(১৪৪) অহংকারের রসায়ন (অষ্টম পর্ব)
(১৪৪) অহংকারের রসায়ন (অষ্টম পর্ব)
১ম সংখ্যা - অহংকারের মুখোমুখি -সংসার কাকে বলে -বাহ্য এবং অন্ত প্রকৃতির সাথে ইন্দ্রিয় কি ভাবে সেতু বন্ধন করে ও তার প্রতিক্রিয়া - বিশ্ব জগৎ গঠনের পাঁচটি উপাদানের সাথে পরিচয় -সাংখ্য দর্শনের আলোকে অহংকার -সত্বঃ রজঃ ও তম -পরমাণু -তন্মাত্র।
২য় সংখ্যা - বুদ্ধির কর্ম - ভোগ কি - বুদ্ধির উপর অহংকারের প্রভাবে কি হয়।
৩য় সংখ্যা - জগৎ সৃষ্টির রহস্য -পঞ্চভূত -প্রকৃতি -অহংতত্ত্ব -অহংবোধের ধংস - পুরুষ বা আত্মার স্বভাব।
৪র্থ সংখ্যা - কপিল মুনি-পুরুষার্থঃ - ত্রয়ী দূঃখ
৫ম সংখ্যা - অনুভূতি - সীমাবদ্ধতা -স্থায়ী পরিবর্তনের স্বত্ত্ব -স্বর্গীয় উপলদ্ধি -কুয়োর ব্যাঙ
৬ তম সংখ্যা - বস্তুর দ্বান্দ্বিক চরিত্র-প্ৰকৃতিতে কি আছে -চৈতন্যই একমাত্র মুক্তির সোপান
সপ্তম সংখ্যা - নৈস্বর্গিক - প্রকৃতি ও মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক -ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া -নিশানা -শিক্ষাঙ্গন কাকে বলে
সপ্তম সংখ্যার পর। ...
অভিমুখ
প্রার্থনা গৃহ থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে আটচালা ঘরে গিয়ে ভিজা মুড়ি আর গুড় দিয়ে প্রাতরাশ গ্রহণ করে ছাতিম গাছের তলায় এসে সমবেত হলো। এই গাছের তলায় দিনের বেলায় ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করে। ম্যালেরিয়াকে প্রতিহত করতে এই গাছের বিশেষ ভূমিকা আছে। এই রকম বহু ঔষধি গাছ আশ্রমের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এখানে আবাসিক ছাত্রদের প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত একবার অনতিদূরের পল্লীগুলিতে গিয়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য , সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিবিধ খবর সংগ্রহ করা এবং পরিষেবা সংক্রান্ত বিবরণ আচার্যকে দিতে হতো, সেই অনুযায়ী আশ্রম যথাসাধ্য তাদের সহযোগিতা করতেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গ্রামের মানুষের আর্থিক উন্নয়নের জন্য সমবায় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং তার নেতৃত্ব দিয়েছিল এই আশ্রম। তাছাড়া, এই আশ্রমের পরিচালনাধীন আরো বেশ কিছু সহযোগী আশ্রম এই বাংলা দেশকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আশ্রমের এক পরম্পরা আছে ; আজকের প্রজন্মের ছাত্রদের মধ্যে থেকে আগামী দিনের আচার্য্যদের মনোনীত করা হতো । মনোনয়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতাই হচ্ছে তার একমাত্র মাপকাঠি । আচার্যের প্রবেশে রাজামশাইয়ের চিন্তা সূত্র ব্যাহত হল।
চিত্ত ও তার গঠন
এখানে পড়ানোর রীতি নীতি গুলিই আলাদা। শুধু মাত্র কর্ণ নামক ইন্দ্রিয়ের উপর পড়া আত্মস্থ করার দায়িত্ব অর্পণ করে আচার্য্য মশাই ক্ষান্ত হননা। তার সাথে চক্ষু ইন্দ্রিয়কে যোগ্য সংগত না করলে বিষয়বস্তু স্মৃতির আলমারীতে সংক্রামিত হয়না, এটাই ওনার বিশ্বাস। ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তিই মনোসংযোগের কারণ। তাই তিনি একই সাথে দুইটি ইন্দ্রিয়কে সুচারুরূপে ব্যবহার করেন, ছাত্রদের বিদ্যাভাসের ক্ষেত্রে। তিনি এসে সব ছাত্রকে নিয়ে দীঘির অভিমুখে নিয়ে চললেন । সারা বছর আশ্রমের মাছ এই দীঘিই সরবরাহ করে থাকে। আশ্রমের পরম্পরা অনুযায়ী খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাচবিচার নেই, পুষ্টিকর কিনা, সেটাই একমাত্র মাপকাঠি। শীতের পূর্বরাগ , যদিও উত্তরের বাতাস আজ অনুপস্থিত। দীঘির জলের কোন হেলদোল নেই। আচার্য্য, ছোট্ট একটি প্রস্তর খন্ড তুলে নিয়ে এসে দীঘির জলে ছুড়ে মারলেন আর ছাত্রদের বললেন, প্রস্তর খন্ড নিক্ষেপ আর জলের তরঙ্গ ওঠার হবার মধ্যে যে কার্য্য ও তার কারণ এবং কি তার প্রতিক্রিয়া - সেই সম্পর্কিত আলোচনাই আজকের বিষয়বস্তু।
