66 মহাভারতের যাজ্ঞসেনী -চতুর্থ পর্ব
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী -চতুর্থ পর্ব
অগ্নি দেবতা
দেখা বা শোনার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর গ্রহণ যোগ্যতার বা বিচার বিশ্লেষণের মধ্যে যদি যুক্তি ও অনুভূতি না থাকে তাহলে পাঠক হয়ত মেনে নেবেন না, কিন্তু মানিয়ে নেবেন। সাহিত্যে অতিব্যঞ্জনা থাকবেই আর তা যদি মহাকাব্য হয় তাহলে তো কথাই নেই কিন্তু তার পাশাপাশি পাঠকের বাস্তববোধের সীমারেখার বাইরে কোন ঘটনা প্রবাহ চলে গেলে, পাঠকের অন্বেষণ জারি থাকবে তার পিছনে সঠিক যুক্তি বা ব্যাখ্যা খোঁজার। আবার, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহু ঘটনা আছে, যা থেকে অলৌকিকতার জন্ম নেয় কিন্তু হয়ত বাস্তবে তা আছে কিংবা নেই। তাহলে ব্যবধানটা হল জানার সাথে না-জানার আর কল্পনার সাথে বাস্তবের, অবশ্য এদের মধ্যে শত্রুতা চিরদিনের।
বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির যুগে তার আবিষ্কৃত ফল সভ্যসমাজে যে ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, সেভাবে প্রান্তিক সমাজে পৌঁছায়নি। ধরা যাক, রিমোট কন্ট্রোলে চালকবিহীনভাবে একটা গাড়ী চলছে, তার বাস্তবতা আধুনিক শহরে একরকম আর আন্দামানের গহন অঞ্চলে আদিবাসীদের কাছে তার অন্য রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যাবেই। তাদের কাছে যে প্রশ্নের উত্তর মিলবেনা, সেটা অলৌকিকতার তকমা সেটে তাদের সমাজে মুখে মুখে ঘুরে বেড়াবে। প্রচলিত ধারণার বাইরে গেলে তা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি হয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয়ে পরে তার কারন অনুসন্ধানের। এখানেও চর্চা চলবে মানুষের অনুসন্ধিৎসার প্রবণতার চিরন্তন অভ্যাসের। পাঁচহাজার বছর আগের পটভূমিতে রচিত মহাভারতের সাথে আজকের পাঠকের মনোজগতের সংঘাত। এই উস্কে দেওয়া বিতর্কিত প্রশ্নগুলিই বোধহয় মহাকাব্যের দীর্ঘজীবন প্রাপ্তির রহস্য। অমীমাংসিত প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রে সাঙ্গ করতে হবে এই বলে - "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর"।
(যজ্ঞের বেদীর আগুন থেকে যাজ্ঞসেনীর জন্ম তৃতীয় পর্বের সূত্র ধরে অগ্নির বৈচিত্রতা )
অগ্নির পরম্পরা :
অগ্নিঃ পূর্বোভিঃ ঋষিভিঃ ইভ্যঃ নতুনৈঃ উত সা দেবাঁ আ ইহ বক্ষতি।
অগ্নি এক চির নতুন দেবতা, যাকে মানুষসহ, বর্তমানের এবং প্রাচীন ঋষিরা পূজা করে আসছেন। তার অর্থ হল তিনি পূজা পাবার যোগ্য। অর্থাৎ সেটাই পরম্পরা। মানুষের মনে যে আধ্যাতিক অনুভূতি হয় , সেটা তার মনের কল্পনা না উপলদ্ধির মাধ্যমে হয়েছে, তাকে কি ভাবে জানা যাবে ? খুব প্রাসঙ্গিকভাবে ভারতীয় ঋষিরা বলেছেন, মানুষের উপলদ্ধিকে পরম্পরা, যুক্তি, অনুভূতির উপর যে কোন একটাতে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, কোন ব্যক্তির মাথায় একটা চিন্তা এলো, এই বর্ষ প্রাচীন গাছটাকে পূজা করলে মানুষের সব জ্ঞান হয়ে যাবে। এবার, প্রথম প্রশ্ন হল, ওই ব্যক্তির মাথায় এই ধরনের ভাবনা কি ভাবে এলো এবং এইভাবে কেউ জ্ঞানলাভ যদি করে থাকে তার প্রমান আছে কি ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল,আগেকার কোন ঋষিরা কি গাছের উপাসনা করেছিল এবং তার কোন পরম্পরা কি আছে ? যদি উত্তর না হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটাই মূল্যহীন।
"দেহহীন চামেলীর লাবণ্য বিলাসে" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইনটি খুব প্রাসঙ্গিক ভাবে আসতে পারে। আধ্যাত্মিক বা দেহহীন চেতনার যখন উন্মেষ হয় তখন প্রকৃত (আত্ম) জ্ঞান বা ভগবান প্রতক্ষ্য হয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনে মা কালীর দর্শন যেমন বার বার এসেছিল , ঠিক তেমনি সাধক রামপ্রসাদের জীবনেও এসেছিল ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে এবং উভয়ের দিব্যদর্শনের অভিজ্ঞতা একে অন্যের থেকে আলাদা। পরবর্তী সময়ে অন্য কারুর যদি দিব্য দর্শন হয় তা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সাথে নাও মিলতে পারে। সেই জন্য ঋষিদের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেখানে দুটি বর্ণনা একই রকমের হয় না। অবশ্য এতে কোন দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই , যেটা আছে সেটা হল একে অন্যের পরিপূরক হিসাবে।
যার কোন রূপ নেই তাই তিনি কোন ব্যক্তি বিশেষ নন, তিনিই ঈশ্বরের রূপ, তিনিই নৈব্যক্তিক (Impersonal)। ঈশ্বরের চৈতন্য শক্তিকে যখন নির্গুণ ( অসীম) নিরাকার অমূর্তরূপে ( দেহ ভাবনার উর্দ্ধে) চিন্তা করা হয় তখন তিনি নৈব্যক্তিক ঈশ্বর। সেই চৈতন্য শক্তির যখন রূপ এসে যায়, তখন তিনি সগুন - সাকার রূপেই বর্ণিত হন।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
.

মন্তব্যসমূহ