হালচাল (১৩১)



 হালচাল 
(১৩১)

 


মানুষের ক্ষুধার  উদ্বেগ হলেই খাদ্য গ্রহণ করে। আর সত্যিই যদি ক্ষুধার উদ্বেগ না হয়, তাহলে তাকে কি ক্ষুধাবর্ধক ঔষধ খাওয়াতে হবে ? অর্থাৎ এমন একটা পরিবেশ গড়ে তোলা যাতে সে জীবনের সব অভাব অভিযোগকে ভুলে, আকৃষ্ট হয় ধর্ম কি তা জানতে। আসল ধর্মকে গোপন রেখে নকল ধর্মের বেচাকেনার মাধ্যমে আধুনিক সমাজে এক নৈরাজ্যের  পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে । এটি একদল ক্ষমতাসীন মানুষ এবং একচেটিয়া পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা এক অদ্ভুত  অপসংস্কৃতি। 


ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতিই এই অপসংস্কৃতির মোকাবিলা করতে পারে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, এই ভারতভূমি এমন এক সংস্কৃতির পীঠস্থান, সেখানে দাঁড়িয়ে  স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সারা বিশ্বের মানবজাতির উন্নয়নের মন্ত্র একমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যেই আছে আর তার জন্য ভারতবর্ষকে বাঁচাতে হবে। 

প্রাচীন সংস্কৃতি ইতিহাস নির্ভর আর তাকে সন্নিবেশ,পরিবর্তন এবং মুছে দেবার প্রচেষ্টা যুগে যুগে একদল ক্ষমতাসীন মানুষ নিজ স্বার্থের জন্য এই পুরোনো খেলায় মত্ত থাকে। আজকে বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে হাজার হাজার বছরের সভ্যতাকে চুল চেরা ৰিশ্লেষণ করে তার ব্যাখ্যা দিয়ে দিচ্ছে। আসলে তারা ভুলে যায় সত্যকে সাময়িকভাবে গোপন রাখা যায় কিন্তু চিরকাল নয়। 

বর্তমানে পুঁজি নির্ভর অর্থনীতির নাগপাশে সহস্ত্র প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠে গেছে। যারা আজ সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারতো, তারা আজ ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করার জন্য  জাতির বৃহত্তর সম্মানকে ধুলায় লুন্ঠিত করছেন। সংস্কৃতির উত্থান এবং পতনের পিছনে অর্থনীতির অবদান আছে এবং তা অন্তর সম্পর্কযুক্ত। 


তাহলে, এটাই ধরে নেওয়া সঠিক হবে যে , গনমুখী অর্থনীতিই একমাত্র পারে সুষ্ঠ সংস্কৃতির জন্ম দিতে। যতদিন সংসারী মানুষ সকাল থেকে রাত্রি পর্য্যন্ত শুধু মাত্র পরিজনদের আহার ও বাসস্থানকে ঘিরে তার মনোজগৎ ব্যাস্ত থাকবে, ততদিন তার সমস্ত ভাবনা কেন্দ্রীভূত থাকবে অর্থ উপাৰ্জনকে ঘিরে অর্থাৎ বাহ্য প্রকৃতিতে আর ঠিক সেই কারনে সে কখনই সময় পাবে না নিজের অবস্থানটি সম্পর্কে  চিন্তা করতে অর্থাৎ অন্ত প্রকৃতিতে প্রবেশ করে সত্য অনুসন্ধানে ব্রতী হতে ।  মানুষ যাতে নিজেকে কোন অবস্থায় উপলদ্ধি না করতে পারে তার জন্য তাকে বহির্মুখী করাটা এক নিপুন কৌশল এবং এই কৌশলটি উৎপাদিত হয় পুঁজিনির্ভর সমাজব্যবস্থায়  আর তার সহযোগী শাসকের রসায়নাগারে। যে কোন কৌশল তখনিই ফলপ্রসূ হয় যখন প্রতিপক্ষের মধ্যে কৌশল সম্পর্কিত রহস্যটির কারন না জানার সুবাদে অর্থাৎ অজ্ঞানতার কারণে। জানা এবং অজানার মধ্যবর্তী শূন্যতাকে ভরিয়ে দিচ্ছে মিথ্যাচার আর সেই মিথ্যাকে সত্য হিসাবে উপস্থাপনের কৌশল।  সুতরাং , সাধারণ মানুষের এক মাত্র উত্তরণের রাস্তা জ্ঞান অর্জন। 

আকর্ষণীয়তা  কি সাহিত্যের গুণ -

লক্ষ্য একটাই কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ ও মত অনেক।  আমরা সারা জীবন যা পড়ে থাকি কিংবা শুনে থাকি তা অধিকাংশই অন্যজনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত বর্ণনা। 

