(১৩৫) অহংকারের রসায়ন (১ম পর্ব )

 (১৩৫)    অহংকারের রসায়ন (১ম পর্ব )

      


আমি অনন্য 

    নিজের অজান্তে কখন যেন দাম্ভিকতা রাজার অঙ্গের ভূষণ হয়ে উঠেছিল তা নিজেই জানেন না। ফিরে দেখা আর হয়ে উঠেনি, কি ভাবে দম্ভ তার মনে বাসা বেঁধেছিল। অবশ্য সেটার যথার্থতা বুঝতে রাজামশায়ের একটু সময় লেগেছিল । অবশ্য না হবার কোনো কারণ বোধ হয় ছিল না। যা যা উপকরণ থাকলে দম্ভের আত্মপ্রকাশ ঘটে, তার কোন ঘাটতি ছিলনা রাজার ভাণ্ডারে।

     উত্তরিধাকারের সূত্রে আর্যদের ন্যায় উজ্জ্বল  গায়ের রঙের সাথে মানানসই নাসিকা ভীষণ মার্জ্জিতভাবে উর্ধমুখী  আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চক্ষুদ্বয় দুইপাশে যতখানি যথার্থ জায়গা দখল করলে  নিজেকে সুপ্রকাশিত করা যায় ঠিক ততখানি পর্যন্তই  বিস্তারিত, শরীরে বাড়তি মেদের কোন ঘনঘটা নেই। বলা বাহুল্য, সব মিলিয়ে একই বোধ হয় সুপুরুষ বলা যেতে পারে।  

     রাজ্যটির ভৌগলিক কারণে প্রকৃতি তার ঐশর্য্য বিতরণের জন্য কোনো কার্পণ্য একদম করেনি, তাই চাষ-আবাদ বেশ ভালোই হতো। তাই  প্রজাদের কাছ থেকে আসা খাজনায় রাজকোষের উদরটি যথার্থই স্ফিত হয়ে উঠেছিল। আর যদি বংশ মর্যাদার প্রশ্ন উঠে,তাহলে তো কথাই নেই, সেরেস্তা ছেড়ে বহু দূর পর্য্যন্ত তাঁদের বংশের কৌলিন্যের মাহাত্ম ছাড়িয়ে পড়েছিল। এহেন, রাজমশাইয়ের ভাগ্য দেবতার বদান্যতায় পায়ের তলার জমিটা মাটি থেকে বেশ খানিকটা উপরে তুলে দিয়েছিল। আর তাই রাজাবাবু সেখান থেকে তার নিচের তলায় থাকা প্রাণীগণকে যে ক্ষুদ্র দেখবেন, সেটাতো  বলার কোন অপেক্ষাই রাখেনা।  

বন্ধ দুয়ারে দুর্যোগের ঘনঘটা 
 
    প্রত্যেক রাজপুরুষদের বহু রকমের শখ থাকে, ইনিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। শিকার আর নৌকাবিহার তার অন্যতম শখের অংঙ্গ। প্রতিবারের মতো এবারেও এক বর্ষার শেষে, পাইক বরকন্দাজ, রাঁধুনি ও রাজপুরুষদের সঙ্গে নিয়ে নৌকা বিহারে চললেন। এই দলের মধ্যে সব জাতি ও বর্ণের মানুষ আছেন। নিম্ন বর্ণের লোকেরা গায়ে-গতর দিয়ে পরিশ্রম করে বজরাটি মেরামত করা থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ করে এই যাত্রাটাকে বাস্তবায়িত করেছেন। 

    এই সময়টা নদী বক্ষে ভ্রমনের পক্ষে উপযুক্ত , কারণ ঝড় বা বৃষ্টির খুব একটা সম্ভাবনা থাকেনা। রাজার বজরা ধীরে ধীরে দেশের সীমানা অতিক্রম করে বহুদূর চলে এসেছেন, রাজ্যের সীমানার শেষ পিলারটি এখন থেকে একটা বিন্দুর মতো লাগছে। এইভাবেই নদীবক্ষে তিনদিন পানভোজন আর গান বাজনার মধ্যে দিয়ে কোথায় যেন অতিবাহিত হয়ে গেল তা বোঝাই গেলনা, আর এর মধ্যে প্রকৃতিতে বিশেষ কোন পরিবর্তনও নজরে পড়েনি। 

