আমি মহাভারতের পৃথা -সপ্তদশ পর্ব
আমি মহাভারতের পৃথা -সপ্তদশ পর্ব
সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে নারী তার দেহ ও মন দিয়ে যে প্রাণের স্পন্দনকে বহন করে, আবার তাকে প্রতিপালন করে সেই প্রাণকে পূর্ণতায় প্রকাশিত করে আসছে। যে শক্তির বলে সে এই সৃষ্টির কাজটা করেছে, সেই শক্তিই হচ্ছে আদ্যাশক্তি। শিবরূপী ক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে একহাতে সৃষ্টির প্রতীক আর অন্য হাতে ধংসের প্রতীক, আর সেই সৃষ্টি আর ধংসের প্রতিরূপ কালী মূর্তি, সেও নারী শক্তি।
সূর্যকে কেন্দ্র করে তার চারপাশের গ্রহরা আবর্তিত হয়, ঠিক তেমনি সমাজ-সংসারে নারীকেই কেন্দ্র করে পরিবারের অন্যান্য মানুষদের নিয়ে সামাজিক বলয় গড়ে উঠে । পুরুষ যেখানে মুক্ত বিহঙ্গ, নারী সেখানে ক্লান্ত বিহঙ্গের আশ্রয় নীড়। আবার পুরুষ যেখানে মুক্ত পাখিকে বলপূর্বক খাঁচায় পুরে গর্ব অনুভব করে, সেখানে পুরুষ জানেই না যে নারী স্বভাবগতভাবেই তার মধ্যেই বাঁধন মানার প্রবণতা আছে। পুরুষের বাহ্যিক জগতে জীবনের সংগ্রামে বহুবিধ কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে হয়, সেখানে যেমন কৃতকার্যতা আছে ঠিক তেমনি না পারার গ্নানিও আছে। দিনের শেষে সেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হৃদয়ে সেই নারীই প্রাণের সঞ্চার করে সেই পুরুষকে আগামীদিনের জীবনযুদ্ধে নতুন উদ্দমে অংশগ্রহণের, প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার মন্ত্র শেখায়। পরিবারের ব্যতিক্রমী সদস্যদের কাছ থেকে কদর্য নিমত্রণকে, ঘৃণার পরিবর্তে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কি ভাবে করতে হয়, সেই শিল্পটা নারীই সহজাত গুন। অন্তঃপুরে থেকে সহ্য,ভালোবাসা, স্নেহ ও প্রীতির মাধুর্য্য দিয়ে অনন্তকাল ধরে ঠিক একই ভাবে পরিবার তথা সমাজকে সুদৃঢ়ভাবে বেঁধে রাখছে যেন কেউ কক্ষচ্যুত না হয়ে যায়। এই রহস্যই পুরুষের চেতনার অতীত, তাই তার কাছে নারী চিরকালই রহস্যময়ী।
মহাভারতের যুগে এমন অনেক নারীর উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে যারা একাধারে শাস্ত্রের ব্যাখ্যাকার , সংসার এবং রাজধর্ম পালনের স্বার্থক রূপকার। ইতঃপূর্বে পৃথা মহাভারতের ইতিহাসে বারবার প্রমান করেছেন ক্ষত্রিয় নারীর দৃঢ়তা, আবার একই সঙ্গে সেই চির পরিচিত একজন সাবর্জনীন মাতার বাৎসল্য প্রেমের উদাহরণও প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে প্রয়োজন ছিল হিরম্ব হত্যা করার মধ্যে দিয়ে দুষ্টের দমন আবার ভীমের সাথে হিরম্ব ভগ্নি হিড়িম্বাকে বিবাহ দিয়ে প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধিকে সামাজিক প্রতিষ্ঠার উদাহরণ। বক রাক্ষসকে হত্যার মধ্যে দিয়ে ব্রাহ্মণ পরিবার তথা একচক্রা নগরীতে শিষ্টের পালন ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা । এক্ষেত্রে তিনি শঙ্কা থাকা সত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে তার পুত্রদের এগিয়ে দিয়েছেন।
ক্রমেই পৃথার কাছে পৃথিবীটা প্রাচীন হয়ে যাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে পান্ডবদের ভাইদের মধ্যে অটুটু বন্ধনের দায়িত্ব নেবার জন্য সময় আগত দায়িত্ব হস্তান্তরের। যে নারী তার প্রেমের মাধুর্যে , পান্ডবদের আগামীদিনের শঙ্কাপূর্ন অভিযানের কান্ডারীর ভূমিকায় থেকে জীবন যুদ্ধের যোগ্য সহযোদ্ধা হতে পারবে। পাঞ্চালীর স্বয়ম্বর সভা ছিল তার যোগ্য পটভূমি। পৃথার কাছে এই স্বয়ম্বর সভায় শেষ স্পর্শটি যেমন অর্জুনের গান্ডীব থেকে উচ্চারিত হয়েছিল কিন্তু পাঞ্চাল থেকে একচক্রা নগরীতে দ্রৌপদীকে নিয়ে আসা এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গের সাথে ভীম অর্জুনের যুদ্ধ এবং দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা যুধিষ্টির, নকুল ও সহদেবের অতন্দ্র প্রহরীর মতো ভাবী আক্রমনের প্রস্তুতি নেওয়াকে কোন ভাবেই তৃতীয পান্ডবের একক প্রচেস্টার ফলশ্রুতি হিসাবে তার কাছে পরিগণিত হয়নি। বরং, এই স্বয়ম্বরে যা কিছু প্রাপ্তি তা পান্ডবদের যৌথ প্রচেষ্টার ফল বলেই মনে হয়েছিল। যৌথ প্রচেষ্টার ফসল একজনের হাতে তুলে দেওয়া, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথার যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।
দ্রুপদ কন্যার রূপের আভিজাত্য যে কোন পুরুষের পক্ষে ঈর্ষার বস্তু, প্রথমতঃ, পাঁচভাই প্রথমে পুরুষ মানুষ তারপরে সম্পর্কের সূত্রে ভাই। দ্বিতীয়ত, অবচেতন মনে কোন ভাই যদি দ্রৌপদীকে কামনার ভাবনা মনে স্থান দেয় পরবর্তী সময়ে সেই বীজ যদি অমর অংকুরে বেড়ে উঠে, তাহলে সেটা আগামীদিনে সম্পর্কের ভাঙন ধরার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।তৃতীয়তঃ , পাঞ্চালীকে ঘিরে পঞ্চভ্রাতার আবর্তন আগামীদিনে অকুন্ঠ দৃঢ়তার উপর ভিত্তিকরে পাণ্ডবশক্তি আত্মপ্রকাশ করবে, এই বিশ্লেষণ থেকে পৃথা বলেছিলেন, "যে ভিক্ষা তোমরা অর্জন করেছো তা নিজেরা ভোগ কর। "
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