ওপারের সংগীত 134
ওপারের সংগীত 134
জন্ম ১৯শে জুলাই, ১৯৮৫। তিরোধান ৩০শে জুলাই, ১৯৯০
নামনি
প্রিয় নামনি ,
আসে কোন তরুণ অশান্ত
আজ সকাল থেকে আকাশটা যেন পণ করেছে কিছুতেই মেঘকে ছুটি দেবেনা। পার্ক নার্সিং হোমের পাশে এ জে সি বসু রোডে প্রায় এক হাটু সমান জল জমে গেছে। বাইরে বিরামহীন বর্ষনের সুরটা আমার কাছে আজ সার্বজনীন বেদনার অনুভূতিকে বহন করে আনছে। এ যেন প্রিয়জনের বিদায়ের একটানা সানাইয়ের বিষাদের সুর বেজে যাচ্ছে।
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা
৩০শে জুলাই, ১৯৯০, আজকের থেকে ঠিক পাঁচ বছর ১১ দিন আগে বহু প্রলোভন দেখিয়ে এই বিশ্ব প্রকৃতি আমাকে এই পৃথিবীতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলে। আজ আমি পার্ক নার্সিং হোমের ৯ নং বেডে তোমার কাছে শুয়ে আছি। মনে আছে , আমি হঠাৎ করে তোমাকে বলে উঠলাম আমার বালিশটা একটু উঁচু করে দাও আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি চঞ্চল হয়ে উঠলে , ভাবলে অক্সিজেনের নলটা হয়ত ঠিক নেই, সেটা জানতে সাহায্য চাইলে নার্স আন্টিদের কাছে।
আজ কিন্তু এসবের কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই, সেটা আমি উপলদ্ধি করতে পারছি। যেখানে জীবনের প্রবাহ প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁধা সেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান তো অসহায়। জীবন মৃত্যুর খেলার যেখানে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মৃত্যু সেখানে দুন্দুভি বাজিয়ে তার বিজয়বার্তা ঘোষণা করাটা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তাই জীবনের সব দন্দ্বের প্ৰয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে , আছে শুধু প্রতীক্ষা আর এই মাঝখানের সময়টা হচ্ছে আমার একান্তই অবসর।
আমার বন্ধ ঘরে স্মৃতির ঝাকুনি
জীবনের লক্ষ্য যখন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়, সব কোলাহল সেখানে বিদায় নেয়। চঞ্চলতা যেখানে অনুপস্থিত মন তখন এক শান্ত দীঘি। তখনিই বোধহয় স্মৃতিকে স্মরণ করা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।আমার অবস্থা ও আজ ঠিক একই সুরে বাঁধা । আজকে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার স্মৃতির পাতা গুলিকে এক এক করে পড়তে আর বলতে ইচ্ছা করছে। বিগত দেড় মাস যাবৎ আমি চলাচলের দোলায় আছি। ডাক্তার বাবুরা তার কারন হিসাবে তাদের পরিভাষায় ব্যক্ত করেছন, বলেছেন, ওটাকে বলে Viral Myocarditis , আমার অবশ্য তাতে কোন মাথা ব্যথা নেই, কেননা, আমি ওটা বুঝিনা।
জীবনমরনের সীমানা ছাড়ায়ে