     চতুর্থ দিনের বিকাল থেকেই আকাশে মেঘের আবির্ভাব লক্ষ্য করা গেল, হালকা গরম হাওয়া নদীর পার্শবর্তী জঙ্গল থেকে বয়ে এলো। ঠিক তার কিছুক্ষনের মধ্যে আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেল। মাঝি মল্লারদের কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগেই ঝড়ের প্রথম আঘাতটা বজরার বড় মাস্তুলটাকে ভেঙ্গে জলের মধ্যে ফেলে দিলো। তারপরেই শুরু হলো ঝড়ের তান্ডব নৃত্য। হওয়ার তোড়ে বজরাটা পাড়ের কাছাকাছি গিয়ে কোন একদিন পাহাড় থেকে খসে পড়া বড় একটা পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে পড়ল। 

    এখানে জল কিন্তু বেশী নেই, কিন্তু মাঝিরা জানালো যে. এখানে সাংঘাতিক চোরাবালি আছে। বজরার সব যাত্রীদের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ালো সেই ভয়ংকর দলদলিতে। যতই তারা পাড়ের দিকে এগুনোর চেষ্টা করছে ততই যেন সেই দলদলি যেন তাদের নীচের দিকে আকর্ষণ করছে। নিশ্চিত মৃত্যু আশঙ্কায় যাত্রীরা আতঙ্কিত। 

    ঝড় ঝঞ্ঝায় দিনের আলো প্রায় নির্বাপিত, এমত অবস্থায় সেই মাঝি মল্লার দল সেই ভেঙ্গে যাওয়া বজরা থেকে দড়ি বের করে প্রায় ডুবে যাওয়া বজরার লোহার থাম্বার সাথে একপ্রান্ত বেঁধে আরেকপ্রান্ত জঙ্গলের একটা মোটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিল। ধীরে ধীরে পাড়ের শক্ত জমিতে যাত্রীদের স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করলেন। রাজা একরকম সেই নিম্নবর্ণের মাঝিমল্লাদের কণ্ঠলগ্না হয়ে এ যাত্রায় তার পিতৃপুরুষের দেওয়া প্রাণটা রক্ষা করলেন।  

খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল 

    প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর তার সাথে জলকাদার মাহাত্ম এতটাই প্রবল ছিল যে, রাজার বহুমূল্য পাগড়ি আর মাঝি মোল্লারদের সাধারণ গামছাকে এক পংক্তিতে বেঁধে ফেলে চুপিসারে যেন বলে গেল , আসলে  সে গুলি যে, শুধুমাত্র কর্দমাক্ত কাপড়ের টুকরো ব্যাতিত তার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই।  

    যেমন ,সোনার দ্বারা তৈরি নেকলেস,কন্ঠের হার ইত্যাদি অলংকার আদতে সোনা ভিন্ন আর কিছুই নয়, ঠিক সেই রকম রাজার পাগড়ি আর মাঝির মাথার গামছা  সুতো ভিন্ন যে  আর অন্য  কিছুই নয়  এবং  তাকে আলাদা করে ভাবটাই যে ভুল, সেই চিরন্তন সত্যটাকেই আবার তুলে ধরলো।   

    নির্জন জঙ্গলে সেই যাত্রীদের নতুন একটাই পরিচয় হল তারা কেউ  রাজা নয়, রাজপুরুষও নয় তারা শুধু মাত্র সব হারানো দেশের জীবন্ত কতগুলি মানুষ আর তাদের পার্থিব জগতের সব নকল উপাধিগুলি এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেড়ে নিয়েছে ; আর সেই জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ত্রাতারূপে দাঁড়িয়ে আছে সেই নাম-পরিচয় গোত্রহীন একদল প্রান্তিক মানুষ, যারা নিজেদের প্রাণকে হাতে রেখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের মানবতার ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

তোমার সাথে দেখা না হলে    

    জীবন-মৃত্যুর সন্দিক্ষনে দাঁড়িয়ে, সামান্য জল কাঁদা যেন রাজার মিথ্যা অহংকারকে ধুয়ে মুছে  দিল আর তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলো প্রচলিত জীবনের ওপারে যে আরেকটি জগৎ আছে তার সামনে।  রাজা  যেন আকাশবাণী শুনতে পেলেন, কোন এক সুদূর জগৎ থেকে কে যেন বলে গেল রাজসিক পোশাকে আবৃত যে স্থুল শরীরকে নিয়ে তুমি এতদিন অহংকার করেছিলে, সেটা তোমার আসল চেহারা নয়, ওটা তোমার মিথ্যা আবরণ আর আজ থেকে যাত্রা শুরু করো, "তুমি আসলে কে " ,সেই প্ৰকৃত সত্যটা জানবার।   

