আমি মহাভারতের পৃথা - ১২ তম অধ্যায়
আমি মহাভারতের পৃথা - ১২ তম অধ্যায়
মহাভারতের অন্যতম নায়িকা পৃথা, তার শ্বশুর বাড়ী এবং বাপের বাড়ীর বঞ্চনাকে তিনি তার জীবনের অলঙ্কার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ক্ষত্রিয় নারীর গভীর সংকল্প থেকে শত মনকষ্ট তাকে এক চুল ও সরাতে পারেনি। তার মানসিক বেদনা যেন বার বার সেই রবি ঠাকুরের গানের মধ্যে দিয়ে ফিরে এসে বলছে - "শেষ নাই যে শেষ কথাটাই কে বলবে আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে " । সেই ভাবনাই প্রকাশিত হয়েছিল আগামী দিনে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার পাণ্ডবদের প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে। অরণ্যবাসে পান্ডব পুত্রদের অন্যতম মেন্টর হয়ে উঠেছিলেন পৃথা। রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে অরণ্যেও, রাজপুরুষ থেকে শুরু করে বনের মানুষের সাথে পথ চলার ক্ষেত্রে , পৃথা সমান সাবলীল।
হস্তিনাপুরের রাজমহলটা মহারাজ পান্ডুর মৃত্যুর বহু পূর্ব থেকে পান্ডবদের সাথে দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারনে একটি দূরত্ব রচনা করেছিল। ধৃতরাষ্ট্রই ছিলেন হস্তিনাপুরের মসনদে আসীন । পরবর্তী সময়ে পান্ডুর মৃত্যর পরে যুধিষ্ঠির অল্প কিছুদিনের জন্য যুবরাজ ছিলেন। বারানাবতে পান্ডবদের পাঠানোর প্রাক মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্র আশংকা করেছিলেন আমজনতা,মন্ত্রী-পরিষদবর্গের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। তার উত্তরে দুর্যোধন তার পিতাকে সংশয় মুক্ত করে বলেছিলেন যে , রাজকোষের উপর তাদের একক কতৃত্ব আছে এবং অর্থই রাজনীতিকে পরিচালনা করে থাকে । তাই দুর্যোধন পূর্বেই প্রয়োজনীয় উৎকোচ দিয়ে জনতা এবং মন্ত্রী ও পরিষদের আস্থা অর্জন করে নিয়েছেন সুতরাং আশঙ্কার কারন বৃথা। বিগত দিনে অর্থ কতৃত্বকে মান্যতা দিত আজও সেই অর্থ দুর্নীতিকে মান্যতা দিচ্ছে। অর্থই ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে আর ক্ষমতা সাহায্য করে দুর্নীতিকে।
যুগে যুগে অত্যাচারী শাসকের ছায়া থেকে শত যোজন দূরে বসে Rebelরা তাদের শক্তি সংহত করে এসেছে । জঙ্গলের গাছের ঘনত্ব আর দুর্গম পাহাড় তো সবসময় স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। মহাভারতে পাণ্ডবরা সেই কাজটা তাদের দীর্ঘ বন পরিক্রমায় জনসংযোগের মতো সর্বাধিক কঠিন কাজটা সেরে ফেলতে অঙ্গীকার বদ্ধ ছিলো ।
মহাকাব্যের কাহিনীর প্রতি দায়বদ্ধ মহাভারতের কবি সাহিত্যকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য অলৌকিকতার আশ্রয় মাঝে মাঝে নিয়েছেন। তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিরম্ব এবং হিড়িম্বাকে রাক্ষস হিসাবে বর্ণনা। "রাক্ষস" শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সে সময়ের বনবাসীদের শারীরিক আকৃতি এবং আচার ব্যবহার ও ভয়ঙ্করতা মূল সমাজের মানুষের থেকে আলাদা, সে হিসাবে শব্দের ব্যবহার। হিড়িম্বার বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে ভীমের প্রতি প্রেম নিবেদন এবং মাতা কুন্তীকে তার প্রস্তাবের সাথে রাজী করানোর মধ্যে দিয়ে মহাভারতের নারী সমাজের স্বাধীনতার একটা দিক ফুটে উঠেছে তার প্রতিফলনের বর্ণনা এই স্বল্প পরিসরে ব্যক্ত করা অসম্ভব। মহাভারতে নারীদের একক ক্ষমতা ছিল নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে। তার উদাহরণ শকুন্তলা, সত্যবতী, পৃথা থেকে শুরু করে হিড়িম্বা পর্যন্ত সেই স্বাধীনতা যথেচ্ছভাবে ভোগ করে এসেছিল।
ভীমের হাতে হিড়ম্বরের মৃত্যুর পর হিড়িম্বার প্রেম নিবেদনে পৃথার অন্তঃকরণ পূর্ণ হয়ে উঠেছিল, একজন ক্ষত্রিয় নারী আত্মবিশ্বাসের সাথে তথাকথিত ভয় ভীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে ভীমের সাথে তিনি বিবাহ দিয়ে তৎকালীন জনজীবনে এক নতুন বার্তা দিয়ে গেলেন এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে ভীমের ঔরসে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্মের সময় পৃথা তার অন্তঃকরণ থেকে আশীর্বাদ করেন তার নিজ বংশের প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেন। মহাকাব্যের কাহিনীর বিন্যাসে কবি আজন্ম বনবাসী অনার্যদের রাক্ষস সম্বোধনে হয়ত তাদের শুধুমাত্র আসুরিক ক্ষমতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন , শুধু তাই নয়, আর্যদের সাথে অনার্য্যের বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে অনার্যদের প্রতি পান্ডবদের উদার মনোভাবের পরিচয়ের মাধ্যমে আগামীদিনে পৃথা তাদের পাশে দাঁড়ানোর যৌক্তিকতার প্রশ্নটি তুলে দিলেন। হিড়িম্বা ও ভীমের মিলনটা হয়তো বিধির বিধান ছিল , তা নাহলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের অর্জুন নিধনের জন্য নির্দ্দিষ্ট "একাঘ্নি" বানটিকে ঘটোৎকচ বুক পেতে না নিলে হয়ত মহাভারতটাকে অন্যভাবে লিখতে হোত।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
বি দ্রঃ - ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর খারাপ লাগলে মন্তব্য করুন।

মন্তব্যসমূহ