নামনি, জীবনে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘটনাগুলিকে সাজাতে পারবনা কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবে বলতে পারবো। সেই আমার সকাল বেলা কে বি ব্লকের ফ্ল্যাটের ঝুল বারান্দায় শিকের মধ্যে পা গলিয়ে, গলা ছেড়ে গান করাটা আর বুঝি হয়ে উঠবেনা। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম এই বিশ্বপ্রকৃতি আমার অস্ত্বিত্বকে অস্বীকার করার জন্য ভীষণ উৎসাহিত হয়ে পড়েছে। অথচ জানতো , তারাই এতদিন আমার প্রতি তাদের দয়া মায়া দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল , আমার জীবনে দিয়েছিল অনেক আলো, জল, অফুরন্ত বাতাস , কত না খাবার দিয়েছিল আর আমাকে আরো কত প্রলোভন দিয়ে বেঁধে রেখেছিল এই বিশ্ব সংসারে সম্পর্কের জটিল বাঁধন দিয়ে। জানিনা, কি এক অজানা কারনে আজ হয়তো তাঁদের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তাই তারা আমাকে আর এই সংসার থেকে আমার স্থায়ী ঠিকানায় স্থানান্তরিত করবে বলে মন স্থির করে ফেলেছে। তাঁরা দাঁড়ি টানবে আমার উদ্বাস্তু জীবনের। আজ কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাকে সেই পরমপিতার সাথে মিলিত হতে হবে।
কি গান বাজে আজি আমারি অন্তরে
নামনি, একটু ভেবেই দেখই না, এইতো পাঁচবছর আগে আমি এই বিশ্ব সংসারে এলাম, সেদিন আমার নিজের কিচ্ছু করার ক্ষমতা ছিল না, আজ দেখ, আমি হাটতে শিখেছি, বলতে শিখছি, ভাবতে শিখছি। আজ থেকে তোমরা আর আমার এই রক্ত মাংসের শরীরটাকে আর দেখতে পারবে না, শুধু আমার অস্তিত্বের উপস্থিতিটা তোমার অন্তরে অনুভূত হবে। এই পর পর ঘটে যাওয়া সংক্ষিপ্ত জীবনের ঘটনা গুলি শুধু স্মৃতির পটে থাকবে। আগামী দিনে তোমাদের ব্যস্ত জীবনের অবসরে স্মৃতির পাতাটা উল্টে পাল্টে আমাকে খুঁজবে।
যার কোন স্থায়িত্ব নেই, যে ঘন ঘন পরিবর্তনশীল তাকে কি করে সত্য বস্তু বলবে। আমি যদি চিরন্তন না হই তাহলে আমি তো ক্ষনিকের। যে বস্তু ক্ষনিকের সে কখন সত্য়বস্তু বা চিরস্থায়ী হতে পারেনা, তাই আমি মিথ্যাবস্তু ; শুধু শুধু সেই বস্তুকে অহংকারের বশবর্তী হয়ে কেনই বা নিজের বলে ভাববে ? যে মিথ্যা সে তো অচিরেই তার রূপের পরিবর্তন ঘটাবে , আর তখন তার পূর্বের রূপকে দেখতে না পারার বিরহে যে কাতর হয়ে পড়বে, সেটাই তো মায়া। যেই যুক্তিতে আমি এই বিশ্ব প্রকৃতির একজন প্রতিনিধি যখন মিথ্যাতে পর্যবসিত হতে পারে ; তখন ঠিক একই যুক্তিতে এই পরিবর্তনশীল জগৎ সংসারও মিথ্যা।
ফিরে দেখা কটা দিন
সম্ভবতঃ সময়টা ছিল জুন ১৯৯০ 'র তৃতীয় সপ্তাহ, তোমরা আমাকে ডাক্তার তালুকদারের কাছে খুব সকালবেলা নিয়ে গিয়েছিলে , তিনি আমাকে দেখেই তোমাকে বলল পার্ক নার্সিং হোমে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে দিতে। তারপর ডাক্তাররা কি কি করেছিল আমি সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছিনা। নার্সিং হোমের ৫ নং বেডটি সেদিন নির্ধারিত হয়েছিল আমার থাকার জন্য। বেডটা একদম জানালার ধারে ছিল, সাময়িক সুস্থ হবার পর, আমি বেডের উপর বসে বড় রাস্তাটা দেখতে পারতাম। জানো নামনি , আমি লক্ষ্য