(১৪৩) অহংকারের রসায়ন (সপ্তম পর্ব)
(১৪৩) অহংকারের রসায়ন (সপ্তম পর্ব)
সংক্ষেপে -
১ম সংখ্যা - অহংকারের মুখোমুখি -সংসার কাকে বলে -বাহ্য এবং অন্ত প্রকৃতির সাথে ইন্দ্রিয় কি ভাবে সেতু বন্ধন করে ও তার প্রতিক্রিয়া - বিশ্ব জগৎ গঠনের পাঁচটি উপাদানের সাথে পরিচয় -সাংখ্য দর্শনের আলোকে অহংকার -সত্বঃ রজঃ ও তম -পরমাণু -তন্মাত্র।
২য় সংখ্যা - বুদ্ধির কর্ম - ভোগ কি - বুদ্ধির উপর অহংকারের প্রভাবে কি হয়।
৩য় সংখ্যা - জগৎ সৃষ্টির রহস্য -পঞ্চভূত -প্রকৃতি -অহংতত্ত্ব -অহংবোধের ধংস - পুরুষ বা আত্মার স্বভাব।
৪র্থ সংখ্যা - কপিল মুনি-পুরুষার্থঃ - ত্রয়ী দূঃখ
৫ম সংখ্যা - অনুভূতি - সীমাবদ্ধতা -স্থায়ী পরিবর্তনের স্বত্ত্ব -স্বর্গীয় উপলদ্ধি -কুয়োর ব্যাঙ
৬ তম সংখ্যা - বস্তুর দ্বান্দ্বিক চরিত্র-প্ৰকৃতিতে কি আছে -চৈতন্যই একমাত্র মুক্তির সোপান
ষষ্ঠ সংখ্যার পর। ...
নৈস্বর্গিক
রাত প্রায় আড়াইটা, রাজামশাইয়ের ঘুম আজকে হঠাৎই অসময়ে ভেঙ্গে গেলো। জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে তিনি কখন যেন প্রকৃতির রাজ্যে প্রবেশ করেছেন, তা নিজেই জানেন না। তিনি অবলোকন করতে লাগলেন , আকাশে মেঘেদের অক্লান্ত আনাগোনা , তবে জোছনার বিরামহীনভাবে আলোক বিচ্ছুরণেরও অবসর নেই। এই মহাবৈচিত্রময় প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে কখন যে রাজামশায়ের মনের দরজার জমে থাকা জং গুলি একে একে খসে পরে হৃদয়ের সব অলিন্দের দরজাগুলো প্রশস্ত আকারে বেরিয়ে এসে মুক্ত আকাশের পানে নিজেকে মেলে ধরে তার আকারকে নিরাকার করে দিয়ে বিশ্ব অস্ত্বিতের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। এ যেন অন্তরের সাথে আরেক অন্তরের মিলনের তরঙ্গের প্রবাহ, যার আদি- অন্ত কিছুই নেই।
প্রকৃতি ও মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক
অবশ্য প্রকৃতির যে নিজস্ব একটা রাজ্য আছে, সেটা পূর্বে তার গোচরে আসেনি। রিপুর দংশনে সে সময়ে প্রকৃতির সাথে দাম্পত্য সম্পর্কটা গড়ে উঠেনি। কেননা প্রেম, আবেগকে ভাঙতে পারেন নি, যে খানিকটা প্রকৃতিকে দিয়ে বাকিটা ঘরের জন্য রেখে দেবেন। অবশ্য স্বাদগন্ধহীন গৃহে প্রকৃতির কাছ থেকে ধার করা গন্ধ দিয়ে ভরিয়ে দেবার বর্ষ প্রাচীন অভ্যাসে সংসারী মানুষ অভ্যস্ত ছিলেন। বাসনার সাথে অবিচ্ছেদ্য বাঁধনের ফাঁসে সংসারী মানুষ রক্তাত্ত হলেও দিনের শেষে আবার সেখানেই ফিরেই আসে। শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এই সারবত্তা বুঝে সেই কাঁটাতারের বেড়াকে ভেঙ্গে ক্লান্ত মানুষের শান্তির বাতাবরণ খুঁজে এনে বারংবার সাজিয়ে দিয়েছে। সেই স্বর কারুর কর্নকুহরে পৌঁছেছে কিন্ত বাস্তবে বহুলাংশে পৌঁছায়নি। আদতে এত প্রশ্ন রাজামশাইয়ের মাথায় আসতো না, যদি না আজ সমগ্র দেশ সাত সমুদ্রের পাড়ের একদল বণিক কবে যে এই দেশের আকাশে বাতাসে তাদের সর্বগ্রাসী অধিকার কায়েম করে বসে আছে, সেই দংশনেই রাজামশাই কাতর।
ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া
যৌবন মানব সভ্যতাকে দিশা দেখায় ; আজ সেই দিশা গভীর নিশায় নিমজ্জ্মান শুধু মাত্র আলোর অভাবে। যখন কোন আলোর পথযাত্রী সেই আলোর মশাল নিয়ে অন্ধকারকে দূর করতে ব্রতী হয়েছেন কিন্তু ধারবাহিকভাবে সেই আলোকে প্রজ্জ্বলিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানীবাহী অনুসরণকারীর অভাবে এবং অন্ধকারের পূজারীদের ঝড়ো হাওয়ায় সেই আলো সাময়িকভাবে নির্বাপিত হয়েছে।
নিশানা
