মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-ষষ্ঠদশ অধ্যায় || (৭৯)
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-ষষ্ঠদশ অধ্যায় || (৭৯)
গত সংখ্যায় যা ছিল -বাস্তব ক্ষেত্রে বেদ সমাজে মানুষের দৈনিন্দন জীবনের মধ্যে ঢুকে প্রচলিত নিয়মকানুনকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন আচার আচরণের অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনকে পবিত্র করার চেষ্টা করেছিল। সেই পদ্ধতি আজও প্রাসঙ্গিক।কিন্তু কোন যজ্ঞ মানুষ নিজ মোহ বা কামনা বাসনা থেকে মুক্তির জন্য করেছে কিনা জানা নেই।যজ্ঞগুলিতে আছে শুধু একগুচ্ছ কামনা আর বাসনার চাহিদা পূরণের ছকবাঁধা রীতি নীতি। আবার এই সবের মধ্যে দিয়ে ঋষিরা মানুষের প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য মানসিক গঠন করার লক্ষ্যেই যজ্ঞ ও অন্যান্য নিয়ম রীতির প্রবর্তন করেছিলেন ।
বেদ, রামায়ণ, পুরান এবং মহাভারত ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্যের অন্তর্গত। তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনকে বাদ দিয়ে আলোচনা করতে গেলে গোটা আলোচনাটাই অর্থশূন্য এবং এক অসুম্পূর্ন আলোচনা বলে মনে হবে। বাস্তবে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভীষণভাগে প্রতিফলিত হয় সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার উপর।
কোন রচনাটি কখন লেখা হয়েছিল তা গবেষণা সাপেক্ষ, তথাপি ঋগ্বেদের আনুমানিক রচনা কাল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ বছর বলে পন্ডিতগণ মনে করেন। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাস পৰ্য্যালোচনা করলে দেখা যায় ,পদ্য আগে এবং গদ্য একান্ত আধুনিক কালের সৃষ্টি।
প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার নাম জীবন, সময়ে সময়ে সেটা যেমন একটু সহজ হয় আবার জটিল আকার ধারণ করে। জীবনের কথা একমাত্র সাহিত্যেই লেখা থাকে। সমাজ ও রাজনৈতিক বিবর্তনের এক একটি ধারায় হয়ত সাহিত্যের কুশীলবেরা সমাজের বিশেষ বিশেষ শ্রেণী থেকে প্রতিনিধিত্ব করে সময়ের প্রয়োজনে । আজকের আলোচ্য বিষয় ঋগ্বেদের নায়ক নায়িকাদের নিয়ে এবং তার সাথে আছে কেন তারা সাহিত্যে বিশেষভাবে তাদের জায়গা পাবার করার সুযোগ করতে পেয়েছিল। ঋগ্বেদের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিল দেবতাদের বন্দনা। অগ্নি দেবতা ছিলেন তার মধ্যে অগ্রণী নিজ গুণ বলে। সমাজে সম্পর্কের বুনিয়াদ যেখানে বিনিময় মূল্যে নির্ধারিত হয়, সেখানে যারা উপকৃত হবেন তারা তো উপকারীদের প্রশংসায় ভরিয়ে দেবে, এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই।
সভ্যতার আলো গুটি গুটি পায়ে তৎকালীন সমাজের অলিন্দে ঘোরা ফেরা করতে শুরু করেছে। তার মধ্যে অগ্নির ব্যবহার এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা মানব ইতিহাসে। কত জানা আর কতো না অজানা প্রাকৃতিক কার্যকলাপ এবং তার সাথে আছে হিংস্ত্র জন্তু, বিষাক্ত সাপ আর বিছের আনাগোনা, অজানা আতঙ্ক তাদের নিত্য সঙ্গী। এতো গেল তৎকালীন মানুষের অন্দরমহলের ছবি তার সাথে মাঝে মাঝে যুক্ত হয় বাইরের জগতের একদল লোভী মানুষের বর্বরতার শিকারের সাথে। এই জোড়া সাঁড়াশি আক্রমনে যখন মানুষ দিশেহারা তখন তাদের একমাত্র আশ্রয় স্থল ছিল দেবতার শরণ। আশাই একমাত্র মানুষের ভরসা হয়ে দাঁড়ায় যখন মানুষের নাগালের মধ্যে কিছুই থাকে না। এই অসহায় মানুষের জন্যই সেদিনের স্তব স্তুতি আর দেবতার অলৌকিকতা অস্থির মনকে সান্ত্বনা জোগাতো। সেই হিসাবে সমসাময়িক সাহিত্য শুধু জীবনের কথা বলে ক্ষান্ত থাকেনি , তার সঙ্গে বাঁচার মন্ত্র তাদের কানে শুনিয়েছে।
এখানে ঋগ্বেদ ভীষণ বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর উপর দাড়িয়ে তার রচনার তিন চতুথাংশ অংশ জুড়ে স্তব, প্রার্থনা আর যজ্ঞ করে দেবতারুপী অতিমানবদের ত্রাতারূপে বন্দনা করে এসেছেন। সেখানে আছে মানবজীবনের সবরকম সমস্যার সমাধানের উপায়। বেদের সৃষ্টিকর্তাদের কৃতিত্ব সেখানেই, যেখানে তারা তাদের দূরদৃষ্টি দিয়ে মানবজীবনের সূক্ষাতিসূক্ষ সমস্যার কথা বহুপূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন। আজকে আমরা যারা ঘরের মধ্যে টিকটিকি, আরশোলা আর ইঁদুর দেখে আতঙ্কিত হয়ে তার প্রতিকারের জন্য অনলাইনে সঙ্গে সঙ্গে ব্র্যান্ডেড ঔষধের অর্ডার করি, পাশের বাড়ীর প্রতিবেশীর জোরালো সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজে কানে এলে, থানাতে ফোন করে প্রতিকার চাই, তাদের পক্ষে বেশ কষ্টার্জিত চিন্তা হবে সেদিনের মানুষের দুরবস্থার কথা ভাবতে।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
০৭-১২-২১ দুপুর ২:৪০ মি।
মন্তব্যসমূহ