করতাম আমারিই মতো বা একটু বড় ছাত্ররা কি আনন্দের সাথে মজা করতে করতে তারা কখন মা'র বা বাবার হাত ধরে স্কুলের ড্রেস পরে যাচ্ছে। আমি সেদিন ভাবতাম, আমি কি আবার পূর্বের মতো স্কুলে যেতে পারবো ? বোধ হয় আর হয়ে উঠবেনা। সময়ের বিরামহীন অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে ক্যালেন্ডারের তারিখগুলির যোগ্য সংগত ,আমাকে আমার অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করছিল। হয়ত প্রত্যেক মানুষই অসহায় ভাবে বিশ্ব প্রকৃতির অসহযোগিতাকে সময়ের অমোঘ নিয়ম মনে করে নিজের সাথে মানিয়ে নেয়, কাল এইভাবেই এগিয়ে চলে।
ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে
নামনি, আজকে যখন ওপারের শঙ্খধ্বনির শব্দটা ক্রমেই কাছে , আরো কাছে এসে আমার হৃদয়ে অনুরণিত হচ্ছে , আমি সেই শঙ্খনাদের অর্থ জানি, এটা তাদের আমাকে বরণ করার আনন্দধ্বনি। এই সুরের রণনে একে একে খসে যেতে লাগলো কৃত্রিমতার মুখোশগুলি আর সেখান থেকে উন্মোচিত হল চেতনার , যিনি জগৎ সংসারে আত্মা বলে পরিচিত। এই আত্মার স্বভাব হচ্ছে অপরিবর্তনীয় । সেখানে তাই হারিয়ে যাবার কোন বেদনাও নেই। শুধুই আনন্দই সেখানে বিরাজমান । সেটাই আমার গন্তব্যস্থল। আর আজ যেখানে আছি সেটাতো নকল বুদির গড় , তাইতো মুখোশ পড়া সম্পর্কগুলি একটা সময় পর্যন্ত আসল বলে মনে হয়, কিন্তু সেটা সাময়িক। যাঁর কোন স্থায়িত্ব নেই তাই সে নকল। সে যখন সেই মুখোশ খুলে মঞ্চ থেকে বিদায় নেয়, তখন সবাই সেই মুখোশকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। আমিও তোমাদের কাছে সেই মুখোশ পরা 'বাবাই' যে এই মঞ্চে ৫ বছর ১১দিন ধরে তোমার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে গেলাম।
এইতো, সেদিনও নার্সিং হোমে প্রতিদিনের মতো বাবা আর গৌতম মামা নিচের বেঞ্চিতে সারা রাত থাকতো আর বাবা সকালে এসে আমার পাশের টুলটায় বসতো, যখন তুমি ওয়াশ রুমে যেতে, ঠিক সেই সময়টায় আমাকে পাহারা দেবার জন্য । এমন একদিন, আমি বাবাকে বললাম আমাকে "দিনের শেষে ঘুমের দেশে " এই গানটা শোনাবার জন্য। হয়ত, তুমি এই গানটা অনেক ভালো গাইতে পারতে, আমি তোমাকে তাই অনুরোধ করিনি, পাছে তুমি গানটার মানে খুঁজে বের করে আশাহত হয়ে পর। আর আমি জানতাম আমার এই গানটির জন্য বাবাকে যে অনুরোধ করেছিলাম, সেটা বাবা তোমায় কখনই জানাবে না। বাবা আমার অনুরোধে তার সাধ্যমতো গানটা খুব নিচু লয়ে গাইলো, আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বাবার চোখের কোনটা চিক চিক করছে। সেই পারস্পরিক নীরব চাহনি বুঝিয়ে দিল আগামী দিনের সম্ভাব্য পরিণতির ভাষাকে, বাবা সেটাকে পড়তে পেরেছে ।
সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা
