(১৪১) অহংকারের রসায়ন (ষষ্ঠ পর্ব )
(১৪১) অহংকারের রসায়ন (ষষ্ঠ পর্ব )
১ম সংখ্যা - অহংকারের মুখোমুখি -সংসার কাকে বলে -বাহ্য এবং অন্ত প্রকৃতির সাথে ইন্দ্রিয় কি ভাবে সেতু বন্ধন করে ও তার প্রতিক্রিয়া - বিশ্ব জগৎ গঠনের পাঁচটি উপাদানের সাথে পরিচয় -সাংখ্য দর্শনের আলোকে অহংকার -সত্বঃ রজঃ ও তম -পরমাণু -তন্মাত্র।
২য় সংখ্যা - বুদ্ধির কর্ম - ভোগ কি - বুদ্ধির উপর অহংকারের প্রভাবে কি হয়।
৩য় সংখ্যা - জগৎ সৃষ্টির রহস্য -পঞ্চভূত -প্রকৃতি -অহংতত্ত্ব -অহংবোধের ধংস - পুরুষ বা আত্মার স্বভাব।
৪র্থ সংখ্যা - কপিল মুনি-পুরুষার্থঃ - ত্রয়ী দূঃখ
৫ম সংখ্যা - অনুভূতি - সীমাবদ্ধতা -স্থায়ী পরিবর্তনের স্বত্ত্ব -স্বর্গীয় উপলদ্ধি -কুয়োর ব্যাঙ
৫ম সংখ্যার পর। ...
রাজামশাই নিজের সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছেন যে, মুক্ত আকাশের নিচে ঋষিবর অধীর আগ্রহে তার ছাত্রের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনিচ্ছাকৃত দেরি হবার কারনে ঋষিবরের কাছে মার্জনা চেয়ে নিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। মৃদু হাস্যে নবীন ছাত্রকে ঋষিবর আন্তরিকভাবে বরণ করে নিলেন।
বস্তুর দ্বান্দ্বিক চরিত্র
ঋষিবর শুরুতে বললেন, এই আলোচনাটি বার বার ঘুরে ফিরে আসবে তা হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতিতে সাম্যাবস্থায় তারা থাকত এবং সৃষ্টি পরবর্তী সময়ে তাদের চরিত্রের পরিবর্তনে মানুষের উপর কি ভাবে সেই প্রভাব প্রতিফলিত হয়, সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু । উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পুরুষ বা চৈতন্য ছাড়া প্রকৃতি কিছুই করতে পারেনা। প্রকৃতির অন্দরে এই তিন পরস্পরবিরোধী উপাদানগুলি সৃষ্টির প্রারম্ভে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। প্রকৃতি যেন ঘুমন্ত এক রাজকন্যা আর যেই না পুরুষের সোনার কাঠির পরশ পেলো , সঙ্গে সঙ্গে রাজকন্যা গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠলো। ঐ জেগে ওঠাটাই যেন সৃষ্টি। দুয়ারে অতন্দ্র প্রহরী সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ , অচিরেই প্রকাশমান হতে শুরু করলো। তাদের ভান্ডার থেকে কোনরকম প্রথাগত মাপ ছাড়াই দুই হাতে সুখ, দুঃখ, মোহ ও অন্যান্য রিপুকে রাজকন্যার আঁচলে বেশ শক্ত করে বেঁধে দিল। শুরু হয়ে গেল তাদের বাঁধন ছেড়ার গান। শুধুই চঞ্চলতা। সত্ব যেখানে সদাই সূক্ষতাকে প্রকাশ করে , সেখানে রজঃগুন দেয় উত্তেজনা আর চঞ্চলতা আর তমঃ গুণ, সে তো প্রকাশের সবদ্বার বন্ধ করতে উদ্যত হয়ে আহবান করে অন্ধকারকে।
বস্তু জগতে এই ভালো মন্দের সংঘাতের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি তার কাজকে নিরন্তর চালিয়ে নিয়ে যায়। চূড়ান্ত ভালো বলে কিছুই যেমন হয়না, ঠিক তেমনি চূড়ান্ত খারাপ বলে কিছুই হয়না। একটা জিনিস ভীষণ লক্ষণীয় যে , প্রকৃতিই একমাত্র এই তিন গুণ সম্পন্ন কিন্তু পুরুষ বা চৈতন্য কিন্তু অপরিবর্তনীয় ও স্থির। যে জগৎকে মানুষ দেখে ও অনুভব করে তা হলো জড় ও চৈতন্য নামক দুই বস্তুকে। এই দুইয়ের ধর্ম ও বিপরীত। বৈচিত্রের মধ্যে একতা যেমন সত্য, বস্তু জগত দন্দ্বের মাধ্যমে সৃষ্টি , এটাও সত্য।
প্রকৃতিতে কি আছে -
