বন্ধ দুয়ারে দুর্যোগের ঘনঘটা
প্রত্যেক রাজপুরুষদের বহু রকমের শখ থাকে, ইনিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। শিকার আর নৌকাবিহার তার অন্যতম শখের অংঙ্গ। প্রতিবারের মতো এবারেও এক বর্ষার শেষে, পাইক বরকন্দাজ, রাঁধুনি ও রাজপুরুষদের সঙ্গে নিয়ে নৌকা বিহারে চললেন। এই দলের মধ্যে সব জাতি ও বর্ণের মানুষ আছেন। নিম্ন বর্ণের লোকেরা গায়ে-গতর দিয়ে পরিশ্রম করে বজরাটি মেরামত করা থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ করে এই যাত্রাটাকে বাস্তবায়িত করেছেন।
এই সময়টা নদী বক্ষে ভ্রমনের পক্ষে উপযুক্ত , কারণ ঝড় বা বৃষ্টির খুব একটা সম্ভাবনা থাকেনা। রাজার বজরা ধীরে ধীরে দেশের সীমানা অতিক্রম করে বহুদূর চলে এসেছেন, রাজ্যের সীমানার শেষ পিলারটি এখন থেকে একটা বিন্দুর মতো লাগছে। এইভাবেই নদীবক্ষে তিনদিন পানভোজন আর গান বাজনার মধ্যে দিয়ে কোথায় যেন অতিবাহিত হয়ে গেল তা বোঝাই গেলনা, আর এর মধ্যে প্রকৃতিতে বিশেষ কোন পরিবর্তনও নজরে পড়েনি।
চতুর্থ দিনের বিকাল থেকেই আকাশে মেঘের আবির্ভাব লক্ষ্য করা গেল, হালকা গরম হাওয়া নদীর পার্শবর্তী জঙ্গল থেকে বয়ে এলো। ঠিক তার কিছুক্ষনের মধ্যে আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেল। মাঝি মল্লারদের কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগেই ঝড়ের প্রথম আঘাতটা বজরার বড় মাস্তুলটাকে ভেঙ্গে জলের মধ্যে ফেলে দিলো। তারপরেই শুরু হলো ঝড়ের তান্ডব নৃত্য। হওয়ার তোড়ে বজরাটা পাড়ের কাছাকাছি গিয়ে কোন একদিন পাহাড় থেকে খসে পড়া বড় একটা পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে পড়ল।
এখানে জল কিন্তু বেশী নেই, কিন্তু মাঝিরা জানালো যে. এখানে সাংঘাতিক চোরাবালি আছে। বজরার সব যাত্রীদের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ালো সেই ভয়ংকর দলদলিতে। যতই তারা পাড়ের দিকে এগুনোর চেষ্টা করছে ততই যেন সেই দলদলি যেন তাদের নীচের দিকে আকর্ষণ করছে। নিশ্চিত মৃত্যু আশঙ্কায় যাত্রীরা আতঙ্কিত।
ঝড় ঝঞ্ঝায় দিনের আলো প্রায় নির্বাপিত, এমত অবস্থায় সেই মাঝি মল্লার দল সেই ভেঙ্গে যাওয়া বজরা থেকে দড়ি বের করে প্রায় ডুবে যাওয়া বজরার লোহার থাম্বার সাথে একপ্রান্ত বেঁধে আরেকপ্রান্ত জঙ্গলের একটা মোটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিল। ধীরে ধীরে পাড়ের শক্ত জমিতে যাত্রীদের স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করলেন। রাজা একরকম সেই নিম্নবর্ণের মাঝিমল্লাদের কণ্ঠলগ্না হয়ে এ যাত্রায় তার পিতৃপুরুষের দেওয়া প্রাণটা রক্ষা করলেন।
খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল
প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর তার সাথে জলকাদার মাহাত্ম এতটাই প্রবল ছিল যে, রাজার বহুমূল্য পাগড়ি আর মাঝি মোল্লারদের সাধারণ গামছাকে এক পংক্তিতে বেঁধে ফেলে চুপিসারে যেন বলে গেল , আসলে সে গুলি যে, শুধুমাত্র কর্দমাক্ত কাপড়ের টুকরো ব্যাতিত তার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই।
