(১৩৬) অহংকারের রসায়ন (২য় পর্ব )
(১৩৬) অহংকারের রসায়ন (২য় পর্ব )
সারা দিনের আশ্রমের পরিচালনা, আবাসিক শিষ্যদের শিক্ষাদানের পর্ব শেষ করে ঋষিবর বেশ খানিক্ষন ধ্যানে মনোনিবেশ করেন। এটা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। দিনের শেষে তিনি একটু অবসর পান তার রুটিন বহির্ভূত কাজ করার। সেই কারনে রাজা মশাইকে সন্ধ্যা ঘনানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো ঋষিবরকে একান্তে পাবার জন্য।
পূর্বের দিনের ন্যায় সেই গাছের নিচেই রাজামশাইকে বসবার জন্য আহবান করলেন ঋষিবর। দুই একটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা শেষ করে তিনি মূলপর্বে প্রবেশ করলেন।
বৈচিত্রময় জগৎ
ঋষিবর বলতে শুরু করলেন, হে রাজন ! ইন্দ্রিয়ের কার্য্য কারণের উপর সাধারণভাবে যে ধারণা আছে, তার বাইরেও আরো কিছু বৈচিত্র আছে। জগৎ দুই প্রকারের । একটি দৃশ্যমান জগৎ, অর্থাৎ যা আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে দেখে থাকি, তাকে আমরা জানি বহির্জগৎ হিসাবে। আবার আরেকটি জগৎ আছে যাকে আমরা দেখিনা বটে, কিন্তু অনুভব করতে পারি। দেখা ও না দেখার তারতম্যের নিরিখে প্রথমটি হচ্ছে স্থুল জগৎ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সুক্ষ জগৎ। এই দুই জগতের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসাবে কাজ ইন্দ্রিয়। এইবার বাইরের থেকে বহু সংবাদ এলো মনের গভীরে, সেখানে আছে বুদ্ধি।
বুদ্ধির কাজ
বুদ্ধির কাজ বিশ্লেষণ করার। আমাদের দর্শন আগেই বলেছে মন জড় সম্প্রদায়ভুক্ত। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন মনে আসে, বুদ্ধি এই শক্তি কোনখান থেকে পেল ? সেখানেই বুদ্ধির সাথে সংযোগ স্থাপনকারী চৈতন্য বসে আছে। চৈতন্য ব্যতিরেকে বুদ্ধি একেবারেই অচল। এখন প্রশ্ন হল, বুদ্ধি কি ভাবে চৈতন্যর সাথে সংযোগ স্থাপন করলো ? তন্মাত্রর সাহায্যে; যা রূপ,রস, গন্ধ,স্পর্শ ও শব্দের দ্বারা গঠিত। তাছাড়া সে জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের চালিকা শক্তি। এর মাধ্যমেই বুদ্ধি তার কর্মকে বাস্তবায়িত করে। এরা সুক্ষ উপাদান নামে পরিচিত। এটি প্রতক্ষ্য করা যায়না কিন্তু অনুভব করা যায়, তাই সে সুক্ষ উপাদান। সেই রূপ,রস, গন্ধ,স্পর্শ ও শব্দের হাত ধরে চেতনা প্রকাশিত হয় আর সেই প্রকাশকে বলে অনুভূতি।
এমনটি বলা যে পারে, একটি পুকুরের চারপাশে বৃক্ষের সমারোহ, তার দীর্ঘ ছায়া যেমন পুকুরের প্রতিফলিত হয় তার নিস্তরঙ্গ জলের দর্পনে , ঠিক সেই রকম বাইরের পৃথিবী থেকে গ্রহণ করা সংবাদ মনে এসে প্রবেশ করে,সেখান থেকে ব্যক্ত হয় বুদ্ধির আর তার প্রতিফলন ঘটে চেতনার দর্পনে।
ভোগ কি
বুদ্ধি ও চৈতন্যের অবস্থানটি পাশাপাশি থাকার দরুণ, সেই অনুভূতি চৈতন্য বা আমি'তে আরোপিত হয় এবং আমি'র সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ঠিক তখনিই বোধ হতে শুরু করে 'আমি' সুখী কিংবা 'আমি' দুঃখী। এই অনুভূতিটাকেই ভোগ বলে । সুতরাং, বুদ্ধি ও চৈতন্য এক নয়। বুদ্ধি পরিবর্তনশীল কিন্তু চৈতন্য অপরিবর্তনশীল । (পরে এর বিশ্লেষণ করা হবে )
তাহলে, নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হলনা যে, বুদ্ধির বিভ্রান্তিই মানবজাতির একমাত্র ভোগান্তির কারণ।
স্থিরতা আর অস্থিরতা
চিৎ বা চেতনা হল দর্পন এবং বুদ্ধির স্বভাব হোল সদাই পরিবর্তনশীল আর সেই বুদ্ধির প্রতিফলন হয় চিৎ অথবা চৈতন্যে। মানুষ অজ্ঞানে সেই প্রতিফলিত বস্তুকে 'আমি 'বা 'আমার' বলে মনে করে। উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা হলো সেই দর্পনের কোন সীমারেখা নেই, সেটাও বিভ্রান্তির কারণ। যদি থাকতো তাহলে বুঝতে পারতেন যে, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে , সেটা দর্পন ভিন্ন আর কিছু নয়।বুদ্ধির উপর অহংকারের ছায়া পড়ে নকলকে আসল বলে মনে হয়। মহাভারতে পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের সময় ময় দানবের তৈয়ারী রাজমহল দেখে দুর্যোধনের যে বিভ্রান্তি হয়েছিল, ঠিক সেই রকম ।
একাধারে বুদ্ধি যেমন একদিকে অহংকারকে সঙ্গে করে বিভ্রান্তি জাগায় আবার সেই বুদ্ধিতেই জ্ঞানের উন্মেষে বিবেককে জাগ্রত করতে সহায়তা করে এবং "আমি কে " সেই সত্যকে জানতে সাহায্য করে।
হে রাজন ! আবার আমরা কালকে এর পর থেকে আলোচনা করবো, এই বলে ঋষিবর আজকের মতো থামলেন।
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬২ তম অধ্যায় (১২৮)
Searching for hidden Truth (৩১)
মন্তব্যসমূহ