(১৪০) অহংকারের রসায়ন (৫ম পর্ব )

  (১৪০)    অহংকারের রসায়ন (৫ম পর্ব )

সংক্ষেপে - 
১ম সংখ্যা - অহংকারের মুখোমুখি -সংসার কাকে বলে -বাহ্য এবং অন্ত প্রকৃতির সাথে ইন্দ্রিয় কি ভাবে সেতু বন্ধন করে ও তার প্রতিক্রিয়া - বিশ্ব জগৎ গঠনের পাঁচটি উপাদানের সাথে পরিচয় -সাংখ্য দর্শনের আলোকে অহংকার -সত্বঃ রজঃ ও তম -পরমাণু -তন্মাত্র।
২য় সংখ্যা - বুদ্ধির কর্ম - ভোগ কি - বুদ্ধির উপর অহংকারের প্রভাবে কি হয়। 
৩য় সংখ্যা - জগৎ সৃষ্টির রহস্য -পঞ্চভূত -প্রকৃতি -অহংতত্ত্ব -অহংবোধের ধংস - পুরুষ বা আত্মার স্বভাব।  
৪র্থ  সংখ্যা -  কপিল মুনি-পুরুষার্থঃ - ত্রয়ী দূঃখ 
৪র্থ  সংখ্যার পর। ...

অনুভূতি 

     অপরাহ্নে খোলা জানালার ধারে  বসে সুদূরের  বনানীর দিকে তাকিয়ে রাজামশাই ফেলে আসা দিনগুলির কথা ভাবতে লাগলেন। সেদিনও, রাজপ্রাসাদে প্রাকৃতিক অনুশাসন মেনে যেমন সকালকে আলবিদা জানিয়ে  দিয়ে দুপুর গড়িয়ে আসতো ,  কৈ! আজকের মতো প্রকৃতিতে এতো যে সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে, তখন তো সেটা মনে হয়নি।  আসলে , রাজপ্রাসাদে অবসর থাকলেও মনের  প্রত্যেকটি দরজা অতন্দ্র প্রহরীরা আগলে রাখতো, যেন কোন অবস্থ্যায়  'ভোগের' রাজত্বে 'ত্যাগের' অনুপ্রবেশ না ঘটে। 

        প্রাসাদের অলিন্দে  চতুর্বর্গ পুরুষার্থের  মধ্যে অর্থ আর কাম পরস্পর হাত ধরে ঘুরে বেড়াত। ভীষণভাবে  তারা  নজর রাখতো যেন কোন অবস্থায় তাদের  একছত্র আধিপত্যে কোন রকমের বাধা না আসে। তাই তারা যদিও উপরের  মাঝে মাঝে 'ধর্ম'কে   আসতে দিতো , কিন্তু মোক্ষ  ছিল সুদূরপরাহত। 'মনের' রাজত্বে একছত্র অধিপতি 'কাম' আর তার পরিষদ 'ভোগ', দেহ সুখ, ইচ্ছা প্রভৃতিরা যারপরনাই ক্ষমতা দখল করে থাকতো। ইন্দ্রিয়ের ইচ্ছা পূরণের মুহুর্মুহ চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে বুদ্ধিকে  এতই ব্যস্ত থাকতো যে, অন্যদিকে তাকাবার  ফুসরত মিলতো না।  

সীমাবদ্ধতা 

        সত্যিই সংসারী মানুষের দৃষ্টি নাভি পর্যন্তই  সীমাবদ্ধ বা তার নিচেই  আবদ্ধ থাকতো।   উপর দিকে যাবার একটা রাস্তা আছে, সেই পথটা কেউ  তাকে চিনিয়ে দেয়নি। তাই স্বভাবতই, সেটা তার অজানাই ছিল।  পথভ্রষ্ট পথিক  যদিবা পথ হারিয়ে উপরে উঠতে যেত তখন  মনের দ্বারের অতন্দ্র প্রহরীরা তাকে  উপরে  উঠতে না দিয়ে , উল্টে উপদেশ দিতো, যত নিচে যেতে পারো যাও সেখানে মন তোমাকে  পূর্ণ সহযোগিতার  হাত বাড়িয়ে দেবে, কোন চিন্তা নেই । তাই নিয়ে এতদিন  পূর্ণতা আর অপূর্ণতার দোলাচলে মানুষ সুখী হবার চেষ্টা করে এসেছেন । দুঃখী হলে সেটা অদৃস্ট নামক এক অদৃশ্য শক্তির দোহাই  পেড়ে  নিজেকে সান্ত্বনা দেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে , আবার সুখী হলে নিজের কৃতকর্মের প্রতি গর্বিত হয়েছে ।  এইভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী মানব সভ্যতা এগিয়ে চলছে।  

        আজ যখন  আশ্রমের এই পরিবেশে এসে 'অর্থ' আর 'কাম' সুদীর্ঘ ছুটি নিয়ে মনের রাজত্ব থেকে বিদায় নিয়েছে। মনের উপর পরে থাকা এতো দিনের জঞ্জাল ধৌতিকরনের  প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কেননা, সেখানে মনের নতুন রাজার অভিষেক হবে। সেই কারনেই রাজামশায়ের দৃষ্টির পুনর্জন্ম হয়েছে, দীর্ঘদিনের  ক্যাটারার সরে গিয়ে। অহংকারও এক ক্যাটারার বা ছানি সেটা বুদ্ধির উপর থেকে সরে গেলে দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়।  

