মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- উনিশতম অধ্যায় || (৮২)

 মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- উনিশতম  অধ্যায়  ||  (৮২) 

"অধিকাংশ সাধারণ মানুষ জন্মগত ভাবেই শান্তিপ্রিয়। সেটা কালও ছিল আজও আছে। সেটা তাদের অপরাধ কিনা জানা যায়নি কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় খেসারতকে তারা উচ্চমূল্যে কিনে যাচ্ছে , সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে"- গত সংখ্যার পর। ................. 

ঋগ্বেদ শুধু মন্ত্র, স্তব ইত্যাদির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি, সেখানে ছিল সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খার কথা লিপিবদ্ধ করে সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতাকে  অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল। যেই মঞ্চ থেকে এই সামাজিক কল্যাণের মন্ত্র উচ্চারিত হতো তা ছিল সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু, সেটি হলো যজ্ঞ, বলা বাহুল্য অগ্নি ব্যতিরেকে সব যজ্ঞই অসুম্পূর্ন।  সাধারণ মানুষ সেদিন বিশ্বাস করতো এই দৃশ্যমান জগৎ যজ্ঞের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে। 

একধারে অগ্নির বহুমুখী কার্যকলাপ  ও অলৌকিকতার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস  এবং যজ্ঞের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রগাঢ় নির্ভরতা, এই সবের মেলবন্ধনের প্রভাব সাহিত্যে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মহাভারতের কবির সামনে যাজ্ঞসেনীকে মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে কি ভাবে প্রবেশ করাবে, এই নিয়ে হয়ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু সমাজের বাস্তবতার জানলা দিয়ে যখন উঁকি মেরে দেখলেন সমাজে উপস্থাপনের (presentation) সব উপকরণ প্রস্তুত, তখন আর দেরী না করে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের রঙ্গমঞ্চে আগুনের পর্দা সরিয়ে যাজ্ঞসেনীকে নিয়ে এলেন আর লেখনীতো কবির আজ্ঞাবাহক। 

ভাবনার বিষয়বস্তুকে কখনই ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে বেঁধে রাখা যায়না। সাহিত্য তার রসদ খোঁজে মানবসমাজের মধ্যে আর সমাজের সেই চিত্রটাই আবার  অন্যকোন ভাষাভাষীর দেশে একই রকম থাকতেই  পারে। অবশ্য আমাদের পূর্বপুরুষ বানর, তার  সহজাত প্রবৃত্তি যে নকল করা, তার থেকে মানুষ আজও নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। পৃথিবীর সব সাহিত্যের বাতাবরণ ভীষণ উদার, চারদিকে পাখা মেলে অতীত-বর্তমান, দেশী-বিদেশী, মাতৃভাষা-বিদেশী ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে সদর্পে এগিয়ে চলছে।  তাই দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যের নিয়ামকরা ভীষণ যত্ন করে দেশী সাহিত্যে কতটা বিদেশী গন্ধ ঢুকলো আবার জাতীয় সাহিত্যের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক খোঁজা  ইত্যাদি ইত্যাদি করে আসছে এবং তার এক সুন্দর নামও  আছে "তুলনামূলক সাহিত্য" । 

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের মহাভারতের কবির বর্ননায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্যতম প্রেরণাদাত্রী যাজ্ঞসেনীর অসাধারনত্বকে বোঝাতে গিয়ে, জন্মের শুরুতেই অভিনবত্ব এনে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় সে যুগে যজ্ঞের আগুনের  বেদী থেকে বেরিয়ে আসা অগ্নিকন্যা যাজ্ঞসেনীর সেই অগ্নিকন্যা শব্দটি আজ নারীজাতির অসাধারণত্ব বোঝাবার প্রতিশব্দ হয়ে মানুষের মনের শব্দকোষে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ফরাসী সাহিত্য সমালোচক ফিল্মান তুলনামূলক সাহিত্যের তুলনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, " তুলনামূলক সাহিত্য হলো সেই সাহিত্য যা প্রত্যেক দেশ অন্য দেশের সাহিত্য থেকে চুরি করে যা গ্রহণ করেছে তারই  অনুসন্ধান "। ( ফরাসী দেশে আমরা জানিনা কত মাইল অতিক্রম করলে ভাষা এবং আচার আচরণ পাল্টে যায় এবং  সাহিত্যও তার প্রতিফলন হয়, কিন্তু এই ভারতে এটাই বাস্তব, সুতরাং আমাদের ক্ষেত্রে সাহিত্য সমালোচক মহাশয়ের ব্যাখ্যার সাথে এটা সংযোজন করা যেতে পারে, দেশের জায়গায় অঙ্গরাজ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না ) ব্যাখ্যা যদি তাই হয়, তাহলে "অগ্নিকন্যা" শব্দটি  কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব মহাশয়ের কাছ থেকে চুরি করে আজ বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।  


  ক্রমশঃ 

 


ব্লগার - রবীন মজুমদার 
 
১০-১২-২১ সময় - ভোর ৪:৫৭ মিঃ 











মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়