(১৩৭) অহংকারের রসায়ন (৩য় পর্ব )
(১৩৭) অহংকারের রসায়ন (৩য় পর্ব )
বিকালে কিছুক্ষন ধরে বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, তার সাথে সাথে আশ্রমের সমগ্র পরিবেশটাই রাজামশাইকে বর্তমানের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। কুটিরের জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দুই এক ফোটা বৃষ্টির সাথে অসময়ের দখিনা হাওয়া এসে তার স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়িয়ে স্মরণ করিয়ে দিল রাজঅলিন্দে থাকা তার ছোট্ট রাজকুমারের এবং সেই সদ্য বিয়ের পর রানীর সাথে প্রথম ছাদে গিয়ে একত্রে আলিঙ্গনরত হয়ে বৃষ্টিতে অবগাহনের মনমাতানো শিহরনের কথা। শৈশবের সেই বৃষ্টির দিনগুলিতে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলার কথা, আরো কত কি। ঠিক এমন সময়, একজন আবাসিক এসে ঋষিবরের আহ্বানের সংবাদ দিয়ে গেল।
আজ বর্ষা মুখর দিনে আর গাছের নিচে নয়, ঠাঁই হলো একটি একচালা ঘরে। গিয়ে দেখলেন বাঁশের মাচার উপর মাথা নত করে ঋষিবর উপবেশন করে আছেন। রাজা মশাই ঠিক তার বিপরীতে একটি প্রশস্ত গাছের সমতল গুঁড়ির উপর বসলেন।
ঋষিবর রাজা মশাইয়ের সাথে সৌহার্দ্য বিনিময় করে শুরু করলেন,ভারতীয় দর্শনের আলোকে জগৎ সৃষ্টি রহস্যের ঘটনা বলতে শুরু করলেন। সেই রহস্যভেদের মধ্যেই আছে সব প্রশ্নের উত্তর।
সৃষ্টি রহস্যের প্রাথমিক চর্চা
আজকে আমরা 'পঞ্চভূত' শব্দটির সাথে পরিচিত হবো। হিন্দু দর্শনে পঞ্চভূত বা পাঁচটা মৌলিক উপাদান নিয়ে এই বিশাল মহাজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই উপাদানগুলিকে স্বীয় চরিত্রগুন অনুযায়ী বিভাজিত করা হয়েছে। "ক্ষিতি" যাঁকে আমরা পৃথিবী বলে জানি, "বরুণ" অর্থাৎ জল, "মরুৎ" মানে হচ্ছে বায়ু , "তেজ" কে বর্ণনা করা হচ্ছে আগুন হিসাবে, আবার "ব্যোম" যাঁকে আমরা আকাশ বলে চিনে থাকি।
পঞ্চভূত
পঞ্চভূত তিন রকমের পদার্থের সংমিশ্রনে তৈরী। (১) সুক্ষ শরীর (২) স্থুল শরীর এবং (৩) বাইরের দৃশ্যমান জগৎ। স্থুলের বৈশিষ্ট হচ্ছে যাকে প্রতক্ষ্য করা যায়। সূক্ষ্যের বৈশিষ্ট হলো যা অনুমান সাপেক্ষ। যেমন, আমরা যদি শরীরকে শুধুমাত্র বিশ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে দেখতে পাব, স্থুল শরীর যখন নিশ্চিন্তে পরম তন্দ্রায় আছন্ন তখন আমাদের সুক্ষ শরীর স্বপ্নের জগতে ব্যস্ত হয়ে ঘোরা ফেরা করছে। আবার কখনো আমাদের বাহ্যজগৎ থেকে আসা অভিজ্ঞতাগুলিকে মনের স্মৃতি কোঠায় মহাফেজখানায় স্তরে স্তরে গুছিয়ে রাখছে। মজার ব্যাপার হোল,তখন সে পাঠাগারের কর্তা হিসাবে নতুন ও পুরানো সবরকমের অভিজ্ঞতাকেই ক্রমানুসারে সাজিয়ে রাখছে, আবার সে জানে জাগ্রত অবস্থায় আসা যাবার ব্যস্ততায় আর এই কাজগুলি করা হয়ে উঠবেনা। একমাত্র মনের তৃতীয় স্তরে সুষুপ্তি অবস্থায় পৌঁছানোর পর এই সুক্ষ শরীর চৈতন্যের কাছাকাছি চলে যায় বলে স্বপ্ন দেখার সমাপ্তি ঘটে।(এটা একটা দীর্ঘ আলোচনা,সেটা পরে করা যাবে )
হে রাজন ! আমরা জানলাম পঞ্চভূত দেহ আর বাহ্য জগৎ এই দুই উপাদান নিয়ে গঠিত আর দেহ সুক্ষ আর স্থুল এই দুই উপাদান নিয়ে গঠিত।
