দূরের চিঠি - ১২৪ দ্বিতীয় সংখ্যা

  দূরের  চিঠি    -  ১২৪  দ্বিতীয় সংখ্যা 


ভুবন মিলে  যায় সুরের রণনে 

নামনি, আজকে যখন  ওপারের  শঙ্খধ্বনির শব্দটা  ক্রমেই কাছে , আরো কাছে এসে  আমার হৃদয়ে অনুরণিত হচ্ছে , আমি সেই শঙ্খনাদের অর্থ জানি, এটা তাদের  আমাকে বরণ করার   আনন্দধ্বনি। এই  সুরের রণনে একে একে   খসে যেতে লাগলো কৃত্রিমতার মুখোশগুলি  আর সেখান থেকে উন্মোচিত হল  চেতনার , যিনি জগৎ সংসারে আত্মা বলে পরিচিত। এই আত্মার স্বভাব হচ্ছে অপরিবর্তনীয় । সেখানে তাই  হারিয়ে যাবার কোন বেদনাও নেই। শুধুই আনন্দই সেখানে বিরাজমান । সেটাই আমার গন্তব্যস্থল। আর আজ যেখানে আছি সেটাতো  নকল বুদির গড় ,  তাইতো মুখোশ পড়া সম্পর্কগুলি একটা সময় পর্যন্ত আসল বলে মনে হয়, কিন্তু সেটা সাময়িক। যাঁর  কোন স্থায়িত্ব নেই তাই  সে নকল। সে যখন সেই মুখোশ খুলে মঞ্চ থেকে বিদায় নেয়, তখন সবাই সেই মুখোশকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। আমিও তোমাদের কাছে সেই মুখোশ পরা 'বাবাই' যে এই মঞ্চে ৫ বছর ১১দিন ধরে  তোমার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে গেলাম। 

এইতো, সেদিনও নার্সিং হোমে প্রতিদিনের মতো বাবা আর গৌতম মামা নিচের বেঞ্চিতে সারা  রাত থাকতো আর বাবা সকালে এসে আমার পাশের টুলটায় বসতো, যখন তুমি ওয়াশ রুমে যেতে, ঠিক সেই সময়টায় আমাকে পাহারা দেবার জন্য । এমন একদিন, আমি বাবাকে বললাম আমাকে "দিনের শেষে ঘুমের দেশে " এই গানটা শোনাবার জন্য। হয়ত, তুমি এই গানটা অনেক ভালো গাইতে পারতে, আমি তোমাকে তাই অনুরোধ করিনি, পাছে তুমি গানটার মানে  খুঁজে বের করে আশাহত হয়ে পর।  আর আমি জানতাম আমার এই গানটির জন্য বাবাকে যে অনুরোধ করেছিলাম, সেটা বাবা তোমায় কখনই জানাবে না। বাবা আমার অনুরোধে তার সাধ্যমতো গানটা খুব নিচু লয়ে গাইলো, আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বাবার চোখের কোনটা চিক চিক করছে। সেই পারস্পরিক নীরব চাহনি বুঝিয়ে দিল আগামী দিনের সম্ভাব্য পরিণতির ভাষাকে,  বাবা সেটাকে পড়তে পেরেছে । 

 সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা 

নামনি, তোমার মনে আছে আমরা দুজনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতাম ; "ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল স্থলে জলে বনতলে"  বা কখন  " মোর বীনা উঠে কোন সুরে বাজি, কোন নব চঞ্চল ছন্দে" ।   আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের  মনাদিদি, জেঠিমা, সামনের বাড়ীর দ্বিপেন দাদু আরও অনেকেই  আগ্রহভরে শুনতো। মনে হতো তারা যেন  বাহবা দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করছে । আমার গান করার ইচ্ছাকে   অনেকটা  বাড়িয়ে দিত।  সেই ছন্দটা বোধহয় হারিয়ে ফেললাম ।