তুমি আখর না চেনালে 

     আত্মাভিমানী রাজা মনস্থির করলেন তিনি তার প্রশ্নের উত্তর না পেলে দেশে আর ফিরেই যাবেন না। এই অনন্ত জিজ্ঞাসাই তাকে উদ্বুদ্ধ করলো নতুন পথের দিশা খোঁজার। দীর্ঘ পরিক্রমার পর তিনি উপস্থিত হলেন  অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত এক ছোট ছোট কুটীর আর গাছ গাছড়ায় ঘেরা এক ঋষির আশ্ৰমে। 

বহু পূর্বেই এই বৈদিক ঘরনার ঋষির কথা তিনি শুনেছিলেন। কুশল বিনিময় করার পর, খুবই সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় রাজামশাই তার ফেলে জীবনের সাথে ঋষিবরের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তার সাথে এও জানালেন, তার এখানে আসার কারণ। মৃদু হেসে ঋষিবর দীর্ঘ পথ যাত্রাজনিত ক্লান্তি নিবারণের জন্য আশ্রমের আবাসিকদের বললেন, রাজার আহারাদি ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করার করতে।  

    সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, রাজা নিদ্রা থেকে উঠে সম্বিৎ খানিকটা হারিয়ে ফেলেছিলেন, কখন যে তার মখমলে পালঙ্ক থেকে তার উত্তরণ ঘটছে বাঁশের মাচার উপর খড় বিছানো গদিতে,আর সেটা কি করে হলো! এই ভাবনা থেকে ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় তার অতিবাহিত হয়ে গেলো। পরে অবশ্য, একের পর এক সব ঘটনাগুলি মনে পরে গেল।  

    সন্ধ্যের পর এখানে আহার গ্রহণ করার প্রচলন নেই, তাই কিছুক্ষনের মধ্যে রাজার জন্য খাবারের ব্যবস্থা হলো অন্যান্য আবাসিকদের সাথে নিতান্তই মাটিতে বসে। দেহের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অবাধ্য ক্ষুধা ভুলিয়ে দিয়েছিল যাবতীয় ফেলে আসা খাদ্যাভাসকে। সেই মুহূর্তে,ক্ষুধার লেলিহান আগুনকে নিভানোর জন্য কিছু খাদ্যেরই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। 
 
জীবনে জীবন যোগ করা 

    শরীরের চঞ্চলতা যথা সময় আহারের উপযুক্ত যত্ন আত্তিতে প্রশমিত হয়ে গেছে। এবার মনের চাহিদা মিটানোর পিপাসায় রাজার হৃদয় ক্রমেই শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হয়ে উঠেছে। অবশেষে ঋষিবরের আহবানে রাজা মশাই একটা মস্ত বড়ো শিমুল গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। হয়ত পূর্ণিমা দুই একদিন আগেই হয়ে গেছে।  চাঁদের আলোর ঝলকানি গাছের ফাঁক দিয়ে এসে অন্ধকারকে বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। 

    সকালের সূত্র ধরে ,ঋষিবর বলতে শুরু করলেন। হে রাজন! আপনার জীবন সম্পর্কিত প্রশ্নের কারনগুলি আমি অনুভব করেছি। আপনি কার্যটাকেই  প্রত্যক্ষ করেছেন,  কিন্তু তার  পশ্চাতে কি কারণ আছে, সেটাই আপনাকে ভাবিত করে তুলেছে। মানুষ নিরন্তর এই ভাবনাটাই ভেবেছে তাকে কি ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ভারতীয়দের দর্শনের পাতায় যেতে হবে।  

 
আমাদের সকল দুঃখের প্রদীপ  

    যুগ যুগান্ত ধরে প্রাচীন ঋষিরা ধ্যানের গভীরে গিয়ে জীবের দুঃখের কারণগুলি অনুসন্ধান করে ছিলেন। সেই প্রেক্ষিত থেকে মানবজাতির উত্তরণের উপায় প্রতিটি ছত্রে নির্দ্দেশিত হয়েছিল। তার যথার্থতা আমরা অনুভব করেছি, তাই আমরা মানুষের উন্নত জীবনবোধের কথাই বলে থাকি যা আমাদের সেই দর্শন থেকে পেয়েছি। 