নামনি, তোমার মনে আছে আমরা দুজনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতাম ; "ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল স্থলে জলে বনতলে" বা কখন " মোর বীনা উঠে কোন সুরে বাজি, কোন নব চঞ্চল ছন্দে" । আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের মনাদিদি, জেঠিমা, সামনের বাড়ীর দ্বিপেন দাদু আরও অনেকেই আগ্রহভরে শুনতো। মনে হতো তারা যেন বাহবা দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করছে । আমার গান করার ইচ্ছাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিত। সেই ছন্দটা বোধহয় হারিয়ে ফেললাম ।
জানো নামনি , আমার কেমন যেন মায়া পরে গিয়েছিল এই পৃথিবীর প্রতি। এই পৃথিবীর আকাশ বাতাস থেকে প্রানভরে অনেক অনেক নিশ্বাস নেবার ইচ্ছা ছিল। প্রজাপতিদের সাথে লুকোচুরি খেলা , আবার সেই দিনগুলি, যখন তোমারা যখন অফিস চলে যেতে আমি স্কুল থেকে ফিরে যখন বেলেঘাটার বাড়িতে আম্মার কাছে দুপুর বেলাটা আমি আর আমার মাম্পি দিদি থাকতাম, তখন কি না মজা হতো। দুপুর বেলা আম্মা একটু ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের দুস্টমি শুরু হতো। মাঝে মাঝে নিচের বস্তির সমবয়সীদের সাথে দোতালার উপর থেকে খেলা করতাম। কখন কখন ফ্রীজ থেকে ডিম বের করে তাদের দিকে ইট ছোড়ার মতো ডিম ছুড়তাম। পরে অবশ্য তার জন্য মাম্পি দিদিই আম্মার কাছ থেকে বকা খেত।
আরো অনেক দিন তোমাদের সাথে থাকার ভীষণ ইচ্ছা ছিল। জানতো, নামনি আমরা ভীষণ অসহায়। প্রাণ ভরে এই প্রকৃতির কাছ থেকে নিশ্বাস নিতে চাই, যেমনটি আগে নিতাম, আজ কারা যেন সেই বায়ু প্রবাহের গতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছে , আমার কাছে তাকে আর ঘেঁষতে দেয় না। যেটা আমার চলে যাবার অন্তিম লগ্নে বুঝতে পারছি, সেটা এতদিন কাউকে বোঝতে পারিনি। এতো বিশ্ব প্রকৃতির এক ধরনের স্বৈরিতা, সবাইকে দিচ্ছেন কিন্তু আমার প্রতি কেন তার এতই কৃপণতা। কিছু প্রশ্ন আজ করতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা ! এই পৃথিবী কি পারতোনা আরো কিছুদিন একটু আলো, বাতাস দিয়ে আমাকে তোমাদের সঙ্গী করে রাখতে ? আজকের এই ক্ষণিকের অতিথি হয়তো বা তোমারই সৃষ্ট জগতে তার নিজের কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে এই বিশ্ব সমাজকে তার অবদানের মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারতো, তাতে হয়ত আমার প্রতি প্রকৃতির দানের ঋণটা শোধের সুযোগ পেতাম । যেখানে আমার বিদায়ের ভারটা এই বিশ্বের কাছে একটা পাহাড়ের মতো হতে পারতো, সেখানে আমার বিদায়টা একটা পাখির পালকের থেকেও হালকা হয়ে যাবে আগামী দিনে ।
আমি যখন প্রথম উদ্বাস্তু হলাম
এইতো সেদিন, যেদিন লেডি ডাফরিন হসপিটালে আমার পার্থিব রূপটা তোমার নাড়ির সাথে আমার নাড়ির সম্পর্কের ইতি টেনে এই বিশ্ব চরাচরে আমার অস্তিত্বটা প্রকাশিত হলো। সেই আমার জীবনে উদ্বাস্তু হওয়া। সেদিন অনুভব করছিলাম আমার অস্তিত্বের প্রমানের প্রাথমিক পরিভাষা ছিল আমার কান্না। সেই কান্নার সুরটার অর্থ হল আমার জীবনে প্রথম পরাধীনতার মালাটা পরিয়ে দেবার প্রতিবাদ। এই পৃথিবী আমার পায়ে ঠিক সেদিন থেকে বন্ধনের শিকলটা পরিয়ে দিল, আমার কান্না সেই শৃঙ্খলিত মানুষের প্রথম আর্তনাদ।
