আমি মহাভারতের পৃথা - পঞ্চদশ অধ্যায়
মানব জীবনের নিরন্তর গতি প্রবাহই হচ্ছে ইতিহাস। অতীতের সামাজিক জীবন,শিল্পকলা ,সাহিত্য সংকৃতি, জনজাতি,গোষ্ঠীর, রাষ্টের আবাহন ও বিসর্জনের গতি প্রকৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনাবলী , সময়ের হাত ধরে বর্তমানের কাছে পৌঁছে দেবার মহৎ কাজটা ইতিহাসই করে থাকে। মানব সমাজের সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারাবাহিক প্রামাণ্য দলিলকে ইতিহাস বলা যেতে পারে। আর অতীতের অভিজ্ঞতাই মানুষকে আগামীদিনের কর্ম পদ্ধতিকে নিশ্চিত করতে সাহায্য করে, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
অত্যাচারী হিরম্ব অর্থের লোভে ভীম অর্জুনকে হত্যা করার সংকল্প গ্রহণ করেছিল কিন্তু বাস্তবে স্বৈরাচারী শক্তি পরাস্ত হয় এখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী শক্তির প্রতিনিধি ভীমের হাতে। পাশাপাশি বিজিত শক্তির প্রতিরূপ সহায় সম্বলহীনা হিড়িম্বাকে আশ্রয় দান করে পৃথা শুধুমাত্র পরাজিতের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে ক্ষান্ত হননি, হিড়িম্বাকে জীবনের মূলস্রোতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার অন্যান্য পুত্রদের মৃদু অসম্মতিকে অগ্রাহ্য করে। একাধারে তিনি সংবেদনশীল মাতা আবার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্ষত্রিয়া নারী হিসাবে আগামী দিনে অনার্যদের কাছে তার এবং পান্ডবদের চারিত্রিক উদারতার পরিচয় করে দিয়েছিলেন , এবং প্রতিষ্ঠা করছিলেন আগামী দিনের একটা নির্ভরযোগ্য সুশাসকের অন্যতম কর্তব্য যে সাধারণ মানুষকে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তার ভাবী প্রজাদের নিরাপত্তা প্রদান করা, তার নির্দশনও তারা দেখিয়েছেন। তাছাড়া হিড়িম্বার সাথে ভীমের বিবাহ জঙ্গলে বসবাসকারী পান্ডবদের নিরাপত্তার দিক থেকেও বিশেষ নিশ্চিন্ততার বাতাবরণ তৈরি করেছিল।
এক অভাবনীয় আস্থা পাণ্ডবদের উপর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল বক রাক্ষসকে হত্যার মধ্যে দিয়ে। বেদ ও মহাভারতের যুগের সমাজের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা হল সমাজে কতগুলি পরিবার নিয়ে গ্রাম গড়া হতো আর কয়েকটি সমমনোভাপন্ন গ্রাম নিয়ে একটা গোষ্ঠী তৈরি হতো, তারা সমিতি গঠন করে একটি শক্তিশালী পুরুষকে রাজা বানাতো এবং তাকে নির্বাচনের অন্যতম নির্ণায়ক হতো তার যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শিতা। একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল তদানীন্তন সময়ে অনার্য্যারা এতটাই যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শিতা ছিল যে আর্যরা তাদের সমীহ করতো। এখানে একচক্র নগরীতে কোন রাজা ছিলনা। স্বৈরাচারী অনার্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বক দীর্ঘদিন ধরে তার একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিল, মহাভারতের কবি এখানে শৌর্য বীর্যের প্রদর্শন এবং দুর্বলের ত্রাতা হিসাবে মুকুটহীন পান্ডবদের সমাজের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। খুব প্রত্যাশিত ভাবে তারা নিজেদের সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
মহাভারতের শ্লোকগুলির বৈশিষ্ট হল ভীষণ ক্রমানুসারে সাজানো এবং পূর্বের ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে একটা ধাপ অতিক্রম করে তার ঠিক পরের ঘটনায় প্রবেশ করে । একচক্র নগরীতে বেদব্যাসের আগমন এবং পৃথার সাথে গোপন বৈঠক আগামীদিনের কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রস্তুতি তারই দৃষ্টান্ত। এবার অরণ্য ছেড়ে পাণ্ডবদের আত্মপ্রকাশের সময় আগত। তার জন্য প্রয়োজন ছিল এক সর্বভারতীয় মঞ্চ আর তার সাথে রাজনৈতিকভাবে কৌরবদের একটা বিরোধী শক্তিশালী হাতকে নিজেদের মুঠোয় আবদ্ধ করার কাজটাও সম্পন্ন করা।
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের সাথে তার একসময়ের মিত্র দ্রোণাচার্য অপমানিত হয়ে প্রতিশোধের নেশায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঠিক তখনই কৌশল করে ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণাচার্যকে কৌরব পক্ষে টেনে নিয়ে এসে উভয়ের মধ্যেকার বিরোধকে এক রাজনৈতিক রূপ দিয়েছিলেন। এই ঘটনার অবিশ্বভাবী ফল হল দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি আর এই কারণটাই পাণ্ডবদের মিত্র হবার ইতিবাচক দিক। দ্রোণের গুরু দক্ষিনা হিযাবে অর্জুনের হাতে দ্রুপদের পরাজয়টার গ্লানির ঠিক কতটা পাঞ্চালরাজকে অর্জুনবিরোধী না কৌরব বিরোধী তার পরিমাপটা বেদব্যাসের কাছে একসময়ে জরুরী ছিল। তিনি অপূর্ন প্রতিশোধের দুর্বিসহ যন্ত্রনায় কাতর পাঞ্চালরাজকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে হতাশা রাজপুরুষকে শোভা পায় না. রাগ ঘৃণা, বিদ্বেষ ও হিংসার শেষ হয়না , সে বারেবারে লক্ষ্য পূরণের প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে আসে। সেই অহংকারকে জাগিয়ে তুলতে এবং বাস্তবায়িত করতে, দ্রোণ তথা কৌরবদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গেলে তার একমাত্র রাস্তা কাটা দিয়ে কাটা তোলা এবং সেক্ষেত্রে অর্জ্জুনই একমাত্র সেই কাজটা একাই সম্পাদন করতে পারেন। বেদব্যাস দ্রুপদকে এটাও বোঝালেন আপনারা একমাত্র কন্যা পাঞ্চালীর স্বয়ম্বর সভাই হয়ে উঠুক আপনার কৌরবদের প্রতি প্রতিশোধের প্রাথমিক পদক্ষেপ।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