মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-সপ্তদশ অধ্যায় || (৮০)
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-সপ্তদশ অধ্যায় || (৮০)
সমাজে সম্পর্কের বুনিয়াদ যেখানে বিনিময় মূল্যে নির্ধারিত হয়, সেখানে যারা উপকৃত হবেন তারা তো উপকারীদের প্রশংসায় ভরিয়ে দেবে, এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই.... ষষ্ঠদশ অধ্যায়ের পর। ................................
ভারতীয় সমাজে আমরা যে নীতিবোধ বা ধর্মের কথা পরবর্তী সাহিত্যে শুনে থাকি , সেটা কিন্তু সেই যুগের সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যায় নি। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মন প্রস্তুত না থাকলে ধর্মের জায়গা হয়না। একদিকে মনে বসে আছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার প্রশ্ন (এখানে "প্রশ্ন" শব্দটা মনে হয় সঠিক কেননা "প্রস্তুতি" শব্দটা ইঙ্গিত করে একটি জানা বিষয়কে , অজানা আকস্মিক পরিবেশের প্রস্তুতি শুধু মাত্র আতঙ্ক হতে পারে ) আর অন্যদিকে মনের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আছে ভয়। ধর্মকে জায়গা দেবার মতো কোন খালি জায়গা নেই। ( যেমন, আজকের ধনতান্ত্রিক সমাজ ও তাবেদার সরকারগুলি জনজীবনে এমন আর্থিক অনটন এক প্রকার জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, সাধারণ মানুষের জীবিকার জন্য এত সময় ব্যয় করছে যে জীবন সম্পর্কে ভাবার উদ্বৃত্ত সময়টুকুও পর্যন্ত নেই। যেমন, খরা জমিতে একটু বৃষ্টি চাষীর মনে যেমন আশার আলো দেখায়, ঠিক তেমনি মানুষ সব বুঝেও ওই একটু বৃষ্টির মতো একটু অনুদান পেয়ে জনগণ শান্ত হয়ে বাঁচার আলো দেখে। এই অনুদানের ফলে যে সামাজিক ক্ষেত্রে রূপগত পরিবর্তন হতে শুরু হয়েছে। যেমন, মানুষ ভাবতে শুরু করেছে যে, হোক সে জনগনের টাকা জনগণকে দিচ্ছে, আগে তো কেউ দেয়নি, তাই তাদেরকেই আবার মসনদে চাই। দ্বিতীয়তঃ, যদি বসে বসে স্থুল শরীরের চাহিদা মিটে যায় তাহলে শখ করে কেনই বা কাজ করা আর কেনই বা দাবি আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হওয়া। তৃতীয়ত এর সুদূরপ্রসারী ফল হিসাবে রাজনৈতিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এক বিশাল সংখ্যার মানুষকে শ্রমজীবী থেকে ভিক্ষাজীবী হিসাবে মানসিকভাবে তৈরী করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে এবং সর্বশেষে সরকারী প্রচেষ্টায় দেশকে সর্বতোভাবে দেউলিয়া হবার দিকে ক্রমশই এগিয়ে যাবার যাত্রা শুরু হয়ে গেছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা আর্থিক সৌধটা ভেঙ্গে পড়ার ) মানসিক লড়াইয়ের ক্ষনিকের অবসরে একটু সুখ আর মনে একটু আনন্দ। মন যদি অশান্ত থাকে তাহলে নীতিবোধ আর ধর্মের প্রবেশের দ্বারটা এমন সংকীর্ণ হয়ে যায় যে, তাদের আসার রাস্তাটা আক্ষরিক অর্থে বন্ধ হয়ে যায়। স্বভাবতই সমাজ সেটাকে নিয়ে ভাবিত ছিল না, কেননা সমাজে জ্বলন্ত সমস্যা ছিল টিকে থাকা। কিন্তু মানুষ চিরকালই উন্নত জীবনবোধের স্বপ্ন দেখে। বাস্তবজীবনটা শুধু মাত্র ভোগ সর্বস্য জীবন নয়, সেটা একদল মানুষ সেদিন ও বুঝেছিল আজও হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। ঋগ্বেদের এক চতুর্থাংশ জুড়ে আছে বহু সংলাপ আর আছে সৃষ্টির অনন্ত জিজ্ঞাসা, পরমাত্মাকে খোঁজার স্তরে মানুষ সেই যুগেও পৌঁছে গিয়েছিল। তৎকালীন সাহিত্য তার নিদর্শন বহন করে।
দেবতাদের বন্দনা বা স্তুতি করার কারন যদি সারা বিশ্বে একই ধরনের হয়, তাহলে তার প্রতিফলন সব সাহিত্যেই একই ভাবে প্রতিফলিত হবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে ভারতীয় সাহিত্যের পদধ্বনি শোনা যায়। সমস্যার চরিত্র যদি একই রকম সর্বত্র হয় তার সমাধানের সূত্রটাও সর্ব্বজনীন হওয়া স্বাভাবিক।
সেই সব স্তবে কি কথা বলা হয়েছিল আর কেনই বা ছিল - এই দুটি প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। জনজীবনে যাঁরা সাধারণ মানুষকে দিশা এবং প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি মেটান, তিনি বা তারা আর জনমানসে সাধারণ মানুষ হিসাবে পরিগণিত হন না বরং তারা সাধারনের মাত্রা ছাড়িয়ে অতিমানব হয়ে যান। তাঁদেরই সাম্মানিক উপাধি হচ্ছে "দেবতা"। তাকে আবার নাম আর রূপ দিয়ে আলাদা করা আছে। এনারা সমাজের বন্ধু এবং সাধারনের থেকে আলাদা, তাই তার ছবিটা চিত্রিত করতে গেলে পোশাকের, অলঙ্কারের, রূপের বর্ণনায়, গুনের কীর্তনে কার্পণ্য তো করাই যাবেনা বরং একটু অতিরঞ্জনের বাহুল্য থাকলে কোন দোষ নেই। এই সবকেই সামনে রেখে শুরু হয়েছিল বন্দনার পর পর পালা রচনা। রক্ষা কর্তার অবশ্যই অস্ত্রশস্ত্র থাকতে হবে আর সাধারনের মতো তিনি তো আর গরুর গাড়িতে যাবেন না, তিনি অবশ্যই দ্রুতগামী ঘোড়ায় টানা রথে যাবেন। আর যখন তিনি সাধারনের মাঝে আসবেন তখন তাকে অবশ্যি উৎকৃষ্ট পানীয় সহযোগে আপ্যায়ন করতে হবে। এই সব বর্ণনা তো ছিলই কিন্তু সংসারী মানুষ কখনই ভোলেন না এতসবের বিনিময়ে কি পাওয়া যাবে এবং সে জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে দেবতাদের কাছে প্রতিমুহূর্তেই চাইতেন।
ক্রমশঃ
ব্লগার =রবীন মজুমদার
০৮-১২-২১ সময় ভোর ৪:৫৫ মিঃ
কোলকাতা
মন্তব্যসমূহ