দূরের চিঠি - (১২৩) প্রথম সংখ্যা
দূরের চিঠি - (১২৩) প্রথম সংখ্যা
জন্ম ১৯শে জুলাই, ১৯৮৫। তিরোধান ৩০শে জুলাই, ১৯৯০
নামনি
প্রিয় নামনি ,
আসে কোন তরুণ অশান্ত
আজ সকাল থেকে আকাশটা যেন পণ করেছে কিছুতেই মেঘকে ছুটি দেবেনা। পার্ক নার্সিং হোমের পাশে এ জে সি বসু রোডে প্রায় এক হাটু সমান জল জমে গেছে। বাইরে বিরামহীন বর্ষনের সুরটা আমার কাছে আজ সার্বজনীন বেদনার অনুভূতিকে বহন করে আনছে। এ যেন প্রিয়জনের বিদায়ের একটানা সানাইয়ের বিষাদের সুর বেজে যাচ্ছে।
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা
৩০শে জুলাই, ১৯৯০, আজকের থেকে ঠিক পাঁচ বছর ১১ দিন আগে বহু প্রলোভন দেখিয়ে এই বিশ্ব প্রকৃতি আমাকে এই পৃথিবীতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলে। আজ আমি পার্ক নার্সিং হোমের ৯ নং বেডে তোমার কাছে শুয়ে আছি। মনে আছে , আমি হঠাৎ করে তোমাকে বলে উঠলাম আমার বালিশটা একটু উঁচু করে দাও আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি চঞ্চল হয়ে উঠলে , ভাবলে অক্সিজেনের নলটা হয়ত ঠিক নেই, সেটা জানতে সাহায্য চাইলে নার্স আন্টিদের কাছে।
আজ কিন্তু এসবের কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই, সেটা আমি উপলদ্ধি করতে পারছি। যেখানে জীবনের প্রবাহ প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁধা সেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান তো অসহায়। জীবন মৃত্যুর খেলার যেখানে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মৃত্যু সেখানে দুন্দুভি বাজিয়ে তার বিজয়বার্তা ঘোষণা করাটা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তাই জীবনের সব দন্দ্বের প্ৰয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে , আছে শুধু প্রতীক্ষা আর এই মাঝখানের সময়টা হচ্ছে আমার একান্তই অবসর।
আমার বন্ধ ঘরে স্মৃতির ঝাকুনি
জীবনের লক্ষ্য যখন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়, সব কোলাহল সেখানে বিদায় নেয়। চঞ্চলতা যেখানে অনুপস্থিত মন তখন এক শান্ত দীঘি। তখনিই বোধহয় স্মৃতিকে স্মরণ করা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।আমার অবস্থা ও আজ ঠিক একই সুরে বাঁধা । আজকে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার স্মৃতির পাতা গুলিকে এক এক করে পড়তে আর বলতে ইচ্ছা করছে। বিগত দেড় মাস যাবৎ আমি চলাচলের দোলায় আছি। ডাক্তার বাবুরা তার কারন হিসাবে তাদের পরিভাষায় ব্যক্ত করেছন, বলেছেন, ওটাকে বলে Viral Myocarditis , আমার অবশ্য তাতে কোন মাথা ব্যথা নেই, কেননা, আমি ওটা বুঝিনা।
জীবনমরনের সীমানা ছাড়ায়ে
নামনি, জীবনে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘটনাগুলিকে সাজাতে পারবনা কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবে বলতে পারবো। সেই আমার সকাল বেলা কে বি ব্লকের ফ্ল্যাটের ঝুল বারান্দায় শিকের মধ্যে পা গলিয়ে, গলা ছেড়ে গান করাটা আর বুঝি হয়ে উঠবেনা। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম এই বিশ্বপ্রকৃতি আমার অস্ত্বিত্বকে অস্বীকার করার জন্য ভীষণ উৎসাহিত হয়ে পড়েছে। অথচ জানতো , তারাই এতদিন আমার প্রতি তাদের দয়া মায়া দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল , আমার জীবনে দিয়েছিল অনেক আলো, জল, অফুরন্ত বাতাস , কত না খাবার দিয়েছিল আর আমাকে আরো কত প্রলোভন দিয়ে বেঁধে রেখেছিল এই বিশ্ব সংসারে সম্পর্কের জটিল বাঁধন দিয়ে। জানিনা, কি এক অজানা কারনে আজ হয়তো তাঁদের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তাই তারা আমাকে আর এই সংসার থেকে আমার স্থায়ী ঠিকানায় স্থানান্তরিত করবে বলে মন স্থির করে ফেলেছে। তাঁরা দাঁড়ি টানবে আমার উদ্বাস্তু জীবনের। আজ কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাকে সেই পরমপিতার সাথে মিলিত হতে হবে।
কি গান বাজে আজি আমারি অন্তরে
নামনি, একটু ভেবেই দেখই না, এইতো পাঁচবছর আগে আমি এই বিশ্ব সংসারে এলাম, সেদিন আমার নিজের কিচ্ছু করার ক্ষমতা ছিল না, আজ দেখ, আমি হাটতে শিখেছি, বলতে শিখছি, ভাবতে শিখছি। আজ থেকে তোমরা আর আমার এই রক্ত মাংসের শরীরটাকে আর দেখতে পারবে না, শুধু আমার অস্তিত্বের উপস্থিতিটা তোমার অন্তরে অনুভূত হবে। এই পর পর ঘটে যাওয়া সংক্ষিপ্ত জীবনের ঘটনা গুলি শুধু স্মৃতির পটে থাকবে। আগামী দিনে তোমাদের ব্যস্ত জীবনের অবসরে স্মৃতির পাতাটা উল্টে পাল্টে আমাকে খুঁজবে।
যার কোন স্থায়িত্ব নেই, যে ঘন ঘন পরিবর্তনশীল তাকে কি করে সত্য বস্তু বলবে। আমি যদি চিরন্তন না হই তাহলে আমি তো ক্ষনিকের। যে বস্তু ক্ষনিকের সে কখন সত্য়বস্তু বা চিরস্থায়ী হতে পারেনা, তাই আমি মিথ্যাবস্তু ; শুধু শুধু সেই বস্তুকে অহংকারের বশবর্তী হয়ে কেনই বা নিজের বলে ভাববে ? যে মিথ্যা সে তো অচিরেই তার রূপের পরিবর্তন ঘটাবে , আর তখন তার পূর্বের রূপকে দেখতে না পারার বিরহে যে কাতর হয়ে পড়বে, সেটাই তো মায়া। যেই যুক্তিতে আমি এই বিশ্ব প্রকৃতির একজন প্রতিনিধি যখন মিথ্যাতে পর্যবসিত হতে পারে ; তখন ঠিক একই যুক্তিতে এই পরিবর্তনশীল জগৎ সংসারও মিথ্যা।
ফিরে দেখা কটা দিন
সম্ভবতঃ সময়টা ছিল জুন ১৯৯০ 'র তৃতীয় সপ্তাহ, তোমরা আমাকে ডাক্তার তালুকদারের কাছে খুব সকালবেলা নিয়ে গিয়েছিলে , তিনি আমাকে দেখেই তোমাকে বলল পার্ক নার্সিং হোমে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে দিতে। তারপর ডাক্তাররা কি কি করেছিল আমি সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছিনা। নার্সিং হোমের ৫ নং বেডটি সেদিন নির্ধারিত হয়েছিল আমার থাকার জন্য। বেডটা একদম জানালার ধারে ছিল, সাময়িক সুস্থ হবার পর, আমি বেডের উপর বসে বড় রাস্তাটা দেখতে পারতাম। জানো নামনি , আমি লক্ষ্য করতাম আমারিই মতো বা একটু বড় ছাত্ররা কি আনন্দের সাথে মজা করতে করতে তারা কখন মা'র বা বাবার হাত ধরে স্কুলের ড্রেস পরে যাচ্ছে। আমি সেদিন ভাবতাম, আমি কি আবার পূর্বের মতো স্কুলে যেতে পারবো ? বোধ হয় আর হয়ে উঠবেনা। সময়ের বিরামহীন অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে ক্যালেন্ডারের তারিখগুলির যোগ্য সংগত ,আমাকে আমার অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করছিল। হয়ত প্রত্যেক মানুষই অসহায় ভাবে বিশ্ব প্রকৃতির অসহযোগিতাকে সময়ের অমোঘ নিয়ম মনে করে নিজের সাথে মানিয়ে নেয়, কাল এইভাবেই এগিয়ে চলে।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