এই প্রসঙ্গটি বারংবার ঘুরে ফিরে আসবে যে, সৃষ্টির পশ্চাতে আছে প্রকৃতির 'রজঃ' গুণ , স্থিতির পশ্চাতে আছে প্রকৃতির 'সত্বঃ' গুণ আর প্রলয়ের পশ্চাতে আছে প্রকৃতির 'তমঃ' গুণ। 'তমঃ' গুনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল এক বস্তুতে অন্য বস্তুর জ্ঞান।
প্রকৃতি -
এই শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল প্ৰ-করোতি বা প্রকৃষ্ট কারণ। তার স্বরূপ হল সত্ত্বঃ, রজঃ ও তম গুনের সাম্যাবস্থা ( সৃষ্টির প্রারম্ভের সাম্যাবস্থা )।
অহংতত্ত্ব -
পুরুষ অর্থাৎ চৈতন্য বা আত্মা যখন প্রকৃতির সাথে মিলিত হয় তখন জন্ম হয় অহংকারের। আবার যখন উভয়েই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন মানুষের মুক্তি হয়, আর তখনি প্রকৃতি পূর্বেকার অবস্থা অর্থাৎ সত্বঃ,রজঃ ও তমর সাম্যাবস্থায় ফিরে যায়।
ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ববোধ সব অনর্থের কারণ। এই অহংবোধই আমাকে অপরজনের থেকে পৃথক এই ভাবনাটা ভাবাতে শেখায়। আবার এই বোধই মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়,হিংসা বা দ্বেষের জন্ম দেয়, দুঃখের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, অযাচিতভাবে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ করায় নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য। এসবের ভিতর থেকে অতৃপ্ত ইচ্ছার সূত্রপাত হয় এবং তার থেকে মানুষ এক নৈরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে পড়ে।
নৈরাজ্য একটা সামাজিক বিপর্যয়। অহংকে মান্যতা দিতে গিয়ে মানুষ বিশেষ কোন ব্যক্তির বা সংগঠনের আদর্শকে অনুসরণ করে বা নিজেকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে আর সেই পথে এগোতে গিয়ে সে যে কোন নৈতিকতা বা সামাজিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে কুন্ঠাবোধ করে না।
(সংযোজন- মুসোলিনি থেকে শুরু করে আজকের দেশ নায়করা এই ব্যাধিতে কমবেশী আক্রান্ত - এটি পরবর্তী কোন ব্লগে লেখা যাবে )
রাজামশাই একটু বাধা দিয়ে ঋষির কাছ থাকে জানতে চান- কে এই অহংবোধকে ধংস করতে পারে ? এই প্রসঙ্গে ঋষিবর বলেন, এটা একটা গম্ভীর প্রশ্ন , আমি এককথায় বলছি, অজ্ঞান থেকে অহংয়ের জন্ম। তাই জ্ঞানই একমাত্র পথ যে পুরুষ বা চৈতন্যর সাথে প্রকৃতির মিলনকে ধংস করতে পারে এবং এই ধ্বংসের সাথে সাথে অহংয়ের অস্তিত্বের বিসর্জন অনিবার্য হয়।
রাজমশাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন পুরুষ বা আত্মার স্বভাব কি ? ঋষিবর বললেন পুরুষের স্বভাব হচ্ছে নিঃসঙ্গ, তা না হলেতো পুরুষ প্রাণী হয়ে যাবে। প্রাণী আর আত্মা কখনই এক নয়। পুরুষ নিষ্ক্রিয় এবং নির্গুণ। পুরুষ যদি নিষ্ক্রিয় বা নির্গুণ না হয় তাহলে সেতো বস্তু পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাবে আর বস্তু কখন আত্মা হতে পারেনা। (এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পরে হবে )
ক্ৰমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৩ তম অধ্যায় (১২৯)
Searching for hidden Truth (৩২)
মন্তব্যসমূহ