মেলবন্ধন -(১৪৮)

 মেলবন্ধন -(১৪৮)



( "পরম্পরা"র  পর....)

         অনিন্দ্য লিভ-ইনের বর্ণনা দিতে গিয়ে  মানব সভ্যতার  ভীষণ বাস্তব দিকগুলি বলে গেলো।  আমি, তোমাদের এই বাস্তবতার নেপথ্যে  যে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সত্য  আছে, সেটাকে তুলে ধরতে চাই - এই বলে আলোচনার গতিপথটা সৃঞ্জনী নিজের দিকে নিয়ে এলো।   
    সৃষ্টি ও যৌনতা একে অন্যের পরিপূরক।   সৃষ্টি করতে গেলে দুটি জিনিসের প্রয়োজন। "ইন্টেলিজেন্স কজ " এবং "মেটেরিয়াল কজ" অর্থাৎ একজন বানাবেন আর কি দিয়ে তিনি বানাবেন।  এই দুইটিই  পরম ব্রহ্ম নিজের মধ্য থেকে তৈরি করেন, যখন তিনি সৃষ্টির কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান।  
        ভারতীয় দর্শনে  সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মকে দুইভাবে দেখানো হয়েছে, পরমব্রহ্ম এবং নির্গুণ ব্রহ্ম।   সত্ত্ব , রজঃ ও তম এই তিনটি গুণ   দিয়ে  নির্গুণ ব্রহ্ম সৃষ্টির কাজ শুরু করেন।  এবার ,  সৃষ্টি হল জগতের ,   কিন্তু জগৎ  তো 'জড়', তাই ব্রহ্ম চৈতন্য হয়ে তাতে প্রবেশ করলেন। প্রকৃতি ও ব্রহ্মন এই দুইয়ের মধ্যে কমন ফ্যাক্টর চৈতন্য।  সৃষ্টির কাজকে  অব্যাহত রাখতে গেলে এই দুইয়েরই প্রয়োজন ।  
      চৈতন্য যেই বস্তুতে প্রবেশ করেন, তখন সে, সেই বস্তুরই  রূপ ধারণ করে , যেমন অগ্নি।  আগুন যদি বাড়িতে লাগে তাহলেও আগুনের রূপে তার  প্রকাশ হয়, আবার কাঠের চেয়ারে লাগে তখন সে আগুনের আকার ধারণ করে। 
       হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের উপর  নয়, বিচারের উপর দাঁড়িয়ে আছে।  চৈতন্য যে আছে তার প্রমান কি ? বেদান্ত বলছে তিনটি অবস্থায় তাকে বিচার করো।  এই তিনটি অবস্থা হচ্ছে জাগ্রত , স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। এবার এই পদ্ধতিটা নিজেরাই পরীক্ষা করা যেতে পারে। 
        জাগ্রত অবস্থায় দেহ আর মন একই সাথে কাজ করে  এবং গোটা অবস্থাটির  সাক্ষীরূপে চৈতন্য প্রত্যক্ষ করেন ।
         দ্বিতীয়ত, যখন দেহ যখন নিদ্রায় অচেতন সেখানে শুধু মনই  পরে থাকে , সেখানে দেহ নেই কিন্তু বহু বিষয়  স্বপ্নরূপে মনের উপর কাজ করে। সেটাই  স্বপ্নময় অবস্থা। মানুষ যে স্বপ্ন দেখছেন, তখন  সেই অবস্থাটার  সাক্ষী থাকেন  চৈতন্য।  
             তৃতীয়ত , এমন একটা অবস্থা আসে যখন দেহ ও মন দুইই অনুপস্থিত থাকে অর্থাৎ মানুষ গভীর ঘুমে মানুষ অচেতন , সেই অবস্থাকে বলে সুষুপ্তি। সেখানে মন আর দেহ উভয়েই অনুপস্থিত। কিন্তু, সেই অবস্থারও  একজনই  সাক্ষী থাকেন, তিনিই  চৈতন্য। সেখানে মানুষের জীবন সম্পর্কে গ্লানি থাকে না, তাই সেটা  আনন্দঘন মুহূর্ত।  মানুষ নিজের অজান্তে প্রত্যেক দিনই যখন সুষুপ্তি অবস্থায় পৌঁছায়, তখন সে চৈতন্যতে  অবচেতনভাবে  পৌঁছে যায় আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে পূর্বের অবস্থা।   
        এই চিরস্থায়ী আনন্দময় জীবনই জ্ঞাতসারে উপলদ্ধি করাই মানুষের মূল  লক্ষ্য আর সেটাকেই  চৈতন্য  বা পরমব্রহ্মকে  লাভ করা বলে।  
        আবার, যদি সেই লিভ-ইনের  প্রসঙ্গে ফিরে আসি, আর  যৌনতাকে যদি আবেগ বলে ধরা হয়, সে কি প্রথমেই সামাজিক বাধ্যবাধকতাকে মান্যতা দেয় ? আমার মন হয় দেয় না। যেমন, প্রকৃতির রাজ্যে ফুল ফোটে, ফল হয়, পাতা ঝরে, বৃহৎ বৃক্ষ তার ছোট্ট বীজের মধ্যে নতুন প্রাণের সম্ভবনা রেখে যায়, তখন কেউ কি তাকে প্রশ্ন করে, কেন তুমি এমনটি করলে ? কেননা সেটা প্রশ্নাতীত। 
        প্রকৃতির রাজ্যের কুশীলবদের সাথে মানুষের মূল ব্যবধান হচ্ছে ধর্ম পালন। ধর্মকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এক কথায় বলা যায়, " যে  কথা দেওয়া হয় সার্বিক কল্যানে  আর সেই প্রতিজ্ঞাটাকে  য্থায্থভাবে পালন করাটাই  ধর্ম "- যার উপর সমাজটা দাঁড়িয়ে আছে। 
        চৈতন্য'র সাথে যৌনতার কিংবা বিজ্ঞানের সম্পর্ক কি  - এই প্রশ্নটা উঠতে পারে। শারীরিক গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যখন সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় দেহ-মন অংশ গ্রহণের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে, তখন জৈবিক চেতনা অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হয় এর সাথে   মানুষের  স্নায়ুতন্ত্রের স্থাপত্য উপর্যুপরি  সঙ্গ দেয়। জৈবিক চেতনা যখন ব্যক্ত হয় তখন বুদ্ধির  উপর  'মায়া'র একটা দীর্ঘ ছায়া পরে।  জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রোগ্রামিং-এর ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী তখন মানুষ পরিচালিত হয়।  
 
