দূরের চিঠি - ১২৬ চতুর্থ সংখ্যা (শেষ সংখ্যা )

 দূরের চিঠি - ১২৬                                 চতুর্থ  সংখ্যা  (শেষ সংখ্যা )



আজ প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত হোক ঘরে ঘরে দানবরূপী  প্রতিক্রিয়া বন্ধ হোক চিরতরে 

নামনি, যদিও 'প্রতিক্রিয়া' শব্দটির ব্যবহার একটু জটিল, আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবী থেকে যা কিছু সংবাদ গ্রহণ করি, সেটা আমাদের চিত্তে গিয়ে পৌঁছায়। চিত্ত সংগঠিত হয় মন, বুদ্ধি এবং অহংকারের সমারোহে।  এক শান্ত শিষ্ট দিঘি বা  যেখানে  ফসল ফলে সেই জমি হিসাবে মনকে কল্পনা করতে পারো আর সেইখানে খেলা করে অহংকার আর বুদ্ধি। যেমন দিঘির জল আন্দোলিত হয় বাইরের থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরের টুকরায়, সেই রকম মনও চঞ্চল হয় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহীত সংবাদে। মায়া  যেখানে অহংকারের জন্ম দেয় এবং বুদ্ধির উপর অহংকার এক দীর্ঘ ছায়া ফেলে। উৎপাদিত হয় ভ্রমের। একমাত্র জ্ঞানই সেই অহংকারের মেঘকে সরিয়ে বুদ্ধিকে জাগ্রত করে। কেননা আকাশ মেঘের থেকে অনেক বড়ো। আবার জ্ঞান জন্ম দেয় চেতনার আর চেতনা হলো সংকৃতির বিকাশের এক অন্যতম উপাদান। প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেই ফসল যা সংস্কৃতির গুণমান থেকে প্রকাশমান সামগ্রী। সেই ফসলের সুরভীতে মাপা  হয় ব্যক্তির উৎকর্ষতাকে। 

পরিবারের সংকৃতির মান উন্নয়নের সাথে সাথে সমাজের উন্নয়ন হবে আর সমাজের উন্নয়নের সাথে জাতির উন্নয়ন  হবে আর জাতির উন্নয়নের সাথে সাথে এই দৃশ্যমান পৃথিবীর উন্নয়ন হবে। পৃথিবীর সংকৃতির প্রাথমিক প্রশিক্ষনের স্থান  সেই পরিবারে আমরা  বাস করি। তাই আমাদের দায়িত্ব অনেক , সেখানে কোন আদর্শ পরিবারের অনুসরণকারী হতে হবে  অথবা নিজেরা এক আদর্শ পরিবারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে । সব কিছুর  মুলে আছে জ্ঞান সঞ্চয়ের প্রচেষ্টা ।  

জীবনকে সবারই  কর্মভূমি বানাতে হবে, পরিবার সেখানে হবে এক জীবনমুখী এক সংগঠন। তোমাদের জগৎ পরিচালিত  হবে নির্দ্দিষ্ট গঠনমূলক লক্ষ্য  পূরণের জন্য।  আর তাকেই সামনে রেখে  যা কিছু বাইরের জগৎ থেকে আসা  সংবাদকে তোমার  মগজের মূল্যবান জায়গায় তখনিই  স্থান দেবে যারা  তোমাদের বুদ্ধিকেও অযথা বিশ্লেষণ করার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলবে না । আজ থেকে হোক আত্ম বিসর্জনের ব্যাখ্যার নবতম সংযোজন, যা কিছু অপ্রিয় প্রতিক্রিয়া দেবার প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। যে প্রতিক্রিয়া অপরের কাছে চাবুকের ব্যাথার সমতুল্য বা তার থেকে আরো বেশী , তাকেই ত্যাগ করতে হবে। শব্দ ভীষন শক্তিমান, একটি শব্দ অপর একটি শব্দের জন্ম দেয় , সুচিন্তিত ব্যবহার না হলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটা ভীষণ গুরুতর। প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাই আমার এই আবেদন সার্বজনীন। প্রশংসা যেমন মানুষকে বাড়তি উৎসাহ সহকারে কাজ করতে সাহায্য করে, নিন্দাও ঠিক তার বিপরীতমুখী হয়ে গঠনমূলক কাজের ইচ্ছাকে দমন করে রাখে।  

বেদনার উৎসের সন্ধানে 

আমি বেশ কিছুদিন ধরে মনোনিবেশ  করার চেষ্টা করছিলাম যাতে করে বাইরের কোলাহল আমার কর্ণকুহর দিয়ে প্রবেশ করে আমার অন্তরের একনিষ্ঠ সাধনাকে  ভঙ্গ করতে না পারে। আজ আমি আমার মধ্যে নিজেকেই  খুঁজতেই ব্যস্ত থাকতে চাইছিলাম । 

নামনি, আজ যখন আমি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন আমার জীবনের অভিজ্ঞতার বৃদ্ধত্ব এসে গেছে। সেই জায়গা থেকে তোমাদের বলি একের প্রতি ভালোবাসা তোমাদের  জীবনে অনেক গ্লানি দেবে, সেটা অনেক ক্লান্তিকর, সেখানে পদে পদে অপূর্ণতা আর  বেদনায় ভরা। আমরা এই জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে অবিছিন্ন  এবং সেই অর্থে যা কিছু সৃষ্টি চারপাশে ছাড়িয়ে আছে সবাই আমাদের আত্মার আত্মীয়, তাই তোমাদের ভালোবাসা যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে  থাকে তাহলে সেই সার্বজনীন ভালোবাসার মধ্যে ক্ষুদ্র ভালোবাসার না পাবার  ব্যাথ্যায় তোমাদের কাতর করতে পারবেনা। 