শুরু হল মায়ার খেলা
নামনি, আমিও তোমাদের মতো অচিরেই সেই মায়াবী প্রকৃতির দাসত্ব করতে শুরু করলাম। আমাকে ঘিরে পরিবার পরিজনদের যে আবর্ত রচনা হলো, আমার মনে হল আমি এক সূর্য, যে শুধুই আনন্দের বারি বর্ষণ করে আর তোমরা সেই পৃথিবী যারা আমাকে পরিক্রমা করে সেই আনন্দের অংশীদার হও। যখন আমি অকারনে হেসে উঠতাম তখন তোমাদের চাহনিতে একটা পরিতৃপ্তির ছবি যেমন ভেসে উঠতো আবার যখন কেঁদে উঠতাম তখন তোমাদের চোখে মুখে ফুটে উঠতো নীরব এক উৎকন্ঠার চাহনি। সেই দেখে আমার মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার হতো, সেটা তোমরা বুঝতে পারতে কিনা জানিনা। আমার জানার প্রাথমিক পাঠটা পরিবারের আচার আচরণকে ঘিরেই জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হতো। পরে আরো সমৃদ্ধ হয়েছিল পরিবারের চৌহদ্দির বাইরের থেকে আসা জানা-অজানার এবং অচেনা বহু সম্পদে। আমার জানার পরিধির নাগাল তোমরা পেতে না, তাই আমার মতো করে আমি মাঝে মাঝে তোমাদের কাছ থেকে সুযোগ নিতাম।
নামনি, তোমাদের চোখে বেশ তৃপ্তির রেখা ফুটে উঠেছিল যখন ফ্রাঙ্ক এন্টনির ফাদার আমাকে তাদের স্কুলে ভর্তি করার জন্য তোমাদের হাতে ফর্মটা এগিয়ে দিয়েছিল।বেশ বুঝতে পারতাম আমাকে নিয়ে তোমার স্বপ্নের উড়ান অনেক দূর-র পর্যন্ত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
যে তোমাকে কাঁদাবে সেইই তোমাকে ভোলাবে
যখন আমি থাকবো না তখন তুমি অবশ্যই আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে তোমার ধারণাকে হারাবে আর সেই সঙ্গে যেটাকে হারবে, সেটা হলো মাতৃত্বের গৌরবকে। এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটিকে তুমি কোনদিনই উদ্ধার করতে পারবে না কিন্তু দ্বিতীয়টি পুনরায় ফিরে পেতে পার। আজকের দিনের পরে জগতের রুটিন কাজ গুলি থেমে থাকবে না। প্রতিদিনের মতো সূর্য উঠবে আবার অস্তমিত হবে, প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তন থেমে থাকবে না, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব অনুভূত হবে আর তাকে পাবার জন্য তোমাদের কর্ম করে যেতে হবে আর সেই কর্মের বিনিময়ে পাওয়া অর্থই তোমাদের পার্থিব অভাব অভিযোগ দূর করবে। এই ভাবেই সময়ের হাত ধরে তোমরা প্রাত্যহিক রুটিনে নিজেদের অজান্তে কখন যেন নিজেকেই বেঁধে ফেলবে, অবসর পাবেনা নিজের মনের কোনে উঁকি দেবার। জাগতিক ঘড়ির কাটায় সবকিছুই চলবে। সৃষ্টি যেখানে থাকবে লয় তো সেখানে হবেই, তা না হলে সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে যাবে। সময়ই তোমাকে তার মতো করে চলতে শেখাবে, নিজের অজান্তেই দেখবে বিশ্ব প্রকৃতির ভাঙা গড়ার খেলার তুমি ও তার সাথী হয়ে গেছ।