যেমন ,সোনার দ্বারা তৈরি নেকলেস,কন্ঠের হার ইত্যাদি অলংকার আদতে সোনা ভিন্ন আর কিছুই নয়, ঠিক সেই রকম রাজার পাগড়ি আর মাঝির মাথার গামছা সুতো ভিন্ন যে আর অন্য কিছুই নয় এবং তাকে আলাদা করে ভাবটাই যে ভুল, সেই চিরন্তন সত্যটাকেই আবার তুলে ধরলো।
নির্জন জঙ্গলে সেই যাত্রীদের নতুন একটাই পরিচয় হল তারা কেউ রাজা নয়, রাজপুরুষও নয় তারা শুধু মাত্র সব হারানো দেশের জীবন্ত কতগুলি মানুষ আর তাদের পার্থিব জগতের সব নকল উপাধিগুলি এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেড়ে নিয়েছে ; আর সেই জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ত্রাতারূপে দাঁড়িয়ে আছে সেই নাম-পরিচয় গোত্রহীন একদল প্রান্তিক মানুষ, যারা নিজেদের প্রাণকে হাতে রেখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের মানবতার ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জীবন-মৃত্যুর সন্দিক্ষনে দাঁড়িয়ে, সামান্য জল কাঁদা যেন রাজার মিথ্যা অহংকারকে ধুয়ে মুছে দিল আর তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলো প্রচলিত জীবনের ওপারে যে আরেকটি জগৎ আছে তার সামনে। রাজা যেন আকাশবাণী শুনতে পেলেন, কোন এক সুদূর জগৎ থেকে কে যেন বলে গেল রাজসিক পোশাকে আবৃত যে স্থুল শরীরকে নিয়ে তুমি এতদিন অহংকার করেছিলে, সেটা তোমার আসল চেহারা নয়, ওটা তোমার মিথ্যা আবরণ আর আজ থেকে যাত্রা শুরু করো, "তুমি আসলে কে " ,সেই প্ৰকৃত সত্যটা জানবার।
তুমি আখর না চেনালে
আত্মাভিমানী রাজা মনস্থির করলেন তিনি তার প্রশ্নের উত্তর না পেলে দেশে আর ফিরেই যাবেন না। এই অনন্ত জিজ্ঞাসাই তাকে উদ্বুদ্ধ করলো নতুন পথের দিশা খোঁজার। দীর্ঘ পরিক্রমার পর তিনি উপস্থিত হলেন অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত এক ছোট ছোট কুটীর আর গাছ গাছড়ায় ঘেরা এক ঋষির আশ্ৰমে।
বহু পূর্বেই এই বৈদিক ঘরনার ঋষির কথা তিনি শুনেছিলেন। কুশল বিনিময় করার পর, খুবই সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় রাজামশাই তার ফেলে জীবনের সাথে ঋষিবরের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তার সাথে এও জানালেন, তার এখানে আসার কারণ। মৃদু হেসে ঋষিবর দীর্ঘ পথ যাত্রাজনিত ক্লান্তি নিবারণের জন্য আশ্রমের আবাসিকদের বললেন, রাজার আহারাদি ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করার করতে।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, রাজা নিদ্রা থেকে উঠে সম্বিৎ খানিকটা হারিয়ে ফেলেছিলেন, কখন যে তার মখমলে পালঙ্ক থেকে তার উত্তরণ ঘটছে বাঁশের মাচার উপর খড় বিছানো গদিতে,আর সেটা কি করে হলো! এই ভাবনা থেকে ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় তার অতিবাহিত হয়ে গেলো। পরে অবশ্য, একের পর এক সব ঘটনাগুলি মনে পরে গেল।