জীবন যেখানে শুকায়ে যায় 
 
    হে রাজন ! আপনার অবস্থান ছিল সংসারে, 'সংসার' এই শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার উত্তর। 'সং'-এর সাথে 'সৃ' ধাতু যুক্ত হয়ে 'সংসার' শব্দটি গঠিত হয়েছে। সৃ-ধাতুর অর্থ হচ্ছে আবর্তন করা বা বৃত্ত পথে ঘোরা, অর্থাৎ শুধুই খুঁজে যাওয়া যতক্ষন পর্যন্ত ইন্দ্রিয়ের দাবি পূরণ না হোচ্ছে। সেটাই ভোগ, আর সেই ভোগের রেশ ফুরাতে না ফুরাতে আবার তৃষ্ণা, আবার ভোগ। এযেন শুধুই সারা জীবন ধরে কলুর বলদের মতো একই বৃত্তে ঘানি টানা, একদিন প্রাণবায়ুর পরিসমাপ্তিতেই তার ইতি। বাইরের মোহময় জগতের  হাতছানিতে সাড়া দিয়ে গোটা জীবনটা সেই  চঞ্চল ইন্দ্রিয়ের ইশারায় একই আবর্ত্তের মধ্যে ঘুরে ফেরে। 

মনের গহনে 

   মনের ক্যানভাসে এক সময় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় কতো রঙই না সাজানো  থাকে, তাদের মধ্যে কেউ বা কামনা নামে পরিচিত , কেহ বা বাসনা, কেউ বা ত্যাগ আবার কেউবা ভোগ প্রভৃতি পরস্পর বিরোধী রঙের একসাথে বাস করে।  

    যেই না ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গৃহীত ছবিগুলি  মনের আয়নায় প্রতিফলিত হল, সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি তার দলবল নিয়ে কর্ম করতে শুরু করে দিলো। মন হচ্ছে ক্যানভাস। সেখানে কখনো বা  কামনার রঙে ক্যানভাসে আঁকছে আর সেটা লোভ হয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, লোভ যদি কাঙ্খিত বস্তুকে পেয়ে যায় তখন মন বলছে "আমি  তৃপ্ত "  আর তাকে যদি   ইপ্সিত  সেই বস্তু ধরা না দেয় তখন  মন  হয় ব্যাকুল আর তখন মনের গভীরে প্রোথিত হয় চিরন্তন বিরহের বীজ, সেই বীজ একদিন প্রকান্ড এক মহীরুহ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। হতাশার সৌধটা সেখান থেকেই নির্মিত হয়। আবার যখন জ্ঞানের হাত ধরে যখন বুদ্ধির উপর থেকে অহংকারের ছায়াটাকে মানুষ ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়, তখন মানুষ নিজেকে চিনতে আর ভুল করেনা। কামনা, বাসনার প্রভাব থেকে সে মুক্ত হয়ে যায়, সেটাই মোক্ষ লাভ। 

    হে রাজন ! লক্ষ্য করুন, যতক্ষন বাইরের জগতের কাছ থেকে মন কোন সংবাদ পায়নি, ততক্ষন সে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বাস করছিল জীবের অন্তঃপ্রকৃতিতে। যেই না,প্রকৃতি আর চৈতন্যের মিলন হলো তখনিই মনের মধ্যে শুরু হলো প্রলয়ের ঘনঘটা। 

    ঋষিবর, আবার বলতে শুরু করলেন, আপনি হয়তো বলতে পারেন, কেন আমি সেটাকে প্রলয় বললাম। তার কারণ হিসাবে আমি বলতে পারি, যতোক্ষন বাহ্য প্রকৃতির সাথে অন্তঃপ্রকৃতির মিলন হয়নি তখন মানুষের মধ্যে কর্ম ইন্দ্রিয়ের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি। তাহলে, চঞ্চলতা বা প্রলয় তখনিই হলো, যখন এই দুইয়ের মিলন সম্পূর্ণ হল। আমি এবার আপনাকে আমাদের প্রাচীন দর্শনের সাথে পরিচয় করাই। 