অহংকার যখন চালক সংসার সেখানে নরক
সংসারের রাজত্বে কুশী লবেরা কেওবা রাজা, কেউবা উজীর , আমরা যাঁরা শিশু তারাই এই দেশের প্রজা। যেহেতু এই রাজ্যের লিখিত কোন সংবিধান নেই, তাই রাজা বা উজিরের কোন আচরণবিধি নেই , তাই এই দেশে সম্পর্কের জেরে সবাই রাজা, কেওবা সেখানে মূর্ত আবার কেউবা বিমূর্ত।
পৃথিবীটা কি সত্যিই ভীষণ ছোট। আমার পারিবারিক আবর্তের মধ্যে তুমি ছাড়া , বাবা আম্মা, মাম্পি দিদি , পিসিমনি , ছোড়দি আর জেঠু দাদু।
পরিবারের প্রত্যেক সদস্য ছিল আমার এক একটি অঙ্গ স্বরূপ । যখন তোমাদের মধ্যে কোন মতান্তর হতো , আমরা ছোটরা বয়জেষ্ঠদের কেমিস্ট্রিটা যেমন বুঝতাম না আবার বুঝতাম না এর মাধ্যমে তোমরা সবাই কি প্রমান করতে চাইছো ? সেটা কি শুধুমাত্র নিজেই সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং অতুলনীয় বোদ্ধা কিংবা সম্পর্কের সংস্কারের গরিমা প্রমানের স্বঘোষিত প্রলাপ ? আমি কোন অঙ্গকে প্রাধান্য দেব, সেই হেয়ালিতে হারিয়ে যেতাম, কেননা আমার দৃষ্টিতে সবাই সমান ছিল। যেহেতু বিভাজন বুঝতাম না তাই এক রাশ বেদনা নিভৃতে আমাকে গ্রাস করতো। তবে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম মানুষ ভীষণই আত্মকেন্দ্রিক, সবকিছুর ঊর্ধে উঠে নিজের ভালোলাগাকে ভীষণ প্রাধান্য দেয়, তাকে কোন অবস্থায় বিসর্জন দিতে পারে না। মনে হতো আত্মসম্মান বলে যে প্রচলিত শব্দটি আছে তার সঠিক ব্যাখ্যাটা তোমাদের কাছে ভীষণ অসম্পূর্ন ছিল। সংসারে আত্মবিসৰ্জন শব্দটি ভীষণ বেমানান মনে হয় । আম্মার কাছে মহাভারতের গল্প শুনতাম আর মাঝে মাঝে মিলিয়ে দেখতাম একাধারে পরিবারই বন্ধন আবার পরিবারই সংগ্রামের আদি ক্রীড়া ভূমি বা বিভেদের আঁতুরঘর ।
আজ প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত হোক ঘরে ঘরে দানবরূপী প্রতিক্রিয়া বন্ধ হোক চিরতরে
নামনি, যদিও প্রতিক্রিয়া শব্দটির ব্যবহার একটু জটিল, আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবী থেকে যা কিছু সংবাদ গ্রহণ করি, সেটা আমাদের চিত্তে গিয়ে পৌঁছায়। চিত্ত সংগঠিত হয় মন, বুদ্ধি এবং অহংকারের সমারোহে। মনকে এক শান্ত শিষ্ট দীঘি বা ফসল যেখানে ফলে সেই জমি হিসাবে কল্পনা করতে পারো আর সেখানে খেলা করে অহংকার আর বুদ্ধি। মায়া যেখানে অহংকারের জন্ম দেয় সেখানে বুদ্ধি নিজেকে সংহত করে জ্ঞান থেকে। আবার জ্ঞান জন্ম দেয় চেতনার আর চেতনা থেকে তৈরী হয় সংস্কৃতির। প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেই ফসল যা সংস্কৃতির গুণমান থেকে উৎপাদিত সামগ্রী। সেই ফসলের সুরভীতে মাপা হয় ব্যক্তির উৎকর্ষতাকে।