স্থায়ী পরিবর্তনের শর্ত 

         মনের সিংহাসন কখন শূন্য থাকেনা।  সেই শূন্য রাজত্বে  নতুন রাজা 'ধর্ম' গুটিগুটি পায়ে মনের ফাঁকা জায়গাটার দখল নিয়ে  নিচ্ছে। এই গোটা ব্যাপারটার সাথে যোগ্য সংগত করছে ইন্দ্রিয়রা । কি অদ্ভুত ! সেদিন যেই ইন্দ্রিয়রা খুঁজে খুঁজে ভোগের সামগ্রী এনে মনকে যোগান দিত , তারা আজ ভাবি রাজার মনোভাব বুঝতে পেরে নিজেদের একদম সংযত করে রেখেছে। রাজামশাই তাই আজ ভাবছেন , যে কোনো পরিবর্তনের পিছনে সর্ব প্রথম মানসিক প্রস্তুতি থাকার প্রয়োজন।  এই মানসিক প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা থেকে উদ্ভূত জ্ঞানের। প্রথমে ব্যক্তি তার সাথে সাথে সমাজে  জ্ঞানের বিকাশে  ও তার প্রতিনিয়ত চর্চায় মানুষকে  দীর্ঘদিনের অশুভ  বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে। আধ্যাতিক পথই একমাত্র মানুষের মুক্তি বা মোক্ষের দিকে নিয়ে যাবার সোপান।  সমাজজীবনের অন্যান্য উপকরণ, যেমন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ধর্মীয় নিয়মেই চলবে। কেননা, সমাজ যাকে অবলম্বন বা চারণ করে, তাকেই তো ধর্ম বলে। 

  স্বর্গীয় উপলদ্ধি 

         সেদিনের স্বেচ্ছাচারী ইন্দ্রিয়েরা, যারা আজ সময়ের  সাথে সাথে  ভীষণ পরিশীলিত হয়ে উঠেছে।   তাই দৃষ্টির সামনের পর্দা অপসারিত।  তাই , রাজামশাই খোলা জানালা দিয়ে দৃষ্টি বিস্তার করে আজ প্রকৃতির রাজত্বে পতঙ্গদের লীলার সাথে কখন যেন নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিলেন, তা নিজেই জানেন না। যেখানে তার দৃষ্টি পড়ছে সেখানেই যেন চপল প্রকৃতি তার অপার আনন্দ বিতরণ করছে। সেই খেলার সাথী হয়ে অনাবিল আনন্দের সেই-ই ভাগিদার হতে পারবেন যার চোখের উপর থেকে আচ্ছাদনটা  সরে গেছে। তিনি দেখছেন,  গাছের পাতারা বাতাসের আগমনে একে অন্যের গায়ে যেন হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে , আবার সচেতনভাবে আগের জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে।  মৌমাছি তার জাগতিক আহবান কে মান্যতা দিয়ে এক  ফুল থেকে অন্য  ফুলে নেচে নেচে উড়ে  বেড়াচ্ছে আর রেনু থেকে মধু আহরণ করে  তৃপ্ত হচ্ছে। তাদের আত্মতৃপ্তির স্ফূরণ হচ্ছে তাদের ছোটছোট পাখনার সঞ্চালনের আস্ফালনের মধ্যে দিয়ে।  ফুল-পাতাগুলির মধ্যে কেওবা  ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আকাশের সাথে সখ্যতা পাতানোর চেষ্টা করছে আবার অন্য দল  আকাশের বিশালতার দিকে তাকিয়ে, নিজেদের অজান্তেই  মাথা নিচু করে  বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছে  । 


কুয়োর ব্যাঙ 

        প্রকৃতির পরম্পরায় কখন ব্যাঘাত ঘটেনি কিন্তু রাজামশাইয়ের দৃষ্টি ইন্দ্রিয় সেখানে কোনদিন নিবদ্ধ হয়নি, কারণটি  তিনি আজ বুঝতে পারছেন, কেননা, সেদিন  মনের সিলেবাসে সেটা ছিল না তাই দৃষ্টির কাজের মধ্যে সেটা পড়েনি । কিন্তু আজ এই  পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব দেখে রাজমশাইয়ের হৃদয়ে এক স্বর্গীয় অনাস্বাদিত আনন্দে ভরে উঠেছে। তিনি ভাবছেন, রাজপ্রাসাদটা সেদিন ছিল তাঁর অতলান্তিক বিশ্ব, আজ তিনি  সেই ঘেরাটোপের জলাশয় থেকে অগাধ সমুদ্রে এসে  পড়েছেন , এখন মনে হচ্ছে বাস্তবে তার রাজ্য আর রাজপ্রাসাদটা একটা কুয়ো  আর তিনি সেই কুয়োর ব্যাঙ  ভিন্ন আর  কিছুই ছিলেন না।  

          

 ক্ৰমশঃ   

ব্লগার -রবীন মজুমদার

মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৫ তম  অধ্যায় (১৩২)

Searching for hidden Truth (৩৫) 

 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২১০ ) ঝড়-বৃষ্টির একাল সেকাল