    প্রকৃতির মতো আমাদের মনও জড়। যেমন, আপনি কখন কি দেখেছেন বিনা বাতাসে গাছের পাতাকে নড়তে? অবশ্যই দেখতে পারবেন না।  কেননা, আমাদের দর্শন অনুযায়ী যে পাঁচটি মৌলিক উপাদান নিয়ে এই মহাবিশ্ব জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, যেমন, পৃথিবী, জল,বায়ু,আগুন ও আকাশ। এই পাঁচটি উপাদানের একটি উপাদান হলো বায়ু এবং এই বায়ুর স্পর্শে গাছের পাতা নড়ে উঠে। তাহলে, দেখুন রাজামশাই, গাছটি প্রকৃতির অন্তর্গত, যা হচ্ছে জড় সম্প্রদায়ভুক্ত। এই জড় সাথে মৌলিক বস্তুর  অর্থাৎ বায়ুর সংস্পর্শে একটা যৌগিক বস্তুর জন্ম হল এবং সঙ্গে সঙ্গে  গাছের পাতা তার পূর্বেকার জড় চরিত্র থেকে সাময়িক পরিবর্তিত হয়ে একটা গতিশীল বস্তু  হিসাবে আমাদের সামনে প্রতীয়মান হলো। সমুদ্রের  ঢেউয়ের ক্ষেত্রেও তাই। আমরাই ভুল করে মাঝে মাঝে ঢেউয়ের সাথে সমুদ্রের জলকে আলাদা করে ভাবি।  যাঁকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল কার্য্য, আর পিছনে থেকে যে এই কাজটা করলো সে হচ্ছে কারণ, যাকে আমরা দেখতে পাই না। রাজামশাই! আপনাকে সূত্র দিয়ে দিলাম, আপনি এক এক করে বিশ্লেষণ করলে সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন।

সাংখ্য দর্শনের আলোকে অহংকার

    যখন থেকে এই বিশ্ব প্রকৃতি জীবের অস্তিস্ত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিল, তখনিই সে অর্জন করেছিল অহংকার নামক বোধকে।  তাই যদি হয় তাহলে, নিশ্চয়ই প্রকৃতির মধ্যেই সেই গুনাগুনগুলি অবশ্যিই রয়েছে, তা না হলে সে পেল কোথা থেকে ?  সেই উপাদানগুলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাংখ্য দর্শন  প্রকৃতির গঠন প্রক্রিয়ায় তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে, তারা যথাক্রমে, সত্ত্ব(১), রজঃ(২) এবং তমঃ(৩) এই তিনটি উপাদান সৃষ্টির আদিতে প্রকৃতিতে সাম্যাবস্থায় বাস করে। যখন প্রকৃতি সৃষ্টির অবস্থায় আসে তখন তিনটি উপাদানের চরিত্রগত পরিবর্তন হতে শুরু করে এবং এই সাম্য অবস্থা ভেঙ্গে নানাভাবে একে অন্যের সাথে মিলে যায় আর ঠিক তখনি সৃষ্টি হয় ব্রম্মান্ডের। অর্থাৎ অব্যক্ত অবস্থায় স্থিতিশীল আর ব্যক্ত অবস্থায় ঠিক তার বিপরীত ক্রিয়া।  

    বিকাশের প্রাথমিক অবস্থাকে সাংখ্যমতে বুদ্ধি নামে  অভিহিত করেছে  আর সেখান থেকেই অহংজ্ঞানের উৎপত্তি হয়। তাহলে বুদ্ধি হচ্ছে সেই বোধ নির্ধারণের মাপকাঠি, যার থেকে বিশ্লেষক জীবটি  অন্য জীবের সত্তার সাথে নিজেকে আলাদা বোধ করে থাকে।  

    হে রাজন ! বিশ্ব জগতের নিয়ম অনুসারে আপনি আপনার জীবনের শুরু থেকেই নিজেকে অপরের সাথে পার্থিব বস্তুর নিরিখে আলাদা করে ভাবতেন। 

    অহংজ্ঞান বা  অহংকার থেকে জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, কর্ম্মইন্দ্রিয়,তন্মাত্রা অথাৎ শব্দ,স্পর্শ, রস প্রভৃতি সূক্ষ সূক্ষ পরমাণুর(৪) উৎপত্তি হয়। এই সূক্ষ পরমাণু থেকে স্থুল পরমাণুর উৎপত্তি হয়, যে জড় নামে পরিচিত  

    তন্মাত্রার(৫) দুটি দিক আছে।  যাকে দেখা যায় না, সেই সব পরমাণুকে অবশ্যই পরিমান করা যায় না। যাকে দেখা যায় সে হচ্ছে স্থুল পরমাণু, যাদের অনুভব করা যায় অর্থাৎ সে ইন্দ্রিয়ের গোচরে থাকে।  