বন্ধু হে আমার রয়েছে দঁড়িয়ে 

নামণি , মনে আছে , ১৯৯০ সালের জুন মাসের ২৭ তারিখের ঘটনাটা, ঠিক তার কদিন আগে হাসপাতাল ছাড়া পেয়ে আমি ঘরে এসেছিলাম। সেইদিন আমি তখন বেলেঘাটার বাড়িতে,গগনে গগনে বিদ্যুতের  বিরামহীন  আসা-যাওয়া , আর তাদের মৃদঙ্গ ধ্বনি বাজছিল, যেন তাদের উৎসবের আনন্দে বার বার পৃথিবীটা নেচে উঠছিল । এই গানের অর্থ কেউ বা বোঝে আর কেউবা বোঝেনা। এই সুর কারোর কাছে আগমনী গান আবার কারোর কাছে অশুভ মুহূর্তের প্রারম্ভিক সূচনা। তুমি তার দ্বিতীয়টাকে বেঁচে নিয়ে ছিলে। সেই তিমিরে লুকিয়ে থাকা ভয় তোমাকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধে  ফেলেছিল, তার উপর ভর করে তুমি আমাকে কোলে নিয়ে তোমার দুই হাত দিয়ে  জড়িয়ে ছিলে  , আর আমার ছোট্ট শরীরটা যদিও যেন সেই আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছিল কিন্তু আমি ভিতরে স্থির ছিলাম কোন এক বিশেষ সংবাদের অপেক্ষায়। আমার কাছে সেটা ছিল আমার এক ব্যতিক্রমী অতিথির আগমনের পদধ্বনি।  মনে আছে, হঠৎই আমি নিদ্রার মধ্যে আগুন আগুন বলে তোমার কোল থেকে উঠে পড়লাম। জানতো, সেদিনের স্বপ্নটা ছিল, কারা যেন একটা পাটাতনের উপর শুইয়ে দিয়ে এক আগুনের ফার্নেসের দিকে আমাকে  ঠেলে দিচ্ছিল। ঘটনার গভীরতার অনুমান করে তোমাকে আমি তাই কিছু বলিনি। 

কারা যেন বাইরের থেকে এসে আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্য যে হৃদযন্ত্রটিকে যেই পেশিগুলি আঁকড়ে ধরে থাকতো তাদেরকে সেই দুষ্টরা বার বার অনুৎসাহিত করছিলো হৃদযন্ত্রটিকে ধরে রাখতে। তাদের অসহযোগিতায় আমি আমার অন্য বন্ধুদের তুলনায় খেলাধুলা করতে গিয়ে হাপিয়ে পড়তাম, সেটা অবশ্য মাত্র আজ থেকে কিছুদিন আগের ঘটনা।

যাকগে, আমার আর  তোমার গৃহে বাস করার মেয়াদ উত্তীর্ন হয়ে গেছে , এই পৃথিবীর অতিথির আহবান এসে গেছে  স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করার। হোকনা সেই প্রত্যাবর্তনটা   মাত্র পাঁচ বছর মেয়াদের , কিন্তু নামনি, ফিরে তো সবাইকে যেতেই হবে, এটাই বাস্তব , আমরা তো সবাই ক্ষনিকেরই অতিথি। 

বেজে উঠে দশমীর সুর 

সময়টা সম্ভবত ভোর পাঁচটার আশেপাশে হবে। আমাকে নিয়ে ফ্লোরে নার্সদের একরকম চঞ্চলতা লক্ষ্য করছিলাম। আমার অবস্থা দেখে তুমিও  কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। নীচে নার্সিংহোমের বেঞ্চে আমার বাবা প্রত্যেক দিনের মতো সেদিন ও শুয়ে ছিল, যদি আমার জন্য অসময়ে বিশেষ কোন প্রয়োজনে আসতে পারে। সেই দিনটাই ছিল উপর থেকে বাবাকে ডাকবার অন্তিম দিন।  

নামনি,আর হয়ত কিছুক্ষনের মধ্যে আমি আমার স্বস্থানে ফিরে যাব,আমাকে সেখানে বরণ করার জন্য শঙ্খধ্বনির নিনাদ আমার অন্তরে অনুরণিত হচ্ছে ,আমি কান পেতে সেই শব্দ আমার হৃদয়ের গভীরে শুনতে পাচ্ছি। 

আলো আর বাতাস তারা কোন এক অমোঘ নির্দ্দেশে আমাকে দেওয়া তাদের দানসামগ্রী ফেরত নিয়ে গেল। তখন শেষবারের মতো তোমাকে মা মা বলে  বার বার ডাকছিলাম, তুমি তখন আর আমার পাশে থাকতে পারছিলেনা, তাই বাবা আমার সামনের টুলে নিশ্চল ভাবে বসে ছিল। বাবা তখন আমার মুখ দিয়ে 'বাবা' এই  সম্বোধনটা একবার শুনতে চাইছিল, আমি সেটা পূরণ করেছিলাম। হঠাৎ-ই  বাইরের সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু মনে হল আমার অন্তর থেকে  একটা সুক্ষ আলোকবর্তিকা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে  তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে , তার পর আর কিছু আমার মনে নেই। 

নামনি বিদায়। 

তোমার বাবাই (রনিত মজুমদার )

*************************** সমাপ্ত  *************************

ব্লগার -রবীন  মজুমদার 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২১০ ) ঝড়-বৃষ্টির একাল সেকাল