(১৪৬) সরণি

(১৪৬)     সরণি 

 

       সৃঞ্জনী  আর অনিন্দ্য  দীর্ঘ ৫ বছর ধরে লিভ ইন করছে মার্কিন দেশে হিউস্টন  শহরে। ভারতের প্রথমশ্রেণীর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বেরিয়ে ম্যানেজমেন্ট পাশ করে প্রায় একই সাথে তারা বেশ আকর্ষণীয় চাকরীর অফার নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়।  দুজনেই  কর্পোরেট কালচারে পরিচিত  কিন্তু অভ্যস্ত নয়। হবেই বা কেন,  তারা ভারতীয় সংকৃতিতে এতটাই সমৃদ্ধ, সেখানে তাদের আর অন্য কাউকে স্থান দেবার মতো বিকল্প সংস্কৃতির সন্ধান পায়নি।     

        হিউস্টনে  ৬টার আশেপাশে সূর্য ডোবার সাথে সাথে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে যদিও বাইরের আলোর  ঝলকানি সন্ধ্যাকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। কিন্তু, সৃঞ্জনীদের বাড়িটা অবশ্য শহর  থেকে একটু দূরে। চারিদিকে ওক, মাগলোনিয়া , বাল্ড সাইপ্রেস ইত্যাদি গাছ দিয়ে ঘেরা একটা পুরাতন বাংলো বাড়ি। গাছ গুলির উচ্চতা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে কৃত্রিম আলোর হাত থেকে  প্রকৃতির স্বাভাকিত্ব ধরে রাখতে।       

        প্রত্যেক শনিবার ওরা নিজেদের  মতো করে দিনটা কাটায়। সৃঞ্জনী  হাতে  প্যাট্রন সিলভারের গ্লাস নিয়ে আজ প্রশস্ত  ব্যালকনিতে বসে দূরে বৃক্ষরাশির  দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন সময়  অনিন্দ্যর  গিটারে বেজে উঠলো এক অতি পরিচিত রবীন্দ্র সংগীতের সুর বেজে উঠলো - "   সীমার মাঝে, অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর   ....."  গানের কথা আর সুরের মেল্বন্ধনে সৃঞ্জনীকে প্রায় ১৪০০০ কিলোমিটার দূরে কল্যাণীতে তাদের বাড়ির আঙিনায় নিয়ে এলো একান্ত শৈশবের স্মৃতির হাতছানিতে।  যেখানে, জীবনের শুরুতেই শিখেছিল আত্মবিশ্বাসের প্রাথমিক মাপকাঠি হল প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করা।  আর হেরে যাওয়া প্রতিযোগীদের দুর্দশা দেখে  আনন্দ লাভ করা

         স্মৃতির কুলিনপনা দেখে আজও সে বিস্মিত।  যা ছিল জীবনে  না পছন্দ, তাকে মনের কোঠায় স্থান না দিয়ে আবর্জনার মতো দূরে সরিয়ে রাখতো । সেখানে অদৃশ বিচার প্রক্রিয়াই চূড়ান্ত রায় দেবার একচেটিয়া কতৃত্বের অধিকারী ছিল । 

        মনের গভীরে বাস করা বিচারকরা যারপরনাই অসন্তুষ্ট হলেও স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের চাপিয়ে দেওয়া বিষয়গুলি শুধুমাত্র এক রাশ অভিশাপ হিসাবে  নেমে আসতো।
         অঘোষিত শৈশবের কারাগার হিসাবে পিতামাতারা হয়তো বিদ্যালয়কে বেছে  নেয়।  সেখানে শিশুদের নিরবিচ্ছিন্ন প্রশ্ন আর দুস্টমির স্বাভাবিক প্রকাশকে শিক্ষার ধুয়া তুলে   অভিবাবকরা খুব সচেতনভাবে কিছুক্ষনের জন্য পালিয়ে বেড়ায়।    তার রেশ ধরে গৃহ শিক্ষক আর হোমটাস্কের নাম করে ব্যস্ত রেখে তাদের  সেই প্রতিযোগিতার অঙ্গনে এক প্রকার জোর করে ঠেলে দেওয়া হয় ।

        আজ অবশ্য সেই শিক্ষার  দৌরাত্বে হয়তো বর্তমান  সমাজে প্রত্যাশিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে  কিন্তু " রয়ে গেছে ফাঁক" ।  দৈহিক অত্যাচার করার জন্য  সর্বজনবিদিত সংশোধনাগার আছে, কিন্তু মানসিক উৎপীড়নের জন্য প্রথাগত কোন কারাগার না থাকলেও তার অদৃশ্য উপস্থিতি  সবসময়ে আছে। 

        আজ মনে হয়  প্রতিষ্ঠান মানেই একটা নিয়মকানুনে আবদ্ধ সংশোধনাগার, সেখানে নিয়মের বেড়াজালে ভীষণ পরিকল্পিত  ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক মানুষ তৈরি করা হয় তাদের স্বার্থে কিন্তু প্রকৃত মানুষের  তৈরি করার পক্ষে তা ভীষণ  অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। নিজের হাতে নিজেকে হত্যা করে মানুষ এগিয়ে চলে এক অনির্দিষ্ট জগতে এক বুদ্ধি যুক্ত জীব  হিসাবে,  বুদ্ধিমান হিসাবে নয় , যার অভিমুখের কোন  কুল নেই আর তাই নেই কোন কিনারা।  

        যেখানে একাকিত্ব নিত্য সঙ্গী, মাথার উপর ছাদ আছে, কিন্তু  অদৃশ্য পর্দা  দিয়ে পারস্পরিক  ব্যবধান রচনা করা আছে ;  পরিবার  আছে কিন্তু তার দূরত্ব  অতলস্পর্শী।

        সৃঞ্জনী  ভাবছে একটা শিক্ষাকে মূলধন করে বাজারে গিয়ে সেই মূলধন বিনিয়োগ করে প্রভূত ধন-সম্পত্তি উপাৰ্জন করা যায়, আরেকটা শিক্ষা মনের  ভিতরকার জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে দেয়। একটাতে সুখ আছে আর আছে একঘেয়েমি , অপরটিতে আছে নিবিচ্ছিন্ন শান্তি। 

            তারাই প্রণম্য, যারা তথকথিত প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কটাকে  আলিঙ্গন না করে , 'অসীমের' অর্থের   অন্বেশন করে মানুষের জন্য প্রকৃত শিক্ষার ডালি সাজিয়ে রেখেছেন । সীমা আর অসীম একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।  অজ্ঞানই এই ব্যবধান রচনা করে। অসীম ঠিক ততক্ষনই সুন্দর যতক্ষন সে সত্যের সীমারেখাকে অতিক্রম করে যায় না। সৃঞ্জনী ভাবে এটাই বোধহয় শিল্পের আদর্শ হওয়া উচিত । 



ক্ৰমশঃ


 
  বি: দ্রঃ  ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও  কমেন্ট করুন'       

   

ব্লগার -রবীন মজুমদার

মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৭ তম  অধ্যায় (১৩৫)

Searching for hidden Truth (৩৯) 

 ২৪/০১/২০২৩ পর্যন্ত  ১৪৬ ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ২৩ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন আশ্রিত ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 


মন্তব্যসমূহ

Ani বলেছেন…
লেখাটির মধ্যে অচলায়তন র একটা ছোট্ট টাচ আছে। দেখি ক্রমশ তে কি বেরোয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২১০ ) ঝড়-বৃষ্টির একাল সেকাল