    প্রাণ একটি স্নায়বিক শক্তির একক, যার কাজ দেহকে সচল রাখা এবং তাকে পিছন থেকে পরিচালনা করে চিত্ত আর সেই চিত্ত হলো মন,বুদ্ধি ও অহংকারের সমষ্টি। 

    প্রাণ বায়ুর প্রত্যক্ষ রূপ হচ্ছে নিশ্বাস প্রশ্বাস। মনে রাখা প্রয়োজন যে প্রাণই বায়ুর উপর কাজ করে, বায়ু কিন্তু প্রাণের উপর কাজ করে না। 

    ঋষিবর আজকের মতো এখানেই প্রথম দিনের পাঠ শেষ করলেন এবং রাজাকে বাকি অংশ দ্বিতীয় দিনে শুরু করবেন সেইমতো  প্রতিশ্রুতি দিলেন। 


সংক্ষিপ্ত টীকা 

(১)সত্ত্ব- যার প্রকাশে থাকে সাদা রংয়ের সমাহার। যে বহন করে চলে সৌন্দর্য্য, উজ্জ্বলতা যার উপস্থিতিতে উপলদ্ধি হয় ধীর, স্থির এবং আনন্দের এক প্রতিমূর্তির। 

(২)রজঃ- রঙ হিসাবে বর্ণনা করলে, সেটার  প্রতীকী রঙ লাল। যে নির্দ্দেশ করে গতির আর গতি থাকলে অবশ্যিই তার অভিমুখ হবে ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। ক্রিয়ার স্বার্থকতার  জন্য একদিকে যেমন থাকবে উচ্ছাস আর অন্যদিকে অসফলতার জন্য থাকবে বেদনা। 

(৩)তমঃ- যে নির্দ্দেশ করে কালো বা তামসিক বা অন্ধকারের রঙকে। যেখানে লয় হবে গতির বাজবে সমাপ্তির সুর। অলসতা কিংবা ধংসের প্রকাশে হবে তার পরিণতি। 

(৪)পরমাণুর- মানব সমাজের অগ্রগতির ইতিহাসে প্রথমে এসেছে প্রত্যক্ষ, অনুমান তারপরে এসেছে প্রমান।  অনুমান দর্শনের অন্তর্গত আর প্রমান করার দায়িত্ব বিজ্ঞানের। 

    যে  ধারণার জন্ম হয়েছিল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর পূর্বে ভারতীয় দার্শনিক "কনাদের" মনোজগতে, সেটি আরো প্রস্ফুটিত হয়েছিল গ্রিক দার্শনিক "ডেমোক্রিটাসের" দর্শনে। পরমাণু একটি মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। তিনি মনে করতেন,এই পরমাণুর বিভিন্ন আকার এবং তার ব্যাপ্তি শুধুমাত্র জড়পদার্থের মধ্যে আবদ্ধ নয়, সে   ইন্দ্রিয়ের এবং আত্মার ধারণার সাথেও সম্পর্কযুক্ত। 

(৫)তন্মাত্রার- সৃষ্টির রহস্যভেদ করার অদম্য ইচ্ছা  মানুষের জন্মলগ্ন থেকে শুরু হয়ে সভ্যতার পাদদেশে এসেও একই ভাবে বিদ্যমান,অবশ্য আধুনিক যুগে পরিসরটা বৃদ্ধি পেয়েছে আনুসাঙ্গিক প্রযুক্তির মান উন্নয়নের সাথে। এই গভীর জিজ্ঞাসা ভারতীয় দর্শন "তন্মাত্র " শব্দটির মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্বের সুক্ষ উপাদানগুলি ধরে রেখেছে। রূপ, রস , গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দের মাধ্যমে উপলদ্ধ হয় জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের চালিকা শক্তির, এরা সবাই সুক্ষ উপাদানের অন্তর্ভুক্ত। আবার পাশাপাশি আকাশ,বায়ু,অগ্নি,জল ও পৃথিবী এইসব  স্থুল উপাদানের অন্তর্ভুক্ত।  এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সুক্ষ ও স্থুল উপাদানের মিলনের পরিণতি।  

ক্ৰমশঃ   

ব্লগার -রবীন মজুমদার

মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬১ তম  অধ্যায় (১২৭)

Searching for hidden Truth (30) 


 

মন্তব্যসমূহ

Ani বলেছেন…
দারুন দারুন লাগলো। চালিয়ে যাও।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়