আগামী (১২১)
আগামী (১২১)
জীবনের বহু ক্ষেত্রের অপূর্ণতাকে কবি মেনে নিয়ে ছিলেন কিন্তু আশাহত হননি বরং একটা পরম্পরা তৈরী করে গিয়েছিলেন, যেই পথ দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা তাঁর যাত্রার শেষ থেকে তাদের যাত্রা শুরু করবেন। জীবনের প্রান্তে পৌঁছে তিনি এই আত্মপোলদ্ধি করেছেন এতদিন ধরে যা কিছু বাইরে খুজেছিলেন, সেটা তার মনের অন্তরালে বাস করছে আর সেখানে পৌঁছানোর রাস্তাটা ভীষণ দুর্গম।
গত সংখ্যার পর ০ ০ ০ ০ ০
যদি ধরে নেওয়া হয় কবির জীবনের সেই অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আরেক এক নবীন কবি এই দুর্গমতার রহস্য ভেদের মন্ত্র লিখে ফেললেন -
"দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার হে !
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ
ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, কার আছে হিম্মত।
কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষত
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।"
কবিতার লাইনগুলিকে যদি রূপক হিসাবে ধরা হয় , তাহলে তাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে - জীবনের যাত্রাপথের রাস্তাটা সর্বস্তরেই ভীষণ কণ্টকাকীর্ণ। সামনে অজ্ঞানতা স্বরূপ অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে,মায়া বিভিন্ন আবরণে একই রূপকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তোমার সামনে প্রকাশমান হয়ে তোমাকে বার বার বিভ্রন্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, তাই, হে মানব, দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে একে একে জীবনের সাথে সমান্তরালভাবে হেটে চলা যাত্রী স্বরূপ লোভ-কামকে, যে তোমার অন্তঃকরণে এক ঝড়রূপী আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং ক্রমেই মায়া তাকে নেতৃত্ব দিয়ে এক লক্ষহীন ভ্রান্তির পথে ক্রমশই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় হয়েছে, তুমি তোমার আত্মাকে জাগিয়ে তোল, সেই আত্মা বা চেতনাকে কান্ডারী করে পরাস্ত কর সেই বিভ্রান্তির প্রাচীরকে। এই জীবনরূপী নৌকার হালকে মাঝি স্বরূপ চৈতন্য ঠিক লক্ষের পথে টেনে নিয়ে যাবে আর সেখনেই পরমব্রহ্মরূপী ভবিষৎ,মুক্তির বাতাবরণ তৈরী করে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
অনন্তের প্রতি জিজ্ঞাসা নিরবিচ্ছিন্ন কাল ধরে প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের জিজ্ঞাস্য ছিল। কবি সাহিত্যিকরা সাধারনের থেকে এ ব্যাপারে চিরকালই অগ্রণী। তাই তাদের সৃষ্টিতে বিভিন্নভাবে জীব ও জগৎ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাঠকদের কাছে তুলে ধরে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আসছেন, যে মানব জীবনের গতিপথের নির্দিষ্ট লক্ষ্য কি হওয়া উচিত। মননশীল মানুষের ভাবনার গভীরতা তাদের একসময়ে পার্থিব জগতের সীমাব্ধতাকে অতিক্রম করে তারও বাইরে নিজ অন্তরের প্রশ্নগুলিকে তুলে দিয়েছে আর জানতে চাইছে এই জীবনে মুক্তি কোথায় মিলবে, যেখানে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি বাস করছে, কোথায় সেই ভবিষৎ রুপী ব্রহ্ম ? এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বাইরের জগতে না পেয়ে, জ্ঞানের আলোকে খোঁজ পেল, যাঁকে সে খুঁজছে, সে আর কোথাও নেই, আছে শুধু তার অন্তপ্রকৃতিতে। খুঁজে পেয়েছে তার ঠিকানা,কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে আর পারেনি। সেই ভাবের প্রকাশকে পাঠকের কাছে কবি-সাহিত্যিকরা মেলে ধরেছেন বিভিন্নভাবে তাদের সৃষ্টিতে।
