দূরের চিঠি - ১২৫ তৃতীয় সংখ্যা
দূরের চিঠি - ১২৫ তৃতীয় সংখ্যা
শুরু হল মায়ার খেলা
নামনি, আমিও তোমাদের মতো অচিরেই সেই মায়াবী প্রকৃতির দাসত্ব করতে শুরু করলাম। আমাকে ঘিরে পরিবার পরিজনদের যে আবর্ত রচনা হলো, আমার মনে হল আমি এক সূর্য, যে শুধুই আনন্দের সুধা বর্ষণ করে আর তোমরা সেই পৃথিবী যারা আমাকে পরিক্রমা করে সেই আনন্দের অংশীদার হও। যখন আমি অকারনে হেসে উঠতাম তখন তোমাদের চাহনিতে একটা পরিতৃপ্তির ছবি যেমন ভেসে উঠতো আবার যখন কেঁদে উঠতাম তখন তোমাদের চোখে মুখে ফুটে উঠতো নীরব এক উৎকন্ঠার চাহনি। সেই দেখে আমার মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার হতো, সেটা তোমরা বুঝতে পারতে কিনা জানিনা। আমার জানার প্রাথমিক পাঠটা পরিবারের আচার আচরণকে ঘিরেই জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হতো। পরে আরো ঐশ্বয্যময় হয়েছিল পরিবারের চৌহদ্দির বাইরের থেকে আসা জানা-অজানার এবং অচেনা বহু সম্পদে। আমার জানার পরিধির নাগাল তোমরা পেতে না, তাই আমার মতো করে আমি মাঝে মাঝে তোমাদের কাছ থেকে সুযোগ নিতাম।
নামনি, তোমাদের চোখে বেশ তৃপ্তির রেখা ফুটে উঠেছিল যখন ফ্রাঙ্ক এন্টনির ফাদার আমাকে তাদের স্কুলে ভর্তি করার জন্য তোমাদের হাতে ফর্মটা এগিয়ে দিয়েছিল। বেশ বুঝতে পারতাম আমাকে নিয়ে তোমার স্বপ্নের উড়ান অনেক দূর-র পর্যন্ত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
যে তোমাকে কাঁদাবে সেইই তোমাকে ভোলাবে
যখন আমি থাকবো না তখন তুমি অবশ্যই আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে তোমার ধারণাকে হারাবে আর সেই সঙ্গে যেটাকে হারবে, সেটা হলো মাতৃত্বের গৌরবকে। এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটিকে তুমি কোনদিনই উদ্ধার করতে পারবে না কিন্তু দ্বিতীয়টি পুনরায় ফিরে পেতে পার। আজকের দিনের পরে জগতের রুটিন কাজ গুলি থেমে থাকবে না। প্রতিদিনের মতো সূর্য উঠবে আবার অস্তমিত হবে, প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তন থেমে থাকবে না, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব অনুভূত হবে আর তাকে পাবার জন্য তোমাদের কর্ম করে যেতে হবে আর সেই কর্মের বিনিময়ে পাওয়া অর্থই তোমাদের পার্থিব অভাব অভিযোগ দূর করবে। এই ভাবেই সময়ের হাত ধরে তোমরা প্রাত্যহিক রুটিনে নিজেদের অজান্তে কখন যেন নিজেকেই বেঁধে ফেলবে, অবসর পাবেনা নিজের মনের কোনে উঁকি দেবার। জাগতিক ঘড়ির কাটায় সবকিছুই চলবে। সৃষ্টি যেখানে থাকবে লয় তো সেখানে হবেই, তা না হলে সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে যাবে। সময়ই তোমাকে তার মতো করে চলতে শেখাবে, নিজের অজান্তেই দেখবে বিশ্ব প্রকৃতির ভাঙা গড়ার খেলার তুমি ও তার সাথী হয়ে গেছ।
অহংকার যখন চালক সংসার সেখানে নরক
সংসারের রাজত্বে কুশী লবেরা কেওবা রাজা, কেউবা উজীর , আমরা যাঁরা শিশু তারাই সেই দেশের প্রজা। যেহেতু এই রাজ্যের লিখিত কোন সংবিধান নেই, তাই রাজা বা উজিরের কোন আচরণবিধি নেই , তাই এই দেশে সম্পর্কের জেরে সবাই রাজা, কেওবা সেখানে মূর্ত আবার কেউবা বিমূর্ত।
সেদিন পৃথিবীটা কি সত্যিই ভীষণ ছোট ছিল । আমার পারিবারিক আবর্তের মধ্যে তুমি ছাড়া , বাবা আম্মা, মাম্পি দিদি , পিসিমনি , ছোড়দি আর জেঠু দাদু।
পরিবারের প্রত্যেক সদস্য ছিল আমার এক একটি অঙ্গ স্বরূপ । যখন তোমাদের মধ্যে কোন মতান্তর হতো , আমরা ছোটরা বয়জেষ্ঠদের কেমিস্ট্রিটা যেমন বুঝতাম না,আবার বুঝতাম না এর মাধ্যমে তোমরা সবাই কি প্রমান করতে চাইছো ? সেটা কি শুধুমাত্র নিজেই সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং অতুলনীয় বোদ্ধা কিংবা সম্পর্কের সংস্কারের গরিমা প্রমানের স্বঘোষিত প্রলাপ ? আমি কোন অঙ্গকে প্রাধান্য দেব, সেই হেয়ালিতে হারিয়ে যেতাম, কেননা আমার দৃষ্টিতে সবাই সমান ছিল। যেহেতু বিভাজন বুঝতাম না তাই এক রাশ বেদনা নিভৃতে আমাকে গ্রাস করতো। তবে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম মানুষ ভীষণই আত্মকেন্দ্রিক, সবকিছুর ঊর্ধে উঠে নিজের ভালোলাগাকে ভীষণ প্রাধান্য দেয়, তাকে কোন অবস্থায় বিসর্জন দিতে পারে না। মনে হতো আত্মসম্মান বলে যে প্রচলিত শব্দটি আছে তার সঠিক ব্যাখ্যাটা তোমাদের কাছে ভীষণ অসম্পূর্ন ছিল। সংসারে আত্মবিসৰ্জন শব্দটি ভীষণ বেমানান মনে হয় । আম্মার কাছে মহাভারতের গল্প শুনতাম আর মাঝে মাঝে মিলিয়ে দেখতাম একাধারে পরিবারই বন্ধন আবার পরিবারই সংগ্রামের আদি ক্রীড়া ভূমি বা বিভেদের আঁতুরঘর ।
ক্রমশঃ
ব্লগার - রবীন মজুমদার
মন্তব্যসমূহ