পরিবারের সংকৃতির মান উন্নয়নের সাথে সাথে সমাজের উন্নয়ন হবে আর সমাজের উন্নয়নের সাথে জাতির উন্নয়ন হবে আর জাতির উন্নয়নের সাথে সাথে এই দৃশ্যমান পৃথিবীর উন্নয়ন হবে। পৃথিবীর সংকৃতির প্রাথমিক প্রশিক্ষনের স্থান সেই পরিবারে আমরা বাস করি। তাই আমাদের দায়িত্ব অনেক , সেখানে কোন আদর্শ পরিবারের অনুসরণকারী হতে হবে অথবা নিজেরা এক আদর্শ পরিবারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে । সব কিছুর মুলে আছে জ্ঞান সঞ্চয়।
জীবনকে সবারই কর্মভূমি বানাতে হবে, পরিবার সেখানে হবে এক জীবনমুখী সংগঠন। তোমাদের জগৎ পরিচালিত হবে নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য। আর তাকেই সামনে রেখে যা কিছু বাইরের জগৎ থেকে আসা সংবাদকে তোমার মগজের মূল্যবান জায়গায় তখনি স্থান দেবে যারা তোমাদের বুদ্ধিকেও অযথা ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলবে না । আজ থেকে হোক আত্ম বিসর্জনের ব্যাখ্যার নবতম সংযোজন, যা কিছু প্রতিক্রিয়া দেবার প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। যে প্রতিক্রিয়া অপরের কাছে চাবুকের ব্যাথার সমতুল্য বা তার থেকে বেশী , তাকেই ত্যাগ করতে হবে। শব্দ ভীষন শক্তিমান, একটি শব্দ অপর একটি শব্দের জন্ম দেয় , সুচিন্তিত ব্যবহার না হলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটা ভীষণ গুরুতর। প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাই আমার এই আবেদন সার্বজনীন। প্রশংসা যেমন মানুষকে বাড়তি উৎসাহ সহকারে কাজ করতে সাহায্য করে, নিন্দাও ঠিক তার বিপরীতমুখী হয়ে গঠনমূলক কাজের ইচ্ছাকে দমন করে রাখে।
বেদনার উৎসের সন্ধানে
আমি বেশ কিছুদিন ধরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিলাম যাতে করে বাইরের কোলাহল আমার কর্ণকুহর দিয়ে প্রবেশ করে আমার অন্তরের একনিষ্ঠ সাধনাকে ভঙ্গ করতে না পারে। আজ আমি আমার মধ্যে আমাকেই খুঁজতেই ব্যস্ত থাকতে চাইছিলাম ।
নামনি, আজ যখন আমি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন আমার জীবনের অভিজ্ঞতার বৃদ্ধত্ব এসে গেছে। সেই জায়গা থেকে তোমাকে বলি একের প্রতি ভালোবাসা তোমাকে জীবনে অনেক গ্লানি দেবে, সেটা অনেক ক্লান্তিকর, সেখানে পদে পদে অপূর্ণতা আর বেদনায় ভরা। আমরা এই জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে অবিছিন্ন এবং সেই অর্থে যা কিছু সৃষ্টি চারপাশে ছাড়িয়ে আছে সবাই আমাদের আত্মার আত্মীয়, তাই তোমার ভালোবাসা যদি সবার মধ্যে বেঁচে থাকে তাহলে সেই সার্বজনীন ভালোবাসার মধ্যে ক্ষুদ্র ভালোবাসার না পাবার ব্যাথ্যায় তোমাকে কাতর করতে পারবেনা।
বন্ধু হে আমার রয়েছে দঁড়িয়ে