বেদান্তের দর্শন অনুযায়ী মানুষের চিত্তের গঠন প্রনালী নিয়ে তিনি এবার বলতে শুরু করলেন। মূলতঃ তিনটি উপাদানের সংমিশ্রনে চিত্ত গঠিত হয়। তাদেরকে সম্বোধিত করা হয় , মন, বুদ্ধি ও অহংকার নামে। মন হচ্ছে প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি জড় তাই মন ও জড় সম্প্রদায়ভুক্ত।( প্রকৃতিকে কেন জড় বলা হয় তা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করা যাবে ) জড়র বিশেষত্বঃ হল, তার নিজস্ব কোন ক্রিয়া নেই । এই মুহূর্তে যা প্রতক্ষ্য হল যে, এক খন্ড পাথরের টুকরো দীঘির নিস্তরঙ্গ জলের উপর পড়ে জলকে তরঙ্গায়িত করে তুললো। ঠিক তেমনি, মানুষের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গৃহীত প্রস্তর খন্ড স্বরূপ সংবাদ বা বস্তু নিস্তরঙ্গ জড় দীঘি স্বরূপ চিত্তের প্রথম অংশ অর্থাৎ মনে এসে প্রবেশ করে মনকে তরঙ্গায়িত করে তোলে । এখানে প্রশ্ন হল, তাহলে, জল আর তরঙ্গ কি আলাদা কোন বস্তু ?
চিত্তের ক্রিয়া
প্রাথমিক অনুভূতিতে জড় দীঘিটি শুধুমাত্র জলের উপর তরঙ্গায়িত হবার সাথে সাথে জল থেকে রূপ নিয়ে তরঙ্গকে নামায়িত করছে। কিন্তু মানব মনের পিছনে চৈতন্য বা আত্মা লুকিয়ে আছে সে সব কিছুরই দ্রষ্টা। সেই চৈতন্যের মাধ্যমে বুদ্ধি সক্রিয় হয়ে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে মনের ক্যানভাসে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। এখানে একটা জিনিস বোঝা যায় যে, ইন্দ্রিয় একক ভাবে কোন কাজ করতে পারে না, যদি না তার পিছনে চৈতন্য না থাকে, 'প্রতিচ্ছবি' ফুটে না উঠলে বুদ্ধির কোনো কর্ম থাকতো না। বিচার বিশ্লেষণ করে মতামত দেওয়ার কাজটা বুদ্ধির । সে প্রথমেই বাইরে থেকে আসা বস্তুটিকে পর্যবেক্ষন করে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানায় যে, সেটি চেনা না অচেনা বস্তু। অজানা বস্তু হলে তার স্বরূপকে জানার চেষ্টা চালায় ।
অহংকারের শক্তি
অহংকারের শক্তি হচ্ছে মায়া ; নাম আর রূপের বেড়াজাল দিয়ে সত্যকে আড়াল করে রাখে। যেমন, জলের থেকে উদ্ভূত লীলার রূপকে তরঙ্গ নাম দিয়ে জলের থেকে আলাদা করার যে চেষ্টা করা হল, সেটা মায়ার অন্তর্ভূত। এই তিনটি (মন, বুদ্ধি , অহংকার )চিত্তের অন্তর্নিহিত উপাদানের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের বাহ্যিক প্রকাশ হচ্ছে প্রতিক্রিয়া।
বিজ্ঞানের আলোকে প্রতিক্রিয়া
এবার আমরা একটু ঘুরে তাকাই , বিজ্ঞান কি বলছে এই সম্পর্কে। এখানে বেদান্ত যে ভাবে চিত্তের প্রতিক্রিয়ার বর্ননা করেছে, ঠিক তেমনি বিজ্ঞানও বলছে অন্তঃপ্রকৃতিতে অর্থাৎ চিত্তে দুটি বিপরীত বস্তুর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের বাহ্যিক প্রকাশ হচ্ছে প্রতিক্রিয়া। এই দীঘিতে প্রস্তর খন্ড নিক্ষেপের মাধ্যমে যে তরঙ্গ জলে উঠল, সেই তরঙ্গ প্রতক্ষ্য করলো চক্ষু ইন্দ্রিয়, সে এখানে বাহ্যিক পৃথিবী আর অন্তর্জগতের যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যম অর্থাৎ বাইরের জগৎ থেকে সংবাদ অন্তঃপ্রকৃতিতে প্রবেশ করলো। মানবদেহ বহু উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। তারা ব্যস্ত থাকে নিজেদের নির্ধারিত কাজের মধ্যে। এর মধ্যে অন্তঃগ্রন্থিটির কাজ হল শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের সাথে সংযোগ স্থাপন