সন্ধ্যের পর এখানে আহার গ্রহণ করার প্রচলন নেই, তাই কিছুক্ষনের মধ্যে রাজার জন্য খাবারের ব্যবস্থা হলো অন্যান্য আবাসিকদের সাথে নিতান্তই মাটিতে বসে। দেহের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অবাধ্য ক্ষুধা ভুলিয়ে দিয়েছিল যাবতীয় ফেলে আসা খাদ্যাভাসকে। সেই মুহূর্তে,ক্ষুধার লেলিহান আগুনকে নিভানোর জন্য কিছু খাদ্যেরই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
জীবনে জীবন যোগ করা
শরীরের চঞ্চলতা যথা সময় আহারের উপযুক্ত যত্ন আত্তিতে প্রশমিত হয়ে গেছে। এবার মনের চাহিদা মিটানোর পিপাসায় রাজার হৃদয় ক্রমেই শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হয়ে উঠেছে। অবশেষে ঋষিবরের আহবানে রাজা মশাই একটা মস্ত বড়ো শিমুল গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। হয়ত পূর্ণিমা দুই একদিন আগেই হয়ে গেছে। চাঁদের আলোর ঝলকানি গাছের ফাঁক দিয়ে এসে অন্ধকারকে বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
সকালের সূত্র ধরে ,ঋষিবর বলতে শুরু করলেন। হে রাজন! আপনার জীবন সম্পর্কিত প্রশ্নের কারনগুলি আমি অনুভব করেছি। আপনি কার্যটাকেই প্রত্যক্ষ করেছেন, কিন্তু তার পশ্চাতে কি কারণ আছে, সেটাই আপনাকে ভাবিত করে তুলেছে। মানুষ নিরন্তর এই ভাবনাটাই ভেবেছে তাকে কি ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ভারতীয়দের দর্শনের পাতায় যেতে হবে।
আমাদের সকল দুঃখের প্রদীপ
যুগ যুগান্ত ধরে প্রাচীন ঋষিরা ধ্যানের গভীরে গিয়ে জীবের দুঃখের কারণগুলি অনুসন্ধান করে ছিলেন। সেই প্রেক্ষিত থেকে মানবজাতির উত্তরণের উপায় প্রতিটি ছত্রে নির্দ্দেশিত হয়েছিল। তার যথার্থতা আমরা অনুভব করেছি, তাই আমরা মানুষের উন্নত জীবনবোধের কথাই বলে থাকি যা আমাদের সেই দর্শন থেকে পেয়েছি।
জীবন যেখানে শুকায়ে যায়
হে রাজন ! আপনার অবস্থান ছিল সংসারে, 'সংসার' এই শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার উত্তর। 'সং'-এর সাথে 'সৃ' ধাতু যুক্ত হয়ে 'সংসার' শব্দটি গঠিত হয়েছে। সৃ-ধাতুর অর্থ হচ্ছে আবর্তন করা বা বৃত্ত পথে ঘোরা, অর্থাৎ শুধুই খুঁজে যাওয়া যতক্ষন পর্যন্ত ইন্দ্রিয়ের দাবি পূরণ না হোচ্ছে। সেটাই ভোগ, আর সেই ভোগের রেশ ফুরাতে না ফুরাতে আবার তৃষ্ণা, আবার ভোগ। এযেন শুধুই সারা জীবন ধরে কলুর বলদের মতো একই বৃত্তে ঘানি টানা, একদিন প্রাণবায়ুর পরিসমাপ্তিতেই তার ইতি। বাইরের মোহময় জগতের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে গোটা জীবনটা সেই চঞ্চল ইন্দ্রিয়ের ইশারায় একই আবর্ত্তের মধ্যে ঘুরে ফেরে।
মনের গহনে
মনের ক্যানভাসে এক সময় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় কতো রঙই না সাজানো থাকে, তাদের মধ্যে কেউ বা কামনা নামে পরিচিত , কেহ বা বাসনা, কেউ বা ত্যাগ আবার কেউবা ভোগ প্রভৃতি পরস্পর বিরোধী রঙের একসাথে বাস করে।
