(১৪৭) পরম্পরা
(১৪৭) পরম্পরা
কলকাতা য়ুনিভার্সিটির সনামধন্য দর্শনের অধ্যাপক পি কে সেনের একমাত্র কন্যা সৃঞ্জনী। অধ্যাপকের হৃদয়ের প্রসারতা বহুল চর্চ্চিত। মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক সেন। আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হেমরাজ মান্ডির মাতৃহারা সন্তানকে দত্তক নিয়ে তিনি নতুন পরিচয়ে সমাজে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অনিন্দ্য নামটা আর সেন পদবীটা তারই দেওয়া।
এইতো কোলকাতা থেকে সেদিন সৃঞ্জনীর মাসিমা আর মেসোমশাই আমেরিকায় এসে প্রথমেই হিউস্টনে ওদের বাড়িতে এসে উঠেছে। কথায় কথায়, রিটায়ার্ড স্কুল মিস্ট্রেস মাসিমা সৃঞ্জনীকে জিজ্ঞেস করলো , হ্যারে ! কবে তোরা বিয়েটা করবি। তোরা ভীষণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু এই বিয়ের পরিবর্তে এই লিভ ইন, ব্যাপারটা কি বলতো ? আই অনিন্দ্য ! তোদের সমাজ এটাকে কি ভাবে দেখে ?
অনিন্দ্য জানে মাসিমা রাখঢাক রেখে কথাবার্তা বিশেষ পছন্দ করেন না। তাই, তার উত্তর দেবার ক্ষেত্রে সব রকমের যতি চিহ্নগুলিতে না দাঁড়লেও চলবে।
আদিবাসী, এই শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মনুষ্য সমাজে প্রথম পরিচয়ের গন্ধ অর্থাৎ আদিম মানুষ।
সেদিনের সেই কাঁচা মানুষগুলি সময়ের আগুনে পুড়ে গিয়ে 'আদি'-র জায়গায় 'সভ্য' কথাটি জুড়তে সক্ষম হয়েছে অবশ্য খানিকটা এদিক ওদিক এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
যে কথাটি একেবারে না বললে অসমম্পূর্ন থেকে যায়। বাস্তবে , জীবের এই জগৎ সংসারে প্রাথমিক চাহিদা হল খাদ্য এবং তার পরে যৌনতা।
নারী-পুরুষের যৌন জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে কি আদিবাসী বা আধুনিক সমাজের সার্বিক চিত্রের ইতর বিশেষ পার্থক্য অতীতেও ছিল না আজও নেই।
যে দিন থেকে মানুষ সঙ্গবদ্ধ হয়ে সমাজ তৈরী করতে শিখেছিল , তার সাথে সাথে সমাজের সর্বস্তরে বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কটাকে যেমন একটা নারী পুরুষের যৌন জীবন যাপনের উপর সমাজ সিলমোহর দিয়েছিল , ঠিক তার পাশাপাশি অবিবাহিত নারী-পুরুষদের অবাধ মেলামেশার একটা আশ্রয় স্থলও গড়ে উঠেছিল মূলতঃ তাদের যৌন আকাঙ্খাকে ঘিরে । তাকে "আড্ডাঘর " বলে চিহ্নিত করা হতো।
এই আড্ডাঘরটি বিভিন্ন নামে আদিবাসী সমাজগুলিতে পরিচিত ছিল। কিন্তু তার আদর্শের বিশেষ ফারাক ছিল না।
এটি সংকীর্ণ অর্থে নারী-পুরুষের যৌন মিলনের আড্ডাস্থল হলেও ব্যাপকতর অর্থে আদিম সমাজের আচার-অনুষ্ঠান, নাচ-গান , ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদির মিলন ক্ষেত্র বা আদিবাসী সমাজের সংকৃতির পীঠস্থান বললেও অত্যুক্তি হয় না।
পৃথিবীর সব আদিবাসীদের মধ্যেই এই ব্যাচেলর নারী-পুরুষদের অবাধ মিলনের রীতি প্রচলিত ছিল। তার কিছু উদাহরন দেওয়া যেতে পারে। যেমন, চট্টগ্রামে মগদ আদিবাসীদের আড্ডা ঘরের নাম "চেরাং " ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আড্ডাঘরের নাম 'ক্যাং " । যদিও কাং-এর রীতি নীতি গুলি অন্য সবার থেকে একটু আলাদা। লুসাই-কুকীদের আড্ডাঘরের নাম "জলবুক "।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার গারো ও হাজংদের আড্ডাঘর 'ডেকাচাং ' নামে পরিচিত।
' আখড়ার ' এই শব্দটি অতি পরিচিত একটি নাম সাওতাল সমাজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে। যদিও সেটি অবিবাহিত নারী-পুরুষের সঙ্গমের স্থল নয় কিন্তু সেটা ছিল তাদের যৌনলিপ্সার গেটওয়ে।
একটু ঘুরপথে অবিবাহিত নর-নারীর মিলনের আড্ডাঘর 'গীতিওৱা' । সেখানে হো , মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসীরা সমবেত হতো।
আসামের পাবর্ত্য অঞ্চলে বসবাসকারী ভুটিয়া , মিজি, মোপা , সিংগফু, মিসং , তাহীন, নাগা প্রভৃতিদের মধ্যে আড্ডাঘরের প্রচলন এখনো আছে। সিংগফু, মিশমি এবং মিরিদের আড্ডাঘরের নাম ' আরিজু ' । ' মোরাং ' নামটা আড্ডাঘর হিসাবে আসামের সর্বত্র পরিচিত ।
' গোতুল' এক অতি পরিচিত আড্ডাঘরের নাম মধ্যপ্রদেশের মুরিয়া অধিবাসীদের মধ্যে। যেহেতু সমাজ কতৃক স্বীকৃত এই আড্ডাঘরগুলি, তাই কিছু অলিখিত নিয়মের বেড়াজালের দ্বারা তারা আবদ্ধ ছিল।