প্রকৃতিতে দুটি বিরোধী ভাবের সহাবস্থান আহে। সাংখ্য দর্শনের মতে প্রকৃতি থেকে মহত্তত্ব ; বুদ্ধি ও অহংকারের উৎপত্তি হয় এই মহৎ থেকে। ( একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা সাধারণ অর্থে দাম্ভিকতাকে অহংকার বলে জানি, কিন্তু দর্শনে অহংকার মানে শরীর বা দেহ ) এই অহংকারের দুইটি ভাব । একটি সাত্বিক ভাব ; অন্যটি তামসিক ভাব। অহংকারের সাত্বিক যে অংশটি আছে, সেখান থেকে পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রীয় ও মন এবং পাচঁটি কর্ম্মেন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। অহংকাররের তামসিক ভাব থেকে পঞ্চ তন্মাত্রা ( শব্দ, স্পর্শ ,রূপ , রস ও গন্ধ অর্থাৎ যেসব ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মানুষ বাইরের জগৎ থেকে সংবাদ গ্রহণ করে ) এবং সেখান থেকে সৃষ্টি হয় পঞ্চ মহাভূত(বস্তু জগৎ) । তারা যথাক্রমে, ক্ষিতি , জল, তেজ , বায়ু ও আকাশ।
রাজন! খুব সহজ ভাবে বুঝবার চেষ্টা করুন কি ভাবে মানুষ একটা আবর্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে বা অন্যভাবে বলাযায়, প্রকৃতি তার রসদ দিয়ে মানুষকে মোহাবিষ্ট করে দিচ্ছে।
১) শব্দ, স্পর্শ ,রূপ , রস ও গন্ধ এই পঞ্চ তন্মাত্রা বাইরের জগৎ থেকে সংবাদ প্রেরণ করছে।
২) পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রীয় (চোখ, কান, নাক, জিহবা, ত্বক ) অনুভব করছে মনের সাহায্যে। মন শুধু একা একা থাকে না তার সাথে আছে অহংকার আর বুদ্ধি। বুদ্ধি বিচার বিশ্লেষন করে পাচঁটি কর্ম্মেন্দ্রিয়ের মধ্যে যথাযথ ভাবে তাদের কাজকে পরিবেশন করে দিচ্ছে।
৩) এর থেকে কি উৎপত্তি হচ্ছে ?
উত্তর -তা হচ্ছে কর্ম্মফল।
৪) কর্মফলের গুনাগুন কার উপর নির্ভর শীল ?
উত্তর- বুদ্ধির বিশ্লেষণের যথাযথ দক্ষতার উপর অর্থাৎ যদি সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে তাহলে সঠিক ফল আর না করতে পারলে সবটাই বিফল।
৫) বুদ্ধির সঠিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কার ভূমিকা সব থেকে বড় ?
উত্তর- অহংকার মুক্ত বুদ্ধির ।
৬) কি ভাবে বুদ্ধি অহংকার মুক্ত হতে পারে ?
উত্তর - জ্ঞানের আলোকে।
প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ যখন পুনরায় চৈতন্যের হাত ধরে সাম্যাবস্থায় ফিরে আসবে , তখনিই মানুষের দুঃখ দূর হবে।
চৈতন্যই একমাত্র মুক্তির সোপান
হে রাজন ! ভীষন লক্ষ্য করে দেখুন , মানুষ কোনটা দেখবে সেটা নির্ভর করছে ব্যক্তি মানুষের বিবেচনার উপর। আবার বিবেচনা নির্ভর করছে বুদ্ধির উপর, আবার বুদ্ধির নির্ভর করছে চেতনার উপর, চেতনা নির্ভর করছে যে ব্যক্তি বিশেষের জ্ঞানের উপর। মায়া স্বরূপ মিথ্যা অহংকারের মেঘের ছায়া এই বুদ্ধিকে চৈতন্যর কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে আর চৈতন্য ছাড়া বুদ্ধি অসহায়। সেই সুযোগে অর্থ ও কাম মানুষের মনের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে ধর্ম ও মোক্ষকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এখানে পুরুষার্থঃ একটি শব্দবন্ধে পরিণত হয়ে রয়েছে। মায়া একটি ভ্রম মাত্র। ('মায়া ' সম্পর্কে পরে আলোচনা করা যাবে) যতক্ষন পর্যন্ত মানুষ নিজের স্বরূপকে জানতে না পারবে ততক্ষন পর্যন্ত সে এই মিথ্যার বেড়াজালে অনবরত ঘুরপাক খাবে।
বি: দ্রঃ ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও কমেন্ট করুন'
ক্ৰমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৫ তম অধ্যায় (১৩২)
Searching for hidden Truth (৩৫)
মন্তব্যসমূহ