যেই না ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গৃহীত ছবিগুলি মনের আয়নায় প্রতিফলিত হল, সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি তার দলবল নিয়ে কর্ম করতে শুরু করে দিলো। মন হচ্ছে ক্যানভাস। সেখানে কখনো বা কামনার রঙে ক্যানভাসে আঁকছে আর সেটা লোভ হয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, লোভ যদি কাঙ্খিত বস্তুকে পেয়ে যায় তখন মন বলছে "আমি তৃপ্ত " আর তাকে যদি ইপ্সিত সেই বস্তু ধরা না দেয় তখন মন হয় ব্যাকুল আর তখন মনের গভীরে প্রোথিত হয় চিরন্তন বিরহের বীজ, সেই বীজ একদিন প্রকান্ড এক মহীরুহ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। হতাশার সৌধটা সেখান থেকেই নির্মিত হয়। আবার যখন জ্ঞানের হাত ধরে যখন বুদ্ধির উপর থেকে অহংকারের ছায়াটাকে মানুষ ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়, তখন মানুষ নিজেকে চিনতে আর ভুল করেনা। কামনা, বাসনার প্রভাব থেকে সে মুক্ত হয়ে যায়, সেটাই মোক্ষ লাভ।
হে রাজন ! লক্ষ্য করুন, যতক্ষন বাইরের জগতের কাছ থেকে মন কোন সংবাদ পায়নি, ততক্ষন সে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বাস করছিল জীবের অন্তঃপ্রকৃতিতে। যেই না,প্রকৃতি আর চৈতন্যের মিলন হলো তখনিই মনের মধ্যে শুরু হলো প্রলয়ের ঘনঘটা।
ঋষিবর, আবার বলতে শুরু করলেন, আপনি হয়তো বলতে পারেন, কেন আমি সেটাকে প্রলয় বললাম। তার কারণ হিসাবে আমি বলতে পারি, যতোক্ষন বাহ্য প্রকৃতির সাথে অন্তঃপ্রকৃতির মিলন হয়নি তখন মানুষের মধ্যে কর্ম ইন্দ্রিয়ের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি। তাহলে, চঞ্চলতা বা প্রলয় তখনিই হলো, যখন এই দুইয়ের মিলন সম্পূর্ণ হল। আমি এবার আপনাকে আমাদের প্রাচীন দর্শনের সাথে পরিচয় করাই।
প্রকৃতির মতো আমাদের মনও জড়। যেমন, আপনি কখন কি দেখেছেন বিনা বাতাসে গাছের পাতাকে নড়তে? অবশ্যই দেখতে পারবেন না। কেননা, আমাদের দর্শন অনুযায়ী যে পাঁচটি মৌলিক উপাদান নিয়ে এই মহাবিশ্ব জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, যেমন, পৃথিবী, জল,বায়ু,আগুন ও আকাশ। এই পাঁচটি উপাদানের একটি উপাদান হলো বায়ু এবং এই বায়ুর স্পর্শে গাছের পাতা নড়ে উঠে। তাহলে, দেখুন রাজামশাই, গাছটি প্রকৃতির অন্তর্গত, যা হচ্ছে জড় সম্প্রদায়ভুক্ত। এই জড় সাথে মৌলিক বস্তুর অর্থাৎ বায়ুর সংস্পর্শে একটা যৌগিক বস্তুর জন্ম হল এবং সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতা তার পূর্বেকার জড় চরিত্র থেকে সাময়িক পরিবর্তিত হয়ে একটা গতিশীল বস্তু হিসাবে আমাদের সামনে প্রতীয়মান হলো। সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্ষেত্রেও তাই। আমরাই ভুল করে মাঝে মাঝে ঢেউয়ের সাথে সমুদ্রের জলকে আলাদা করে ভাবি। যাঁকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল কার্য্য, আর পিছনে থেকে যে এই কাজটা করলো সে হচ্ছে কারণ, যাকে আমরা দেখতে পাই না। রাজামশাই! আপনাকে সূত্র দিয়ে দিলাম, আপনি এক এক করে বিশ্লেষণ করলে সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন।
সাংখ্য দর্শনের আলোকে অহংকার
মন্তব্যসমূহ