষে পৃথাসহ পাণ্ডবেরা একচক্র নগরীতে এক ব্রাহ্মণ গৃহে বসবাস করতে শুরু করে।
এমনিই একদিন সেই ব্রাহ্মণ গৃহে ক্রন্দন রোল ক্ষত্রিয়া নারী পৃথার অন্তঃকরণকে স্পর্শ করল। কারন অনসুন্ধান করে জানা গেল বক নামে এক অনার্য রাক্ষস সম্প্রদায়ভুক্ত, সে সেই নগরীর প্রত্যেক বাড়ী থেকে পালাক্রমে তোলা আদায় করে এবং তার সাথে তার পরিবারের একজন সদস্যকে তার খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। আজ এই ব্রাহ্মণদের পালা। বকের এই শ্বেত সন্ত্রাসে নগরবাসীর মনস্তাত্বিক জগতে এক আলোড়ন উঠেছিল। অবিসংবাদিত ক্ষমতার অধিকারী বককে প্রতিহত করার মতো শক্তি একচক্র নগরীতে গড়ে উঠেনি। এখানে একটা লক্ষণীয় বিষয় হল তৎকালীন ভারতবর্ষে এমন কতকগুলি স্থান বা বিক্ষিপ্তভাবে বেড়ে উঠা জনগোষ্ঠী ছিল যারা কোনদিন কোন সংগঠিত রাজ্যের অধীনে ছিল না। তাই তাদের অত্যন্ত বিপদের দিনে প্রশাসনের কাছ থেকে সাহায্য পাবার সম্ভাবনা ছিল না। তাছাড়া, তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে উদাসীন ছিল বা তৎকালীন সময়ে তার হয়ত প্রয়োজন পড়েনি। ভীমের ন্যায় এক শক্তিশালী পুরুষ তথা পৃথার ন্যায় এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার এক নৈতিক সমর্থনকারী এবং প্রেরণাদাত্রী মা, যিনি পান্ডবদের মাতার ভূমিকার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না করে নিজেকে সার্বজনীন মাতা অর্থাৎ আশ্রয়দাত্রী হিসাবে মহাভারতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজ গুনে।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
বিঃদ্রঃ -ব্লগটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

মন্তব্যসমূহ