করা। দেহের অভ্যন্তরে এই সংযোগ স্থাপনের কাজ অন্তঃগ্রন্থি একধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মাধ্যমে করে থাকে , যার ক্ষরণ সূচিত হয় তখন , ঠিক যখন ইন্দ্রিয় সংবাদ প্রেরণ করে। সে রক্তের মাধ্যমে সেই খবর পৌঁছে দেয় শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে, সুক্ষ জালগুলিতে, ত্বকে, পেশিতে। এবার সেই সংগৃহীত সংকেতগুলিকে ব্যাখ্যা করে, কি করতে হবে তা শরীরের কর্ম ইন্দ্রিয়কে জানিয়ে দেয়। সেটাই প্রতিক্রিয়া। (প্রতিক্রিয়ার গঠন প্রণালী পরে আলোচনা সাপেক্ষ )
মানসিক আঘাত কি শারীরিক পীড়ার কারণ ?
এই আলোচনার মেয়াদ শেষে, রাজামশাই আচার্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, যদি কোন মানুষ অপর কোন মানুষকে মানসিক ভাবে আঘাত করে, তাহলে সেই মানুষটির ভিতর কি কি ধরনের প্রভাব দেখা যেতে পারে এবং সেই প্রভাবে সেই মানুষটির শারীরিক ও মানসিক কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে এবং তার সুদূরপ্রসারী ফল কি সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে আসবে ?
রাজামশাইয়ের প্রশ্নে আচার্য্য মহাশয় ভীষণ উল্লাসিত হয়ে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন, যে ভেদহীন সমাজব্যবস্থার কথাই তার শিক্ষার অন্তর্নিহিত অর্থ। সেই জ্ঞানের দোরগোড়ায় যে তার ছাত্ররা পৌঁছাতে পেরেছেন, তাতে তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তত্ত্ব আর তার বাস্তব প্রয়োগের ফলশ্রুতি এই দুইটি বিন্দু যখন একবিন্দুতে গিয়ে মিলে মিশে লক্ষকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তখন তা একটি প্রামাণ্য দলিলের আকার ধারণ করে। আগামী দিনের আলোচনার বিষয় এটাই হবে, এই বলে আচার্য্য আজকের মতো বিদায় নিলেন।
ক্ৰমশঃ
বি: দ্রঃ ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও কমেন্ট করুন'
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৭ তম অধ্যায় (১৩৫)
Searching for hidden Truth (৩৯)
অন্যান্য ব্লগ --০৩/১২/২২ পর্যন্ত যা পোস্ট হয়েছে
আত্মদর্শনমূলক ব্লগ -
- ওপারের সংগীত
- ঐকতান
- সভ্যতার নামে প্রহসন
- নাড়ী ছেড়ার গান
- আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয়
- দলিতের সভ্যাভিমান
- একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা
নিছক প্রেমের গল্প -
- বনবিতান
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি মানুষের সংগ্রামের কথা -
- চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক
- আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
- ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা
- মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
নগর দর্পন -
- ধর্ম ও শাসক
- সমাজের রাজন্যবর্গ
- হালচাল
- সহাবস্থান
- নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ২৩ টি পর্বে )
- মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল
- ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে
দর্শন আশ্রিত ব্লগ -
- অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
- আসা আর যাওয়া
- সংঘর্ষ
- উত্তর মীমাংসা
- আগামী
- আমরা বাস করি আনন্দে
- সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব
- অখন্ড যখন খণ্ডিত হয়
- কোথায় পাব তারে
- গোলক ধাঁধা
- চির যৌবনা
- রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি
- একটি অক্ষরের গল্প
- মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
মন্তব্যসমূহ