জানো নামনি , আমার কেমন যেন মায়া পরে গিয়েছিল এই পৃথিবীর প্রতি। এই পৃথিবীর আকাশ বাতাস থেকে প্রানভরে  অনেক অনেক নিশ্বাস  নেবার ইচ্ছা ছিল। প্রজাপতিদের সাথে লুকোচুরি খেলা , আবার সেই দিনগুলি, যখন তোমারা যখন অফিস চলে যেতে আমি স্কুল থেকে ফিরে যখন বেলেঘাটার বাড়িতে আম্মার কাছে দুপুর বেলাটা আমি আর আমার মাম্পি দিদি থাকতাম,  তখন কি না মজা হতো। দুপুর বেলা আম্মা একটু ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের দুস্টমি শুরু হতো। মাঝে মাঝে  নিচের বস্তির সমবয়সীদের  সাথে দোতালার উপর থেকে খেলা করতাম।  কখন কখন  ফ্রীজ থেকে ডিম বের করে তাদের দিকে ইট ছোড়ার মতো  ডিম ছুড়তাম। পরে অবশ্য তার জন্য মাম্পি  দিদিই আম্মার কাছ থেকে বকা খেত।  

 আরো অনেক  দিন তোমাদের সাথে থাকার ভীষণ  ইচ্ছা ছিল। জানতো, নামনি আমরা ভীষণ অসহায়। প্রাণ ভরে এই প্রকৃতির কাছ থেকে নিশ্বাস  নিতে চাই, যেমনটি আগে নিতাম, আজ কারা যেন সেই বায়ু প্রবাহের গতিকে  রুদ্ধ করে দিয়েছে , আমার কাছে তাকে আর ঘেঁষতে  দেয় না। যেটা আমার চলে যাবার অন্তিম লগ্নে বুঝতে পারছি, সেটা এতদিন কাউকে বোঝতে পারিনি। এতো বিশ্ব প্রকৃতির এক ধরনের স্বৈরিতা, সবাইকে দিচ্ছেন কিন্তু আমার প্রতি কেন তার এতই কৃপণতা। কিছু প্রশ্ন আজ করতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা ! এই পৃথিবী কি পারতোনা আরো কিছুদিন  একটু  আলো, বাতাস দিয়ে আমাকে তোমাদের  সঙ্গী করে রাখতে ?  আজকের এই  ক্ষণিকের অতিথি হয়তো বা তোমারই সৃষ্ট জগতে তার নিজের কৃতিত্বের অধিকারী  হয়ে এই বিশ্ব সমাজকে তার অবদানের  মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারতো,    তাতে হয়ত আমার প্রতি  প্রকৃতির  দানের ঋণটা  শোধের সুযোগ পেতাম ।  যেখানে   আমার বিদায়ের ভারটা এই বিশ্বের কাছে একটা পাহাড়ের মতো হতে পারতো, সেখানে আমার বিদায়টা একটা পাখির পালকের থেকেও হালকা হয়ে যাবে আগামী দিনে । 

আমি যখন প্রথম উদ্বাস্তু হলাম 

এইতো সেদিন, যেদিন লেডি ডাফরিন হসপিটালে আমার পার্থিব রূপটা তোমার নাড়ির সাথে আমার নাড়ির সম্পর্কের ইতি টেনে এই বিশ্ব চরাচরে আমার অস্তিত্বটা প্রকাশিত হলো। সেই আমার জীবনে  উদ্বাস্তু হওয়া।  সেদিন অনুভব করছিলাম আমার অস্তিত্বের প্রমানের প্রাথমিক পরিভাষা ছিল আমার কান্না। সেই  কান্নার সুরটার অর্থ হল আমার জীবনে প্রথম পরাধীনতার মালাটা পরিয়ে দেবার প্রতিবাদ। এই পৃথিবী আমার পায়ে  ঠিক সেদিন থেকে বন্ধনের  শিকলটা পরিয়ে দিল, আমার কান্না সেই শৃঙ্খলিত মানুষের প্রথম আর্তনাদ। 

ক্রমশঃ 

ব্লগার - রবীন মজুমদার 

মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
পড়ে মন ভারাক্রান্ত হলে ও ভালো লাগলো আত্মার শান্তি কামনা করি__শিখা ডিপিএস

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়