অন্তরে আজ তীব্র আলোর রোশনাই। সেই পথ ধরে আলোর উৎসের সন্ধানে রাজামশাইয়ের যাত্রা শুরু হল। মনে পরে , যখন খুব ছোট বেলায়, পিতার হাতধরে তিনি দেখতে যেতেন , দুর্গগা পূজার আগে তখন নাট মন্দিরে ভাস্কর এসে ঠাকুরের প্রতিমূর্তি বানাতেন। একদল মাটির তাল ভাস্করের হাতে পরে কখন যে এক পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে সৃষ্টির বাহক হয়ে মা দুর্গগা আমাদের সামনে আবির্ভূত হতেন। তখন নিজেদের জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে তার প্রতি অর্ঘ নিবেদিত হতো। মা দুর্গগাকে নৈবিদ্য দেবার অর্থ হচ্ছে তার আদর্শে অর্থাৎ এই জগতে অন্যায়ের সাথে লড়াই করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা। আজ এই আশ্রমে এসে অনুভূত হচ্ছে, যে উদ্দেশ্যকে নিয়ে পৌরাণিক গল্পের আঁধারে একদিন মানুষ নিষ্ঠা সহকারে দেবীর উদ্দেশ্যে নৈবিদ্য সাজাতো, তা আজ একটা অন্তঃসার শূন্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অভ্যর্থনার চাকচিক্যের আড়ালে প্রার্থনা ঢেকে গেছে, মন্ত্রকে সরিয়ে যান্ত্রিক সভ্যতা পাখা মেলে গ্রাস করতে উদ্যত।
শিক্ষাঙ্গন কাকে বলে
ঋষিবরের এই আশ্রম শুধু মাত্র এক নিছক ছাত্রদের আবাস বা সেই অর্থে সেই ছোটবেলার নাটমন্দির নয়, যেখানে শুধু নিরাকরকে আকার দিয়ে কাজ শেষ করা হয়। এখানে আকার কি করে নিরাকার হয়, আর তার সাথে বিশ্বের প্রতিটি কণার যোগসূত্রটাই বা কি? সেই আঁধারেই শিক্ষা দান। প্রচলিত শিক্ষার মন্দির নয় , এযেন একটা সত্যিকারের প্রাক - রণভূমি বা যুদ্ধের অনুশীলন কেন্দ্র, যেখানে যতটা সেই ছাত্রদের আগামী দিনের সন্যাসী হবার মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়, তার থেকে অনেক বেশি সৈনিক হিসাবে তৈরী করা হয়। সময়কালটা পাঠকের কাছে উদ্ধৃত না করলে অসম্পূর্ন থেকে যাবে। এই ঘটনাকাল ভারতবর্ষে সিপাই বিদ্রোহের পরবর্তী সময়।
রাজামশাইয়ের কাছে 'সৈনিক' কথাটি অনেক বেশি বাস্তবোচিত মনে হল এই কারণে , কেননা মানুষের জ্ঞানের উন্মেষ হওয়ার সাথে সাথে মুখোশ পরা বন্ধু রুপী শত্রুদের চিহ্নিত করতে শেখে যারা মনের অভ্যন্তরে বাস করে এবং তার সাথে প্রতিনিয়ত জাগরনে, শয়নে এবং স্বপনে সংগ্রাম করে পরাস্ত করতে হয়। এই বিরামহীন যুদ্ধে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য যে গভীর শাসনে নিজেদের ইন্দ্রিয়দের পরাস্ত করতে হয় সেটি এই আশ্রমে না আসলে বোঝা যেতো না। স্বাধীনতার নবতম ব্যাখ্যা যেন ঋষিবর শেখালেন। রাজনৈতিক পরাধীনতার থেকে কোন অংশে ছোট নয় নিজের স্থূল ইচ্ছা বা কামনার কাছে নিজের পরাধীনতা স্বীকার করা এবং তার ইচ্ছায় চালিত হওয়া । নিজেদের অজান্তে বার বার পার্থিব বস্তুকে লাভ করার জন্য অর্জিত বস্তুকে পাবার প্রবণতার কাছে কতবার যে 'দাস' হয়ে তার ইচ্ছাধীন হয়ে নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বস্তুত নিজেদের অজান্তে বারবার এই কামনা, বাসনা, লোভের দাস হয়ে হন্যে হয়ে সংসার নামক পাকের আবর্তে দীর্ঘ দিন রাজামশাই অতিবাহিত করেছিলেন। আজ যখন ঝরা পাতার মতো সেই শ্রান্ত পাতা গুলি ঝরে পরে নতুন আশ্বাসে নব নব আনন্দ পত্র প্রস্ফুটিত হচ্ছে হৃদয়ের মন্দিরে , সেই মন্দিরের শঙ্খধ্বনির শব্দ অনুরণিত হচ্ছে সেদিনের রাজামশাই বা আজকের সৈনিকের অণুতে অণুতে তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।
আশ্রমের শঙ্খধ্বনির শব্দ ঘোষণা করল আজকের প্রভাতের প্রাবন্ধিক সূচনার। রাজামশাই ধীরে ধীরে তার নিজের জগৎ থেকে নেমে এলেন বাস্তবের মাটিতে। দলবদ্ধভাবে সবাই এগিয়ে চললেন প্রার্থনাসভার অঙ্গনে।
ক্ৰমশঃ
বি: দ্রঃ ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও কমেন্ট করুন'
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৭ তম অধ্যায় (১৩৪)
Searching for hidden Truth (৩৮)
মন্তব্যসমূহ