         ভীষণ প্রাসঙ্গিক ভাবে বলা যেতে পারে, যৌনতার সাথে সৃষ্টির এক গভীর সম্পর্ক আছে।  তার প্রমান হচ্ছে, যেখানে লোকচক্ষুর আড়ালে অবাধ যৌনতা প্রদর্শনের জন্য যে 'আড্ডাঘর' মানুষ তৈরি করেছিল, সেখানেই  কিন্তু শিল্পকলা  ও সৃষ্টিধর্মী কাজ অনেক বেশি হয়েছে। 

  ক্ৰমশঃ

 
  বি: দ্রঃ  ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও  কমেন্ট করুন'       

   

 

ক্ৰমশঃ


 
   

ব্লগার -রবীন মজুমদার

মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৭ তম  অধ্যায় (১৩৫)

Searching for hidden Truth (৩৯) 

৩১/০১/২০২৩ পর্যন্ত  ১৪৮ ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ২৩ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন আশ্রিত ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 
  • পরম্পরা 
  • মেলবন্ধন 



মন্তব্যসমূহ

Ani বলেছেন…
খুব সুন্দর হচ্ছে। যতটা না গল্প তার চেয়ে প্রবন্ধ বেশি বলা যেতে পারে। প্রাবন্ধিকের প্রয়োজনের ফল হলো, দুটি চরিত্রের সৃষ্টি। খুব ভালো হচ্ছে, চালিয়ে যাও।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়