বাস্তব জীবনে সেই বিষয়বস্তুর  গ্রহনযোগ্যতা তখনিই বেশি হয়, যখন  সহজেই মানুষ আত্মস্থ করতে পারে এবং তাকে নিজেদের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে পারে। তাছাড়া, বিষয়বস্তুর দোরগড়ায় পৌঁছানোর জন্য পাঠকের গ্রহনযোগ্যতার ক্ষেত্রে পাঠ্য বিষয়ের আকর্ষণীয় উপস্থাপনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।  

কর্মময় বা ব্যবহারিক জীবনে বেদ-বেদান্তের রচনাকে সামনে রেখে চললে মানুষ তার উপযোগিতা হয়ত বুঝতে পারবেন কিন্তু বাস্তবে তার প্রতি আগ্রহ সেভাবে অনুভূত হবেনা। কেননা, কোন বিষয়কে আয়ত্ত্ব করতে গেলে যে সাধনা বা  মনোনিবেশের প্রয়োজন, তা যদি না হয় তাহলে বিষয়বস্তু অধরা থেকে যাবে। 

গীতাকেও হয়তো অপেক্ষা করতে হয়েছিল সেই চরম মুহূর্তের জন্য, যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ন পরিবেশের প্রাক মুহূর্তে সর্বজনগ্রাহ্য সুবক্তা শ্রীকৃষ্ণের উপর। আর সেই সময় পাঠকেরও উপায় ছিলনা দর্শকের আসন ছেড়ে উঠে যাবার। তাই মনে হয় একপ্রকার বাধ্য হয়ে শুনতে হয়েছিল সেই মূল্যবান উপদেশ গুলিকে। আর সেই উপদেশগুলি ছিল বাস্তব পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত মানব জীবনের সমস্যার সমাধানের মন্ত্র। তাই সে আজও সীমিত পরিসরে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। সীমিত এই কারনে, কেননা বেশিরভাগ মানুষ তার গভীরে গিয়ে অনুশীলন করেন না  বা করার সময় পান না বলে। তার কারন উপরে ব্যাখ্যা করা আছে।  

পূর্বেকার মুনিঋষিরা অতিরঞ্জিত পৌরাণিক কাহিনীর মোড়কে বেশ যত্ন করে ধৰ্ম অধর্মের ফল ও কুফলকে সাধারনের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে ছিলেন। এই শিক্ষাটি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য যে, স্থান, কাল ও পাত্র নির্ধারণের উপর সাহিত্যের ব্যাপ্তি নির্ভর করে বা তাকে আকর্ষণীয় করতে হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যের জন্য।তাই মহাভারতে দেখা যায় যে  ধর্ম,অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারটি বেদের মূল মন্ত্রের অসাধারন আলঙ্কারিক প্রয়োগ।  


একদিন যে একদল মনীষী মানব ধর্ম প্রচারের ব্রতী হয়েছিল,তাঁরা  জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিল সাধারণ মানুষের ধর্মবোধকে, নীতিবোধকে, আজ আবার সেই ধর্মকে বিকৃত রূপ দিয়ে তাকেই আবার ধারালো অস্ত্রের ন্যায় ব্যবহার করে একদল নীতিহীনমানুষ তাদের বাগ্মিতায় আর প্রচার যন্ত্রের সহায়তায় সাধারণ মানুষকে নেশার মোড়কে পরিবেশন করে সমাজের মধ্যে বিভাজন কায়েম করছেন। তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবনের মূল সমস্যাগুলি ও তার প্রতিকারের উপায় থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেবার এক ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলছে। 

জীবন বা বেঁচে থাকা যদি একটা সংগ্রাম হয় তাহলে সেই সংগ্রামের মূল প্রতিবন্ধকতা ও তার প্রকৃত কারণকে চিহ্নিত করাটাই প্রাথমিক কর্তব্য। সেটা যদি সঠিক না হয় তাহলে গোলকধাঁধায় সারা জীবন মানুষকে ঘুরে বেড়াতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন আলোর আর সেই আলোর উৎপত্তি হয় জ্ঞানের বিকাশে।  

লক্ষ্য যেখানে মানুষের মুক্তির উপায়ের অন্বেষণ, তাহলে অবশ্যিই সেখানে প্রারম্ভিক বাধাও যেমন থাকবে আর ঠিক তার পাশাপাশি তাকে অতিক্রম করার পদ্ধতিও থাকবে। কেননা সমস্যা আর সমাধান এই দুটি শব্দ বিপরীতমুখী হলেও তার সহবস্থানকে এই বিশ্ব প্রকৃতি মান্যতা দিয়ে আসছেন। 


 

ক্ৰমশঃ   

ব্লগার -রবীন মজুমদার

মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৫৯ তম  অধ্যায় (১২৫)

Searching for hidden Truth (28) 

মন্তব্যসমূহ

My new blog বলেছেন…
ভালো লাগলো।
My new blog বলেছেন…
ভালো লাগলো।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল