সভ্যতার নামে প্রহসন (১১৭)

 

সভ্যতার নামে প্রহসন (১১৭) 



বর্তমানে পৃথিবীর মানব সমাজকে বিশেষণে ভূষিত করে যত্ন করে সম্বোধন করা হয় সভ্য সমাজ হিসাবে। এই উপাধি কে দিয়েছে, কেন দিয়েছে বা কারা দিয়েছে তা আজ ভেবে দেখা দরকার । আমরা ভারতবর্ষকে এক প্রাচীন সভ্য দেশ বলে থাকি । কিন্তু একথা কি আমরা ভেবে দেখেছি যে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থা এ দেশে মানুষের সাথে মানুষের আচরণ বিধি  যা প্রচলিত আছে তা যদি সভ্যতা হয় তা হলে অসভ্য সমাজ বলব কোন সমাজ কে ? 

যদি বলা হয় যে ভারতবর্ষ একটি অসভ্য দেশ তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ ও দেশের সরকার সমস্বরে বলে উঠবে, এ কথাটি  অসত্য কথা। কারণ ভারতীয় সভ্যতা হল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন  শ্রেষ্ঠতম সভ্যতা। যদি বলা হয়  এসবের প্রকৃত ব্যাখ্যা কি? তখন তারা বলবেন,  কেন  বেদের মত শ্রুতি সাহিত্য , বুদ্ধ দেবের মত মহান পুরুষ , অশোকের মতো রাজা ( অন্যন্য রাজার কথা উহ্য থাকবে) ,  শ্রীচৈতন্যর মত  মানব  প্রেমিক , শ্রীরামকৃষ্ণের মত   অবতার, স্বামী বিবেকানন্দর মত দার্শনিক সন্ন্যাসী , রবীন্দ্রনাথের মত  বিশ্ব বন্দিত কবি ও মানবতাবাদী, শরতচন্দ্রের মত সাহিত্যিক, বিদ্যাসাগরের মত সমাজ সংস্কারক  জন্মেছিলেন । রচিত হয়েছিল রামায়ণ মহাভারতের মত মহা কাব্য । 

কেউ যদি বলেন ক্রমবিকাশের ইতিহাসে সমস্ত দেশেই যুগে যুগে মনীষীরা  জন্ম গ্রহন করেছিলেন ।  কিন্তু বিকাশের ধারার সাথে সামঞ্জস্য না থাকায় সমাজে স্থায়ী প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়নি  এবং সভ্যতার সাথে সংযোগ  ঘটেনি । তাহলে অবশ্যিই স্বীকার করতে হবে ব্যক্তিগত সৃষ্টির সাথে সভ্যতার কোন  সংযোগ নেই ।  আবার অন্য দিকে সভ্যতা বলতে যদি বলাহয় যে,  বর্তমান জীবন যাপন  অতীতের থেকে উন্নত তাহলে বলতে হয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি সভ্য।  একদা এই পৃথিবীতে ইংরেজ জাতি বা বর্তমানে মার্কিনিরা  অন্যান্য জাতির চেয়ে উন্নতর যাপন করত বা করে , তাই বলে তাদের কি সর্বাপেক্ষা সভ্য জাতি বলে শ্রদ্ধা জানাতো।  

সমাজবাদী দেশ ব্যাতিত অপরাপর দেশগুলির মধ্যে আজ যারা উন্নত  বলে দাবি জানায় বা আমরাও মনে করি তাদের ইতিহাস যদি আলোচনা করা যায় তাহলে আমরা কি দেখতে পাই, ছল  চাতুরির দ্বারা অপর দেশকে করতলগত করে এক নিষ্ঠূর   শাসন ও শোষনের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের আর্থিক  অবস্থ্যাকে তুলনামূলকভাবে উন্নত অবস্থায় নিয়ে যেতে  সক্ষম হয়েছে। এরকম একটি উন্নত জাতির সাথে আমাদের দীর্ঘ ২০০ শত বছরের পরিচয়ের মাধ্যমে তার চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের যে ভারতবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেরূপ সে কাহিনী   এটাই নিষ্ঠূর , এতটাই ভয়াবহ - যা কল্পনা করলে আজ আমরা ভয়ে শিহরিয়া উঠি। 

অবশ্য ৭৪ বছর  ভারতে স্বাধীনতা ভোগ করার পর আজ আর ভারতবাসী সে ইংরেজদের ভয়াবহ অত্যাচারের কাহিনী কল্পনা করে ভয়েতে শিহরিয়া উঠেনা বরং সান্ত্বনা  পায়।  আজ  আমরা দেখতে পাচ্ছি যে , দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত যথার্থ সভ্যধারী মানুষ সকল একটি উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতাকে সভ্য মানুষেরা বলতে চায় ব্যক্তিস্বাধীনতার নব প্রকাশ। এই নব রূপের প্রকাশ আমরা দেখি সমস্ত দেশ জুড়ে সর্বত্র। 

বাসে,  ট্রামে, ট্রেনে, কলকারখানায় , অফিসে , হাট-বাজারে, এমনকি শিক্ষায়তনেও। এই নব রূপটি হল অপরের শুধু অসুবিধার বিনিময়ে নয়, অপরের প্রাণের বিনিময়েও বটে। শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষণস্থায়ী আনন্দের জন্য।  

আজ পর্যন্ত মানুষ যা কিছু জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সেই জ্ঞানের বেশিরভাগ প্রয়োগ করেছে সভ্যতার জন্য নয় বরং এই  যে, দেশের  ধন সম্পদ ও বিদ্যা বুদ্ধি দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে ব্যবহার না করে , ব্যবহার করা হবে মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের স্বার্থে এবং পাশাপাশি সরকার ও সংবাদপত্র গুলি সমস্বরে গণতান্ত্রিক সমাজ বলে আখ্যা দিয়ে তাকে লালন পালন করবে , আর জনসাধারণ বুঝে-না বুঝে তাকে জয়ধ্বনি দিয়ে অভিনন্দিত করবে। 

এই মহান কাজে কোন ব্যক্তি বা দল অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে বা সন্দেহ প্রকাশ করে, তাহলে অবশ্যই তার স্থান হবে গণতন্ত্রের কারাগারে, উপাধি দেওয়া হবে বিদেশী শক্তির চর বলে। যুগে যুগে  শাসকদের এটাই চরিত্র। আমাদের গণতান্ত্রিক সরকার এমন একটা সমাজ সৃষ্টি করেছে আজ আর কোন করুন দৃশ্য মানুষকে বিচলিত করেনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করার ইচ্ছাটা  আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বিশ্বাস না করে উপায় নেই যে, যখন দেখি কোটি কোটি শিক্ষিত - অশিক্ষিত মানুষ অন্যান্য প্রাণীর  মতো কাজ ও খাবারের জন্য ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে , লক্ষ্য পূরণে বার্থ হলে পারিবারিক দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।  শোষক দলের সীমানা পাহারা দেওয়ার কাজ আজ আধুনিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম, কতিপয় বুদ্ধিজীবী নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  সাধারণ মানুষ যখনই এই ব্যবস্থায় ভ্রুকুটি প্রকাশ করে তখনই একদল আঁতেল রকমারি  উপঢৌকনের পরিবর্তে মহান সভ্যতার ঝকমারি গল্প সুসজ্জিত মোড়কে সাধারণ মানুষের কাছে পরিবেশন করে এই সমাজকে বারবার  বিভ্রান্ত করছে ।  

যে সব ইন্দ্রিয় সংকৃতির ধারক হয়ে  মানুষকে প্রভাবিত করে সু শব্দ পরিবশেন করে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে, সেখানে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে কুরুচিকর শব্দ প্রয়োগ করে   সমাজকে কলুষিত করছে , তখন মনে হয় শ্রবণ ইন্দ্রিয় না থাকলেই ভালো হতো।  গণতন্ত্রে   যদিও বা পাঁচ বছর অন্তর প্রতিনিধি পাল্টান যায় কিন্তু সরকারি দাক্ষিণ্যে সমাজটাই ভীষণ অনুকরণ প্রিয় হয়ে ইতিমধ্যে শব্দকোষের  বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে।  যার প্রভাব সুদূর প্রসারী।এরা কি ভাবে পাল্টাবে। বাহ্যিক দূষণকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য বহুবিধ আধুনিক ব্যবস্থাদি আছে কিন্তু অভ্যন্তরীন দূষণকে  কে মুক্ত করবে ? তার জন্য না আছে কোন আইন , না আছে কোন সংশোধানাগার। তাই সার্বিক ভাবে সমাজ আজ বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন। মারণরোগ বাসা বেঁধেছে সমাজে।  সমাজে সংখ্যা গরিষ্ঠ হচ্ছে  সাধারণ মানুষ , তাই তাদের  এই মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে । বিচ্ছিন্নতা নয় মূল আদর্শকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের একতা -ই  হচ্ছে একমাত্র মুক্তির পথ। 

ব্লগার - রবীন মজুমদার 


 মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৫৩ তম  অধ্যায় (১১৭)

Searching for hidden Truth (২১) 


 



মন্তব্যসমূহ

My new blog বলেছেন…
ভীষন বাস্তব

My new blog বলেছেন…
ভীষণ বাস্তব



এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়