মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-অষ্টদশ অধ্যায় || (৮১)
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী-অষ্টদশ অধ্যায় || (৮১)
একটি বাক্য মহাভারতে উল্লিখিত হয়েছে যে, "যজ্ঞের বেদীর আগুন থেকে যাজ্ঞসেনীর আবির্ভাব" - সেই বাক্যের ব্যাখ্যার লক্ষ্যে আমাদের পরিক্রমা শুরু। এই অনুসরণ চলতে থাকবে যতক্ষন পর্য্যন্ত তার যথাযথ উত্তর না মিলবে, আমাদের যাত্রা বন্ধ হবেনা। হয়ত পাঠকদের একঘেয়েমি আসতে পারে, সেখানে আমরা দুঃখিত। বর্তমানে আমরা আছি এবং কিছুদিন থাকতে হবে ঋগ্বেদের যুগের সামাজিক ধ্যান ধারণার মধ্যে তার উত্তর খোঁজার মধ্যে, যেমন, বাক্যটি যথার্থ রূপক কিনা, আর যদি রূপক হয় তাহলে তৎকালীন পাঠক অলৌকিকতাকে কত খানি বিশ্বাস করে আনন্দ উপভোগ করত। সাহিত্যেরসের দৃষ্টিকোণ থেকে পন্ডিতদের বিশ্লেষণ ইত্যাদি।
সাধারণ মানুষ জানতো যে কিভাবে প্রশংসা করলে একটি দেবতাকে তুষ্ট করা যায়। মাত্রাহীন প্রশংসায় আপলুত দেবতাটি মনে মনে ভীষণ দুর্বল এবং আবেগতাড়িত হয়ে সেই অসহায় ভীরু মানুষগুলির জন্য যারপরনাই মঙ্গল কামনায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তার সাথে সশরীরে উপস্থিত হলে তো কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে অপরিমিত মদ্যপানের আতিশয্যে দেবতাদের মানসিক জমি প্রস্তুত হলে শুরু হয়ে যায় তাদের কাছ থেকে বাসনার উপকরণ পাবার আকুল প্রার্থনা।
নিঃসন্দেহে আগুনের ব্যবহার মানুষকে যে মহিমান্বিত করেছে, তাই আগুনের সেই অবদান তৎকালীন যত প্রচার মাধ্যম ছিল সেখানে মুখরিত ছিল, একই সাথে বার বার ঘুরে ফিরে সাহিত্যেও চলে আসে। আজকের মানুষেরাও ভীষণ কৃতজ্ঞ অগ্নির কাছে যে আমাদের পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্বই থাকতনা যদিনা সেদিন ভীষণ যত্ন করে তার নিচ্ছিদ্র কোলে সারা মানবজাতিকে আশ্রয় না দিত। এই আগুনই অন্যান্য প্রাণীদের সাথে মানুষের প্রভেদ গড়ে তুলেছে। তাই প্রাচীনতম বেদ, ঋগ্বেদে দশটি মোট মন্ডলের মধ্যে আটটি মন্ডল জুড়ে শুধু মাত্র অগ্নির জন্যই নির্ধারিত করে রেখেছে আর বাকি অংশে ইন্দ্রের জন্য বেশকিছু স্তব ও মন্ত্র এবং কিছু আত্মজিজ্ঞাসামূলক এবং সৃষ্টির রহস্যের অনুসন্ধিৎসা ও রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ।
চারপাশে বনজঙ্গলে ঘেরা একটা দ্বীপ, শুধু মাঝখানে মানুষের বসতি। বর্ষায় জলাশয় থেকে ব্যাঙদের কোলাহল ঘরে থাকা মানুষের পারস্পরিক কথার লেনদেনেও পর্যন্ত ব্যাঘাত ঘটাতো সঙ্গে হিংস্ত্র জন্তুদের সমবেত উচ্চগ্রামে বাধা প্রকাশের ঘনঘটায় ঘরের ভিতরে থাকা শান্তিপ্রিয় মানুষের হৃদকম্পনের মাত্রা রিখটার স্কেলের শেষ বিন্দুকেও ছাড়িয়ে যেত। সঙ্গে আছে বিষধর সর্পের হিস্ হিস্ শব্দে আগমনী গান আর চূড়ান্ত বিষধারী বিছেরা কিছু আগাম সংবাদ দেবার মতো স্বরধ্বনি না থাকায় অনাহূতের মতো গৃহীর বাড়িতে প্রবেশের নির্লজ্জতা।অরণ্যবাসী প্রাণীদের আহার সন্ধানের ব্যাপারে কোন বিশেষ পক্ষপাত নেই, কোন লোকলজ্জার ভয় নেই, সীমারেখাকে অতিক্রম না করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী গৃহস্থের উঠানে থাকা গৃহপালিত পশুদের ভোগ্য বস্তু মনে করে অনিমন্ত্রিত অতিথির মতো এক এক করে রাতের অন্ধকারে নিয়ে যেত।
অধিকাংশ সাধারণ মানুষ জন্মগত ভাবেই শান্তিপ্রিয়। সেটা কালও ছিল আজও আছে। সেটা তাদের অপরাধ কিনা জানা যায়নি কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় খেসারতকে তারা উচ্চমূল্যে কিনে যাচ্ছে , সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। প্রকৃতি তার স্বভাব অনুযায়ী তার প্রকাশের -ধারাবাহিকতাকে সৃষ্টির শুরু থেকে সভ্যতার প্রান্তে এসে একই লয়ে তার সুরকে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু সেদিনের অসহায় মানবজাতি একদিকে বনের জন্তুদের প্রতিহিংসামূলক বাজনা আর তার সাথে প্রকৃতির যোগ্য সঙ্গত, এই দুয়ের সম্মিলিত সাঁড়াশি আক্রমনে দেহ থেকে প্রাণবায়ু বেড়িয়ে যাবার জোগাড়। কে দেবে তাদের আশ্রয় আর কে দেবে তাদের নিরাপত্তা, কে দেবে তাদের সান্ত্বনা। সমাজের এই জ্বলন্ত সমস্যা উপলদ্ধি করেছিলেন সেদিনের ঋষি মুনিরা আর সেই সান্ত্বনার ভাষাগুলি ঋগ্বেদের সুক্তিতে সুক্তিতে, মন্ডলে মন্ডলে, কোথায় স্তব, কোথায় মন্ত্র আকারে, সাহিত্যাকারে , সাধারণ মানুষকে প্রতিকারের রাস্তা দেখিয়েছে। এই জীবনের গানই সাহিত্যের অন্যতম প্রাণ।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
৯-১২-২১ সময় - ভোর ৫:২৬ মিঃ
মন্তব্যসমূহ