মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-পঞ্চদশ অধ্যায় ||(78)

 মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-পঞ্চদশ অধ্যায়  ||  (78)

মানবজাতির উন্নতির এক মাত্র সোপান হচ্ছে  বেদ আর  বেদ যদি না বাঁচে তাহলে  সমগ্র  পৃথিবীর মানুষ বঞ্চিত হবে এই সর্বোচ্চ উপলদ্ধি  থেকে। "আমিই ব্রহ্ম " এই কথা অন্য কোন ধর্মে উচ্চারণ করা যাবেনা। তাহলে সে সঙ্গে সঙ্গে বিধর্মী হয়ে যাবে"....চতুর্দশ  অধ্যায়ের পর। 


 " ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত" - কোন পটভূমি থেকে এই শ্লোকটি উঠে এসেছে, এর পশ্চাতে ভারতীয় মুনি ঋষিদের সুনির্দ্দিষ্ট কি চিন্তা ভাবনা কি ছিল ? অন্যায়ের প্রতীকী রাবনের মৃত্যু ন্যায়ের প্রতীকী রামের হাতে হয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে অধর্মের বিনাশ হয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ? অধর্মের ইতি আর ধর্মের প্রতিষ্ঠা , এই গোটা ব্যাপারটা ভাবতেই বেশ হেয়ালি লাগে। সৃষ্টি কর্তার বা ভগবানের  হাতে ধর্ম আর অধর্মের প্রতীকী দুই জনের সৃষ্টি হয়েছে এবং তিনি সে ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। আবার তিনিই পৃথিবীতে এসে রামের রূপ ধরে তারই অপর সৃষ্টি রাবনকে হত্যা করলেন ? যিনি ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্মের উর্ধে, তিনি কেন হত্যা করতে যাবেন ? এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় দার্শনিক শঙ্করাচার্য এইরকমের বহু প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন এবং তার যথাযথ ব্যাখ্যাও  দিয়েছেন । সুতরাং ঋতমকে(মহাজাগতিক আদেশ )  রক্ষা  করার দায়িত্ব ভগবানের নয়, দেবতার (উন্নত ধরনের মানুষ) । 

সাহিত্য, ইতিহাস ,ধর্ম ও সংকৃতি যে হেতু মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে , তাই মহাভারত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, সমভাবাপন্ন  ছবিগুলিকে একটা ফ্রেমে আনতে গেলে   পুরাণ এবং  বেদের প্রসঙ্গ বাদ দিলে আলোচনা অসম্পূর্ন থেকে যাবে। যে কোন সৃষ্টির পিছনে মানুষের প্রয়োজনীয়তার ভাবনাটা  মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে আবার আপাতদৃষ্টিতে তাৎক্ষণিক উপযোগিতা না দেখলেও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে পরবর্তী সময়ে তার প্রয়োজন উপলদ্ধ হয়। এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, আজকের যেই বিদ্যুতের ব্যবহার আমরা দেখি, ইংল্যান্ডে  মাইকেল ফ্যারাডে যখন বিদ্যুৎ আবিষ্কার করলেন তখন রানী এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে তুমি এটা আবিষ্কার করলে সেটা কোন কাজে লাগবে ? এর উত্তরে ফ্যারাডে রানীকে বললেন, মনে করুন আজকের যে শিশুটা জন্ম গ্রহণ করলো, ভবিষ্যতে সে কি করবে, সেটা জানার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। ঠিক বিদ্যুতের ব্যবহারে আগামী দিনে কি হতে পারে তার উত্তরের জন্য  সেই বিজ্ঞানীর দার্শনিক ভাবনার উপর নির্ভর করে আবিষ্কারটি সংগঠিত হয়েছিল, যেটা সাধারনের নাগালের বাইরে ছিল। ঠিক সময়ে মানুষ বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তাকে উপলদ্ধি করেছে।  মানুষ তার মন এবং বুদ্ধি ছাড়া সুন্দরতাকে  উপলদ্ধি বা বিশ্লেষণ  করতে পারেনা। 

মন যদি ছড়ানো থাকে বুদ্ধি তার নাগাল পায়না আবার মন যদি সংহত হয় বুদ্ধি তার বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করে। এই ছড়ানো ছিটানো মনকে কুড়িয়ে এনে সংঘবদ্ধ করতে একমাত্র বেদই পারে।  কিভাবে বেদ মানুষের অবিনস্ত মনকে ধীরে ধীরে শৃঙ্খল পরাতে শুরু করলো। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কারের প্রবর্তন করে মানুষের মনের শুদ্ধিকরণ করার কাজ আরম্ভ করে। যেমন, জন্মের সাথে সাথে নামকরণ, অন্নপ্রাশন, উপবীত,বিবাহ, শ্রাদ্ধকর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক পবিত্রতা গঠনের ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে আসছে। যা কিছু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করে মানুষ আত্মসুখ অনুভব করে তাইই কাম। সাধারণভাবে মানুষ কামভোগ ছাড়া কিছুই বোঝেনা, সেখানে বেদ বলল, তোমরা এই কামভোগকে পূর্ণ মাত্রায় যদি পেতে চাও তাহলে তুমি মন্ত্র পাঠ কর, যজ্ঞ করো,জপতপঃ কর তাহলে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।

 বাস্তব ক্ষেত্রে বেদ সমাজে মানুষের  দৈনিন্দন জীবনের  মধ্যে ঢুকে প্রচলিত নিয়মকানুনকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন আচার আচরণের অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনকে  পবিত্র করার চেষ্টা করেছিল। সেই পদ্ধতি আজও প্রাসঙ্গিক।কিন্তু কোন যজ্ঞ মানুষ নিজ মোহ বা কামনা বাসনা থেকে মুক্তির জন্য করেছে  কিনা জানা নেই।  যজ্ঞগুলিতে আছে শুধু একগুচ্ছ কামনা আর বাসনার  চাহিদা পূরণের ছকবাঁধা রীতি নীতি। আবার এই সবের মধ্যে দিয়ে ঋষিরা মানুষের প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য মানসিক গঠন করার লক্ষ্যেই  যজ্ঞ ও অন্যান্য নিয়ম রীতির প্রবর্তন করেছিলেন । 

 ক্রমশঃ 
ব্লগার -রবীন মজুমদার 
৩০-১১-২১ সময়।  বেলা  ১১:০৮



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়