মানবদেহের অন্দরে রক্তের মধ্যে বহু জীব বাস করে আর সেখানেই তারা জন্ম মৃত্যুর খেলার শুরু থেকে শেষ করে ওই স্থুল শরীরের মধ্যে, বিজ্ঞানও তাকে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা ভাবে ঐ স্থুল শরীরটিই হচ্ছে তাদের জগৎ। ঠিক তেমনি দেশের তথাকথিত কান্ডারীরা আত্মবিস্মৃত হয়ে ভাবে নিজেদের ভোগের রাজ্যের সীমানাটাই তাদের জগৎ , তার বাইরে আর কিছুই নেই।
কবির আবেদন দেশ ও কালকে ছাপিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক যদিও বাইরের এবং অন্তরের প্রকৃতিতে অশুভ শক্তির চরিত্রটা একই সূত্রে বাধা। মায়ার আবরনে যেমন অন্তপ্রকৃতিতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় ঠিক আজ তেমনি কান্ডজ্ঞানহীন রাজপুরুষদেরও অসত্য প্রচারে সাধারনের মনে মিথ্যার আবরন দিয়ে সত্যকে সাময়িকভাবে ঢেকে দেওয়া হয় । কিন্তু হোকনা সেই জগতটা অন্ত প্রকৃতি বা বাহ্য প্রকৃতির কিন্তু দুইয়ের মধ্যে একটাই উদ্দেশ্য, সেটা হচ্ছে মনজগতে বিভ্রান্তির সূষ্টি করা এবং উভয় ক্ষেত্রেই উত্তরণের একটাই বিকল্প তা হলো প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ।
মানুষের প্রতিজ্ঞা যখন প্রস্তুত হয়,আত্মজ্ঞান যেখানে নেতৃত্ব দেয়, তখন মায়ার প্রভাবে আছন্ন সমুদ্রের ঢেউকে আর নাম আর রূপের প্রতারণায় জলের থেকে আলাদা করা যায় না, মনের দ্বৈতভাবের অবসানে অদ্বৈতভাবনায় পার্থিব জগৎকে যখন পর্য্যবেক্ষন করবে তখন সবকিছুর মধ্যেই অভিন্ন রূপেকেই সে দর্শন করবে। বিভেদ যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে দ্বন্দ কোথায় আর সেইখানেই অপার শান্তির নিবাস।
বাস্তবে বাসনার পূজারী যারা প্রতিমুহূর্তে সজাগ থাকে তাদের আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্ম হচ্ছে কিনা ?( হানাহানির ধারাবাহিক ইতিহাসের প্রকৃত কারন তাই) কেননা লোভ কখনই হজম করতে পারে না কোন প্রতিদ্বন্দিতাকে। যদি কখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয়, সেই হারিয়ে যাওয়া সম্পদকে তারা রক্ত নদী থেকে উদ্ধার করে,আর জয়ের নামে পাশবিক উল্লাসে ফেটে পরে।
ভারসাম্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, এই জড় প্রকৃতি গঠিত স্বত্ব, রজঃ , তম গুনের উপাদানের দ্বারা। তারা ( যারা সমাজকে কলুষিত করছে) বিশেষ ভাবে রজঃ এবং তম গুনকে অতিক্রম করে সত্ত্ব গুনের অধিকারী হয়না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে তামসিক জীবনের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় ( প্যাথোলজিক্যালি রক্তে তমো প্রোপার্টিটা টলারেন্স লেভেলের থেকে অনেক উঁচু দিয়ে প্রবাহমান, অন্যভাবে বলা যায় তমোবিষে আক্রান্ত ) । সুতরাং , আজ সত্যিই তুফান উঠেছে, সত্যিকারের মাঝিকে এই হাল ধরার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
ক্ৰমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৫৬ তম অধ্যায় (১২০)
Searching for hidden Truth (24)
মন্তব্যসমূহ