নামণি , মনে আছে , ১৯৯০ সালের জুন মাসের ২৭ তারিখের ঘটনাটা, ঠিক তার কদিন আগে হাসপাতাল থেকে আমি ঘরে এসেছিলাম। সেইদিন আমি তখন বেলেঘাটার বাড়িতে , গগনে গগনে বিদ্যুতের বিরামহীন আসা-যাওয়া , আর তাদের মৃদঙ্গ ধ্বনি বাজছিল, যেন উৎসবের আনন্দে বার বার পৃথিবীটা নেচে উঠছিল । এই গানের অর্থ কেউ বা বোঝে আর কেউবা বোঝেনা। এই সুর কারোর কাছে আগমনী গান আবার কারোর কাছে অশুভ মুহূর্তের সূচনা। তুমি তার দ্বিতীয়টাকে বেঁচে নিয়ে ছিলে। সেই তিমিরে লুকিয়ে থাকা ভয় তোমাকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধে ফেলেছিল, তার অনুরণনে তুমি আমাকে তোমার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ছিলে , আর আমার ছোট্ট শরীরটা যদিও যেন সেই আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছিল কিন্তু আমি স্থির ছিলাম প্রাক-সংবাদের অপেক্ষায়। আমার কাছে সেটা ছিল আমার এক বিশেষ অতিথির আগমনের পদধ্বনি। মনে আছে, হঠৎই আমি আগুন আগুন বলে তোমার কোল থেকে উঠে পড়লাম। জানতো, সেদিনের স্বপ্নটা ছিল, কারা যেন একটা পাটাতনের উপর শুইয়ে দিয়ে এক আগুনের ফার্নেসের দিকে আমাকে ঠেলে দিচ্ছিল। তোমাকে আমি তাই কিছু বলিনি।
কারা যেন বাইরের থেকে এসে আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্য যে যন্ত্রটিকে যে পেশিগুলি আঁকড়ে ধরে থাকতো তাদেরকে বার বার অনুৎসাহিত করছিলো সেই যন্ত্রটিকে ধরে রাখতে। তাদের অসহযোগিতায় আমি আমার অন্য বন্ধুদের তুলনায় খেলাধুলা করতে গিয়ে হাপিয়ে পড়তাম, সেটা অবশ্য মাত্র আজ থেকে কিছুদিন আগের ঘটনা।
যাকগে, আমার আর তোমার গৃহে বাস করার মেয়াদ উত্তীর্ন হয়ে গেছে , এই পৃথিবীর অতিথির আহবান এসেছে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করার। হোকনা সেই প্রত্যাবর্তনটা মাত্র পাঁচ বছর মেয়াদের , কিন্তু নামনি, ফিরে তো সবাইকে যেতেই হবে, এটাই বাস্তব , আমরা তো সবাই ক্ষনিকেরই অতিথি।
সময়টা সম্ভবত ভোর পাঁচটার আশেপাশে হবে। আমাকে নিয়ে ফ্লোরে নার্সদের একরকম চঞ্চলতা লক্ষ্য করছিলাম। আমার অবস্থা দেখে তুমিও কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। নীচে নার্সিংহোমের বেঞ্চে আমার বাবা প্রত্যেক দিনের মতো সেদিন ও শুয়ে ছিল, যদি আমার জন্য অসময়ে বিশেষ কোন প্রয়োজনে আসতে পারে। সেই দিনটাই ছিল উপর থেকে বাবাকে ডাকবার অন্তিম দিন।
নামনি, আর হয়ত কিছুক্ষনের মধ্যে আমি আমার স্বস্থানে ফিরে যাব, আমাকে সেখানে বরণ করার জন্য শঙ্খধ্বনির আওয়াজ আমার অন্তরে অনুরণিত হচ্ছে ,আমি কান পেতে সেই শব্দ আমার হৃদয়ের গভীরে শুনতে পাচ্ছি।
আলো আর বাতাস তারা কোন এক অমোঘ নির্দ্দেশে আমাকে দেওয়া তাদের দানকে ফেরত নিয়ে গেল। তখন শেষবারের মতো তোমাকে মা বলে বার বার ডাকছিলাম, বাবা আমার সামনে টুলে বসে ছিল। বাবা তখন আমার মুখ দিয়ে 'বাবা' এই সম্বোধনটা শুনতে চাইছিল, আমি সেটা পূরণ করেছিলাম। , বাইরের সব কিছুই অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু মনে হল আমার অন্তর থেকে একটা সুক্ষ আলোকবর্তিকা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে , তার পর আর কিছু আমার মনে নেই। নামনি বিদায়।
তোমার বাবাই (রনিত মজুমদার )
ব্লগার -ৰবীন মজুমদার


মন্তব্যসমূহ