মহাভারতের যাজ্ঞসেনী - পঞ্চম পর্ব
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী - পঞ্চম পর্ব
(মহাভারতের অন্তরালে - যজ্ঞের বেদীর আগুন থেকে তার জন্ম তাই তার নাম যাজ্ঞসেনী, যাঁর লেলিহান শিখায় প্রায় সমগ্র ক্ষত্রিয় কুলের ধ্বংস সাধিত হয়েছিল । সেই অগ্নির বৈচিত্রতা নিয়ে বেদের ঋষিদের ব্যাখ্যা ,তাই নিয়ে চতুর্থ পর্বের হাত ধরে পঞ্চম পর্বের শুরু )
বেদের পরম্পরা :
বেদ একটি পরম্পরাকে অনুসরণ করে চলে। ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা হলেন অগ্নি এবং তার প্রথম মন্ত্র ' অগ্নিমীডে পুরোহিতং ' । এই মন্ত্রের প্রথমে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুছন্দার নাম দেওয়া হয়েছে।
ঋগ্বেদের মোট ১০টি মন্ডল আছে। দ্বিতীয় মন্ডল থেকে অষ্টম মণ্ডল পর্যন্ত ঋষির নাম নির্দ্দিষ্ট করা আছে। (কতকগুলি শব্দ নিয়ে একটা মন্ত্র, কতগুলি মন্ত্র নিয়ে একটা সুক্ত, কতগুলি সুক্ত নিয়ে একটা মণ্ডল) প্রত্যেক সূক্তগুলি এক একটা সম্পূর্ণ প্রার্থনা মন্ত্র আর প্রত্যেক মন্ডলগুলি এক একটি বিশেষ দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। ( মনে রাখতে হবে বেদ হচ্ছে শ্রুতি ) বেদের মন্ত্রগুলি একটি পরিবারের দ্বারা সংরক্ষিত হলেও, তার রচয়িতা যে সব সময় সেই পরিবারই হবে তা সবসময় বলা যায়না। হয়ত সেই পরিবারে কোন মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল, যিনি , ধ্যানের মধ্যে আবিষ্কার করলেন, "অগ্নিই সব শক্তির মুলে "।
সত্যকাম ও তৈত্তিরীয় উপনিষদ :
সত্যকাম গুরুর নির্দ্দেশে গরু নিয়ে জঙ্গলে গেলেন এবং গুরুর কথা মতো যতদিন সেই গরুগুলির সংখ্যা হাজার না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তিনি জঙ্গলেই থাকবেন। তিনি প্রত্যেকদিন গরুর রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম করে যেতেন। একদিন প্রধান ষাড় বৃষভ এসে সত্যকামকে তার হাজার গরু হয়ে যাবার সংবাদ দিল এবং গুরু গৃহে ফিরে যাবার সংকেত দিল। একথা, বলার পর বৃষভ সত্যকামকে ব্রহ্মউপদেশ দিয়ে বলল, ' বাকিটা তুমি সন্ধ্যাবেলায় অগ্নির কাছ থেকে শুনে নিও'। অগ্নি তাকে দ্বিতীয় একটা উপদেশ দিয়ে বলল "বাকিটা সকালে কোন এক পাখীর কাছ থেকে শুনে নিও"।
অগ্নি এসে সত্যকামকে ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ যখন দিচ্ছেন, তখন কোন ঋষি হয়ত বা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অগ্নি শুধু ব্রহ্মজ্ঞানই দেন না, তিনি অনেক কিছু দিতে পারেন - তিনি রক্ষা করতে পারেন, সন্তান দিতে পারেন, সম্পদ দিতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য কোন সূত্র না পাবার দরুন, এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে, যিনি এই সত্যটা পেয়েছিলেন, তিনিই আবার সুক্ত করে পরবর্তী বংশধরের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। এই সত্যটি শিষ্যদের বলে গেলেন, তারাও আবার তাদের শিষ্যদের বলে গেলেন। এইভাবেই পরম্পরা চলে আসছে।
উপনিষদে সত্যকামের ঘটনার মূল সার বস্তু হল নিষ্কাম এবং নিরাসক্ত হয়ে কাজ করে গেলে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়।
ব্রহ্ম কি ?
হিন্দুদের উপনিষদে বর্ণনা করা আছে তিনি সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনে বলা হয় "শব্দব্রহ্ম " । হিন্দুদের কাছে ব্রহ্মই শেষ কথা, যাকে বলা হয় পরমসত্তা। এই পরমসত্তা যখন শব্দব্রহ্ম হয়, তখন সৃষ্টি হতে থাকে। তিনি নাদ ( ধ্বনি ) রূপে সৃষ্টি করেন ' ওঁ ' ।
ঈশ্বর যদি অনন্ত হন তাহলে শব্দও অনন্ত, জ্ঞানও অনন্ত। ( বেদের অর্থ জ্ঞান আর জ্ঞানের অপর নাম ঈশ্বর, সুতরাং জ্ঞান = ঈশ্বর ) এইটাই বেদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাইবেল এবং কোরানে "অনন্ত " এই বৈশিষ্ট্য নেই। আবার বেদের সংজ্ঞা অনুযায়ী যে কোন জ্ঞানই বেদ। তাহলে গীতা, বাইবেল,কোরানকে বেদ বলা যেতে পারে। কিন্তু এরা সসীমতার বাঁধনে আবদ্ধ, অর্থাৎ অনন্ত নয়, এই কারণে বেদ হয়ে উঠতে পারেনি। হিন্দু ধর্মে মজা এটাই, যে কোন হিন্দু জ্ঞানকে অনন্ত বলে বর্ননা করার কারনে বেদকে ছাপিয়ে যেতে তার কোন বাধা নেই যেটা পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মে নেই। হিন্দুধর্মে নাম রূপ নির্বিশেষে একটাই রূপ, জাগতিক বলে কিছু নেই। মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা সবই একই বস্তুর বিকাশমাত্র।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