মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ২২তম অধ্যায় || (৮৫)
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ২২তম অধ্যায় || (৮৫)
সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত ইত্যাদির একটা সুনির্দ্দিষ্ট চারণভূমি আছে। যে যার স্বীয় পরিমন্ডলে বিরাজমান। সুতরাং, সাহিত্যকে নির্মাণধর্মী বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করলে পাঠক সাহিত্যের প্রতি সুবিচার করতে পারবেন কি ? এই প্রশ্নটা বার বার মহাভারতে ঘুরে ফিরে আসবে ........... একবিংশ অধ্যায়ের পর ----
মানব হৃদয়েই যদি সাহিত্যের জন্ম হয়, তাহলে হৃদয়ে তার সংবাদ পৌঁছাল কি করে। অবশ্যিই তাতে ইন্দ্রিয়ের হাত আছে। আবার যদি প্রশ্ন করা হয়, ইন্দ্রিয় কোন খান থেকে খবর সংগ্রহ করলো, এর উত্তর একমাত্র হতে পারে বাস্তবের পটভুমি থেকে। বাহ্য প্রকৃতির সেই আহ্বান বা সুর যখন অনুরণিত হলো কবির অন্তঃপ্রকৃতিতে, সেই সুরের মূর্ছনা কবির সৃষ্টিতে মুখরিত হয়ে উঠলো সাহিত্যাকারে।
মহাভারতের কবি সেই সময়ের আবেদনে, পাঠকের অলৌকিকতার প্রতি অতিৎসাহেকে সম্মান প্রর্দশনের এতটুকু কার্পণ্য না করে উদার হস্তে মহাভারতের যাজ্ঞসেনীকে উপস্থাপন করেছেন অতিরিক্ত রূপক সহযোগে। সে যুগে একমাত্র পরমপূজ্য দেবতা ছিলেন অগ্নি, তার হাত ধরে যজ্ঞের বেদী থেকে নেমে এলেন এক অনন্য নারী যিনি আপন মহিমায় ভাস্বর মহাভারতের প্রেক্ষাপটে। যিনি চোখে চোখ রেখে শত্রুর অন্তঃপুরে অন্যায়ের বিরোধিতা করেন, পুরুষ শাসিত সমাজে সমগ্র নারীজাতির প্রতিনিধি হয়ে শাস্ত্রের ন্যায়-অন্যায় নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন, একটা যুগ পরিবর্তনের সূচনাকে যুক্তি তর্ক বলে অহর্নিশ সংহত করতে পারেন এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে পারেন । তাই তিনি তো আর অন্য সাধারণ নারীদের মতো প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীতে এলে তার ভারটাও কম মনে হবে। যদিও আদিপর্বে, বনপর্বে "যজ্ঞের বেদীর আগুন থেকে যাজ্ঞসেনীর জন্ম " এই রূপকের সরলীকরণ করেছেন, তার বহু উদাহরণ মহাভারতেই আছে তাছাড়া বৃহদারণ্যক উপনিষদে মহাভারতের কিছু শব্দের রূপকের অর্থের ব্যাখ্যায় যাজ্ঞসেনীর স্বাভাবিক জন্মের স্বীকৃতি পাওয়া যায় ।
মহাভারত আদ্যপান্ত একটা ধর্মশাস্ত্র। বেদের কঠিন বর্ম ভেদ করে সেখান থেকে তত্ত্বকথা উদ্ধার করে তার স্বাদ গ্রহণ করতে সাধারণ মানুষের কালঘাম ছুটে যেত। আজকের দিনে যেমন প্রোডাক্ট বিপণনের দুনিয়ায় সেই অনুষ্ঠানের উপর ব্যাপক বিজ্ঞাপন পরে যেই সিরিয়ালটার উপর ব্যাপক দর্শক ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখে, তার বিশ্লেষণের উপর ( টার্গেট রেটিং পয়েন্ট বা (TRP)) । একটু অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, প্রাথমিক স্তরে আছে রাজোচিত ক্ষত্রিয় কাহিনী, তার প্রতি ছত্রে ছত্রে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের রোমহর্ষক অস্ত্রের ঝনঝনানি আর বীরগাথা। সেই গাঁথা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল (ওয়ার্ড অফ মাউথ ) আর মানুষই তার নাম দিয়ে দিল "জয়"। চব্বিশ হাজার শ্লোকে লেখা জয় কাব্য গ্রন্থটি মহামতি ব্যাসদেব শুনালেন তার প্রিয় চার শিষ্যদের। একদিকে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের মন্ত্রে সাধারণ মানুষকে উদবুদ্ধ করার আর অন্যদিকে সাধারনের মতো করে একটা মঞ্চ থেকে সেই নীতি ও আদর্শের বোধগুলি উপলদ্ধি করানোর। সম্ভবতঃ এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরবর্তী সময়ে মূল কাব্য জয়ের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মানবিকবোধগুলিকে। জয়ের জনপ্রিয়তাই ছিল একমাত্র পরবর্তী সংযোজনের মাপকাঠি। জয় পরিমার্জন হয়ে মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্তিতে নতুন নাম " ভরত " নামে পরিচিতি হলো এবং জনশিক্ষার আদর্শ গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলো । পরবর্তী সময়ে মহাভারত নিজেকে ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র এবং মোক্ষশাস্ত্র হিসাবে বর্ণনা করছেন কিন্তু কখন নিজেকে মহাকাব্য আখ্যা দেয় নি। ভরত নামাঙ্কনের পর ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণদের কিছু নৈতিক আদর্শ মূলপর্বের সাথে যুক্ত হয়ে নব কলেবরে বিস্তার লাভ করে গোটা কাব্য গ্রন্থটি "মহাভারত" নামে পরিচিত হয়।
ক্রমশঃ
ব্লগার : রবীন মজুমদার
২৩/১২/২০২১, কলকাতা
মন্তব্যসমূহ