উড়িষ্যার আদিবাসীদের মধ্যে আড্ডাঘরকে ' মান্দাঘর ' বলে। কি অসম্ভব তার ব্যাপ্তি। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিসাবে, গ্রামের মানুষেরা , আগামী দিনে কি কি পরিকল্পনা কর হবে, তাদের গ্রামকে কেন্দ্র করে , তা নির্ধারিত হতো। যেমন, কোন ক্ষেতে কি বীজবপন হবে তাও নির্ধারিত হতো , নাচ-গান শিক্ষার কেন্দ্রীয় ভূমি ছিল, একজন গুরু ধরনের মানুষ থাকতো, যিনি ধর্ম চর্চ্চা করতেন সেই আড্ডাঘরগুলিতে। আগামী দিনে নর-নারীর বৈবাহিক বন্ধনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া আড্ডাঘরেই সম্পন্ন হতো ।
মেলানেশিয়া এবং নিউগিনি অঞ্চলে আদিবাসীদের ' পুতুমা ' নাম খ্যাত ঘরগুলি জোড়ায় জোড়ায় রাত্রি যাপনের ব্যবস্থাটা ছিল সমাজ স্বীকৃত।
নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের ' হোয়ারি ' নামে আড্ডাঘরগুলি আমোদ প্রমাদের জন্য তৈয়ারী।
মালয় দ্বীপপুঞ্জের জ্যাকুন আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে , বিয়ের পূর্বে যুবক-যুবতীগন যৌন ক্রিয়া নিজেদের বসতবাড়িতে করে না।
ব্রিটিশ গাড়োয়াল এবং আলমোড়া অঞ্চলে ভুটিয়াদের আড্ডাঘর 'ব্যামবাংগ' -এর একটু আলাদা। সেখানে ছেলেমেয়ে, বিবাহিত-অবিবাহিত নারী-পুরুষ রাত্রি যাপন করতে পারত ।
গান-বাজনা, নাচ-গান, হাতের কাজ , শিল্পকলা, হাসি-তামাশা, ধর্ম চর্চা যেমন একদিকে ছিল, আবার অন্যদিকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রপাতিও সেখানে থাকতো। প্রত্নতাত্তিক গবেষণায় এইগুলি উঠে এসেছে। কোথাও কোথাও আড্ডাঘরের সদস্য হতে গেলে পুরুষদের বেশ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হতো।
এহেন , সারা বিশ্বে সমগ্র জাতি ও সমাজের মধ্যে লিভ-ইনের প্রভূত নজির আছে। প্রাথমিকভাবে নারী-পুরুষের যৌন আবেদনকে লিভ-ইনের প্রাণ বলে ধরা হলেও গৌণ কারণ হিসাবে সেটাকে কেন্দ্র করে, পারস্পরিক চেনা জানা এবং সাংকৃতিক আদান প্রদানটাও গড়ে উঠে।
আবাহনকাল ধরে চলে আসা এই সংকৃতি আদিবাসী বা সভ্য সমাজ বলে আলাদা ভাবে কিছু নেই, কিংবা এই চর্চার কোন ব্যাঘাত হয়নি বা আগামী দিনে ও হবেনা বলে বিশ্বাস ।
এই বলে অনিন্দ্য সৃঞ্জনীর দিকে তাকিয়ে একটু থামলো।
ক্ৰমশঃ
বি: দ্রঃ ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও কমেন্ট করুন'
ক্ৰমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৭ তম অধ্যায় (১৩৫)
Searching for hidden Truth (৩৯)
২৭/০১/২০২৩ পর্যন্ত ১৪৭ ব্লগ পোস্ট করা হয়েছে
আত্মদর্শনমূলক ব্লগ -
- ওপারের সংগীত
- ঐকতান
- সভ্যতার নামে প্রহসন
- নাড়ী ছেড়ার গান
- আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয়
- দলিতের সভ্যাভিমান
- একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা
নিছক প্রেমের গল্প -
- বনবিতান
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি মানুষের সংগ্রামের কথা -
- চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক
- আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
- ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা
- মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
নগর দর্পন -
- ধর্ম ও শাসক
- সমাজের রাজন্যবর্গ
- হালচাল
- সহাবস্থান
- নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ২৩ টি পর্বে )
- মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল
- ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে
- রজ্জুতে সর্প দর্শন
নিছক প্রেমের গল্প -
- বনবিতান
দর্শন আশ্রিত ব্লগ -
- অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
- আসা আর যাওয়া
- সংঘর্ষ
- উত্তর মীমাংসা
- আগামী
- আমরা বাস করি আনন্দে
- সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব
- অখন্ড যখন খণ্ডিত হয়
- কোথায় পাব তারে
- গোলক ধাঁধা
- চির যৌবনা
- রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি
- একটি অক্ষরের গল্প
- মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
- সরণি
মন্তব্যসমূহ